কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি হিসাবের চেয়ে ইপিবির হিসাব বেশি থাকার কারণে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হত এবং আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থাকত, বলেন ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
Published : 04 Jul 2024, 12:11 AM
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় পরিবর্তন এসেছে; উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, এক মাসের ব্যবধানে উল্টে গেছে আর্থিক হিসাবের চিত্রও।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, আইএমএফের পরামর্শ মানতে গিয়ে নতুনভাবে হিসাব করায় এ দুই আর্থিক সূচকের তথ্যে বড় রদবদল হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের তথ্য সমন্বয়ের কারণেই এমন পরিবর্তন এসেছে।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালানাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি এবং আর্থিক হিসাব ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে। আগের মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাব ছিল উদ্বৃত্ত এবং ঘাটতিতে ছিল আর্থিক হিসাব।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছি ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। আগের মাস মার্চ পর্যন্ত এ চিত্র ছিল উল্টো।
আগের মাসে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৯ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল ১০ মাস সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এতে দেখা যাচ্ছে আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এ সময়ে ঘাটতি কমেছে ৪৩.৮১ শতাংশ।
অপরদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এ সময়ে উদ্বৃত্ত কমেছে ৩৭ শতাংশ।
সমন্বয়ের মাধ্যমে নতুনভাবে হিসাব তৈরি করায় আগের অর্থবছরের তথ্যেও এখন পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারওয়ার হোসেন বলেন, সমন্বয় করার কারণে আগের বছরে ডেটাতেও পরিবর্তন এসেছে।
কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। তবে ঘাটতি থাকলে তা মেটাতে ঋণ নিতে হয়।
অপরদিকে আর্থিক হিসাব করা হয় বিদেশি ঋণ ও সহায়তা, বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং পোর্টফলিও ইনভেস্টমেন্টের পরিসংখ্যানগুলোর যোগ বিয়োগ করে।
কেন এ পরিবর্তন
এ দুই হিসাবে এমন পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইপিবির রপ্তানি আয়ের তথ্যে এক ধরনের পার্থক্য ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি হিসাবের চেয়ে ইপিবির হিসাব বেশি থাকার কারণে চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত হত এবং আর্থিক হিসাব ঘাটতি হত। এ সমন্বয়ের পর এত বড় পরবর্তন এসেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারওয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির রপ্তানির হিসাবে একটা পার্থক্য ছিল। রপ্তানি হিসাব ইপিবি বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রদান করে। বাংলাদেশ ব্যাংক সে অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্টের তথ্য দিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো তথ্যে ভুল ছিল না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানির হিসাবের ভ্যালু এবং ইপিবির রপ্তানির হিসাবের ভ্যালুর মধ্যে পার্থক্য ছিল।
তিনি বলেন, ইপিবি রপ্তানির হিসাব ’ডাবল কাউন্টিং’ করত। ইপিবির হিসাবে রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেশি আসত। ফলে রপ্তানি বেশি দেখালে চলতি হিসাবে প্রভাব পড়ে। রপ্তানির হিসাব বেশি হওয়ার কারণে চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত ছিল। এখন সমন্বয় করার কারণে চলতি হিসাব ঘাটতি হয়েছে।”
বিষয়টিকে আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির জন্য পণ্য জাহাজীকরণ এবং বিল প্রত্যাবাসনের মধ্যে যে পার্থক্য সেটিকে ট্রেড ক্রেডিট হিসাবে দেখানো হয়। এখন আইএমফের চাপে রপ্তানির হিসাবে ফাঁকি বন্ধ হয়েছে। রপ্তানির আসল তথ্যের কারণে এতদিন যেখানে প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছিল আসলে তা ঋণাত্বক। যে কারণে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থেকে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
“এর বিপরীতে প্রকৃত তথ্যের কারণে রপ্তানি এবং পণ্য প্রত্যাবাসনের মধ্যে পার্থক্য কমেছে। ফলে ট্রেড ক্রেডিট অনেক কমে গেছে। এতে স্বংক্রিয়ভাবে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়েছে।”
এ নিয়ে ইপিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি সব কিছু পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেটির ভিত্তিতে রপ্তানি আয়ের হিসাব সমন্বয় করা হচ্ছে।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি তথ্যে আগের থেকেই গড়মিল ছিল। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে আলোচনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ বিষয়টি ঠিক করতে বলে। তাদের শর্তের কারণে এখন ইপিবি সঠিক তথ্য দেওয়া শুরু করেছে।
অর্থনীতির বিশ্লেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইএমএফের চাপে সংস্থাগুলো সঠিক তথ্য প্রদান করা শুরু করেছে। ফলে রপ্তানির হিসাব যত বড় করে দেখানো হত, আসলে রপ্তানি এত বেশি নয়। রপ্তানির হিসাব বেশি দেখানোর কারণেই চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত আসত।”
রপ্তানি ও পণ্যের আয় প্রত্যাবাসনে পার্থক্য থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেটা সমন্বয় করা হয়েছে। এতে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে।
বৈদেশিক লেনদেনের সার্বিক ভারসাম্য বলা হয়। এটা যত ঘাটতি হবে ততই রিজার্ভ ও ডলারের উপর চাপ তৈরি হয়।
বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে
রপ্তানি আয় না বাড়লেও আমদানি ব্যয় বেশি কমায় সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ২০ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এই ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৩ দশমকি ৬০ বিলিয়ন ডলার।
গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ কমে হয় ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ৩৬ দশমিক ১৩ ডলার।
বিপরীতে এ সময়ে আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসে আমদানি হয়েছে ৫২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৫৯ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার।
এ সময়ে সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) ঘাটতি কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-এপ্রিলে এ হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে যা ছিল ৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে ঘাটতি কমেছে ৩৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।
এ সময়ে মোট সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের এপ্রিল শেষে মোট এফডিআই এসেছে ৩ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।
আরও পড়ুন