এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট- এলটিইউ (মূসক) বিএটির কারখানা ও গুদামে মজুদ ও বিক্রির তথ্য যাচাই করে এর প্রমাণ পেয়েছে। এই টাকা আদায়যোগ্য বলে নোটিসও দেওয়া হয়েছে।
Published : 01 Oct 2024, 12:03 AM
বাজেটে কর বাড়ানোর পর দোকানে বাড়তি দামে সিগারেট বিক্রি হলেও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বা বিএটি বাংলাদেশের কৌশলের কারণে সরকার চলতি বছর ২১০ কোটি টাকার বেশি শুল্ক ও কর থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট- এলটিইউ (মূসক) বিএটির কারখানা ও গুদামে মজুদ ও বিক্রির তথ্য যাচাই করে এর প্রমাণ পেয়ে কোম্পানিটিকে নোটিস দিয়েছে।
তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিএটিকে এ বিষয়ে একটি ‘ডিমান্ড নোট’ পাঠানো হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন এলটিইউর (মূসক) কমিশনার মো. সামছুল ইসলাম। এই অর্থ আদায়যোগ্য বলেও সেখানে লেখা হয়েছে।
তবে নোটিসকে ‘গোপনীয়’ দাবি করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি বিএটির মুখপাত্র।
প্রতি বছর বাজেটে কর বাড়িয়ে দেওয়ার পর বাড়তি দামেই ভোক্তাদের সিগারেট কিনতে হয়। কিন্তু কোম্পানির কৌশলের কারণে সরকারের প্রথম কয়েক মাসে কোনো লাভ হয় না।
সিগারেট কোম্পানিগুলো বাজেটের আগ থেকেই বাড়তি উৎপাদন করে তাদের কারখানা থেকে পুরনো শুল্ক-কর পরিশোধ করেই মাল খালাস করে ফেলে। এই সিগারেটই বাড়তি দামে ভোক্তার কাছে বিক্রি করা হয়।
কীভাবে সরকার ঠকছে, তা জানতে আরও পড়ুন:
সিগারেটে বাড়তি কর: কোম্পানি 'কৌশলী', ঠকছে সরকার
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “প্রতি বছরই যেহেতু কোম্পানিগুলো এ সুযোগ নেয়, সেটি বিবেচনায় রেখে বাজেট উপস্থাপনের আগের দিন আমরা তাদের কারখানায় গিয়ে মজুদকৃত সিগারেটের তথ্য নিই।
“বাজেটের পরে এ কোম্পানিরই গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ডিপো ও ওয়্যারহাউজগুলোতে গিয়ে দেখি তারা একই সিগারেট বাজেটের শুল্ক-কর যোগ করে বাড়তি মূল্যে জেলায় জেলায় সরবরাহ করছে।”
দেশে এমন ওয়্যারহাউজ কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “২৫টির কম হবে না, ৩০ বা ৩৫টিও হতে পারে।”
জুনের ৬ তারিখ চলতি বছরের বাজেট উপস্থাপন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাজেটে চার স্তরের সিগারেটেরই কর হার ও দাম একইসঙ্গে বাড়ানো হয়, যা এবারই প্রথম। এলটিইউএর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিএটির কৌশলে ২১০ কোটি ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪২ টাকা কর পায়নি সরকার।
যেভাবে বের হল হিসাব
এলটিইউএ কীভাবে এই হিসাব বের করল, তা ব্যাখ্যা করে সেই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বাজেটের আগের দিন যে মজুদকৃত সিগারেট পেয়েছি এবং সেসব বাড়তি দামে পরে বিক্রি হয়েছে, তাই মজুদকৃত সিগারেটেরই নতুন মূল্য ধরে এটি নিরূপণ করেছি।”
এলটিউএর কমিশনার সামছুল ইসলামের স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানো নোটিসে বিএটিকে বলা হয়, জুনের ৫ তারিখ পর্যন্ত কার্যকর মূল্যের ভিত্তিতে সিগারেটের উপর প্রযোজ্য ৩ হাজার ৪৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬ টাকা শুল্ক-কর পরিশোধ করে ওয়্যারহাউজে সিগারেট স্থানান্তর করেছে।
কিন্তু ওয়্যারহাউজে মজুদ করা সিগারেট জুনের ৬ তারিখ থেকে ক্রেতার (ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটর) কাছে বর্ধিত মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে।
বর্ধিত মূল্যে সিগারেট সরবরাহ করায় মোট শুল্ক ও করের পরিমাণ হয় ৩ হাজার ২৫৫ কোটি ৫২ লাখ ১ হাজার ৪২৭ টাকা হওয়ার কথা বলা হয়েছে ডিমান্ড নোটে।
সেখানে বলা হয়েছে, বর্ধিত মূল্যে সিগারেট সরবরাহ করায় ২১০ কোটি ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪২ টাকা শুল্ক-কর ‘আদায়যোগ্য’ হয়েছে।
এলটিইউর (মূসক) কমিশনার সামছুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোম্পানিকে বৃহস্পতিবার ‘ডিমান্ড নোট’ দেওয়া হয়েছে। এতে ১৫ দিনের মাঝে জবাব দিতে কথা বলা হয়েছে।”
চূড়ান্তভাবে কর নির্ধারণের পর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ধারা-১২৭(১) অনুযায়ী দাবিকৃত রাজস্ব পরিশোধের আগের দিন পর্যন্ত প্রযোজ্য হারে সুদ আদায়যোগ্য হবে বলে সেখানে জানানো হয়েছে।
‘কর পরিহার’, ফাঁকি নয় কেন?
সিগারেট কোম্পানির কর দিতে হয় কারখানা থেকে বের হওয়ার সময়েই। যেহেতু বৃহৎ ভোক্তা পর্যায়ে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন, তাই এ প্রক্রিয়া।
এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (মূসক বিধি) মো. বদরুজ্জামান মুন্সীর ভাষ্য, “সিগারেট অন্য পণ্যের মত না। ভোক্তা পর্যায়ে নিতে গেলে কর ফাঁকির পরিমাণ বাড়বে তাই সিগারেটের কর নেওয়া হয় উৎপাদনের পর বাজারে ছাড়ার আগেই।”
কারখানা থেকে বেরিয়ে গেলে তারপর আর এনবিআরের দায়িত্ব থাকে না বলেও বরাবরই বলে আসছে এনবিআর। এবং এ বিষয়ে তদারকির দায়িত্ব জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণের বলেই তাদের মত।
যেহেতু কোম্পানি তার ঘোষিত মূল্যে শুল্ক-কর পরিশোধ করেন, তাই পরে বেশি মূল্যে ‘কৌশলে’ বিক্রি করায় যে কর সরকার হারায় সেটিকে সরাসরি ‘কর ফাঁকি’ না বলে ‘কর পরিহার’ বলে এনবিআর। মানে কোন পদ্ধতিতে হাঁটলে কম কর দিতে হবে সে পন্থা বা কৌশলের আশ্রয় নেওয়া।
পুরনো সিগারেট বাড়তি দামে
বাজেটের এক মাস পার হওয়ার পরেও রাজধানীর একাধিক এলাকায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস এবং মার্লবোরোর ২০ শলাকার প্যাকেটে মুদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য আগের মতই ৩১০ টাকা লেখা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু খুচরা দোকানিরা দাম রাখছেন ৩২৪ থেকে ৩২৫ টাকা। তাদের যুক্তি, বাজেটে কর বেড়েছে, এ কারণে কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে।
আইন অনুযায়ী বাজেট ঘোষণার পর থেকেই প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩২৪ বা ৩২৫ টাকা লেখা থাকার কথা ছিল। তা লেখা না থাকায় জনগণের পকেট থেকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হলেও সরকার তার প্রাপ্য বাড়তি রাজস্ব পায়নি।
আগের হিসাবে ৮১ শতাংশ করভারে সরকার রাজস্ব পেত ২৫১ টাকা ১০ পয়সা। অথচ বর্তমান করভার হিসাবে রাজস্ব পাওয়ার কথা ২৬৫ টাকা ৬৮ পয়সা।
বেনসন বিএটির একটি সিগারেটের নাম। এর মত প্রতিটি ব্র্যান্ডের সব সিগারেটের ক্ষেত্রেই ঘটেছে একই ঘটনা।
‘গোপন বিষয়’, তাই বক্তব্য ‘নেই’ বিএটির
বাজেটের আগের দিনের মজুদ সিগারেট কী দামে সরবরাহ হয়েছে এবং কী হারে শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়েছে-বিএটির কাছ থেকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে হিসাব বিবরণী ও বক্তব্য সমর্থিত দলিল চেয়েছিল এলটিইউ।
বিএটি সেসব দলিল দাখিলে ৩০ দিন সময় বৃদ্ধির আবেদন করে, পরে আবার ৭ দিন সময় চাওয়া হয়। এরপর একটি হিসাব বিবরণী দাখিল করা হলেও পরিবেশকের কাছে কোন মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে এবং কী হারে শুল্ক-করা পরিশোধ করা হয়েছে, তার কোনো প্রমাণ দাখিল করেননি।
বিএটি বাংলাদেশের কাছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তিনটি বিষয়ে প্রশ্ন রাখে। ১. কর পরিহারের অভিযোগের বিষয়ে কোম্পানির অবস্থান কী, ২. বারবার সময় চাইলেও কেন দলিল পেশ করা যায়নি, ৩. তখন প্রমাণ পেশ না করতে পারলে এখন কীভাবে পারবে তারা।
বাংলাদেশে বিএটির জনসংযোগের কাজ করে এশিয়াটিক ফরথট পিআর। তাদের মাধ্যমে আসা জবাবে বিএটি বাংলাদেশের মুখপাত্র বলেন, “আমরা বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট-ভ্যাট থেকে প্রাপ্ত কারণ দর্শানোর নোটিস পর্যালোচনা করছি।
“বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট-ভ্যাট এবং বিএটি বাংলাদেশের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়, যার ফলে এই মুহূর্তে আমরা আর কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।”