বিশ্বব্যাপী শুল্ক আরোপের ফলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
Published : 06 Apr 2025, 12:55 AM
বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক বাতি বিক্রি করেন ব্যবসায়ী টিম সু, যার সিংহভাগ ক্রেতাই আমেরিকান। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ‘বিশ্বব্যাপী’ নতুন যে শুল্ক ঘোষণা করেছেন, তাতে তার পুরো ব্যবসার ছকই ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।
টিম সু তাইওয়ানের ব্যবসায়ী, যিনি পণ্য বানাতেন চীনে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে চীন বাড়তি শুল্কের মুখে পড়তে পারে–এমন আশঙ্কায় আগাম সতর্কতা হিসেবে গতবছর কম্বোডিয়ায় কারখানা খোলেন তিনি।
কিন্তু গত বুধবার ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণা সব কিছুই এলোমেলো করে দিয়েছে। কম্বোডিয়া থেকে পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্ক বসিয়েছে, তা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ; বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়।
সিএনএনকে টিম সু বলেন, “৪৯ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে আমরা কম্বোডিয়া থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেব।”
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে এরই মধ্যে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারসহ বেশ কিছু মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কম্বোডিয়া সরকার।
মার্কিন শুল্ক আরোপের বাস্তবায়ন যেন পিছিয়ে দেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্রকে সে অনুরোধও জানিয়েছে কম্বোডিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
কম্বোডিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া সু’র জন্য তুলনামূলক সহজ। কারণ, সেখানে তার বিনিয়োগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
কিন্তু অনেক কোম্পানি আছে, যারা অনেক আগে থেকেই সেখানে ব্যবসা করছে এবং দেশটিতে তাদের হাজারো কর্মী রয়েছে।
লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের ওপর ৪০ শতাংশের বেশি শুল্ক বসিয়েছেন ট্রাম্প, যা তাদের রপ্তানিনির্ভর ব্যবসা ও দুর্বল অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে।
যেসব বিনিয়োগকারী চীনের সরবরাহ ব্যবস্থার বিকল্প চান, তাদের কাছ থেকে এসব দেশ গত দেড় দশক ধরে নানা সুবিধা পেয়ে আসছে।
সিডনিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লোয়ি ইনস্টিটিউটের ইন্দো-প্যাসিফিক ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের সদস্য আহমেদ আলবায়রাক বলেন, ট্রাম্পের শুল্কের কারণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কম্বোডিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি পোশাক ও জুতা রপ্তানি করে থাকে।
গত এক দশকে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হলেও কম্বোডিয়া এখনো এশিয়ার সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি।
কম্বোডিয়ার অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিএনএন বলছে, দেশটির রপ্তানি পণ্যের ৩৭ শতাংশের বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্রে। এর প্রায় ৪৩ শতাংশই পোশাক ও জুতা। সে হিসাবে পোশাক কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সবচেয়ে বেশি।
জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, গত বছর দেশটিতে গার্মেন্ট, টেক্সটাইল ও ফুটওয়্যার খাতে কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ, যার ৭৫ শতাংশই নারী।
চীনের সম্পৃক্ততা কমাতে নাইকি ও অ্যাডিডাসের মত নামকরা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো তাদের উৎপাদনব্যবস্থা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তর করছে।
আলবায়রাক বলেন, বৃহত্তর অর্থনীতিতে ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাব ব্যাপক। উৎপাদন কমে যাওয়া কিংবা কর্মী ছাটাইয়ের ঝুঁকিও দেখছেন তিনি।
শুল্ক আরোপের যুক্তি হিসেবে ট্রাম্প বলছেন, এতে করে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান বাড়বে।
কিন্তু ট্রাম্পের এ চিন্তাভাবনা বাস্তবে ফলবে না বলে মনে করেন কম্বোডিয়াভিত্তিক ‘ক্যামইড বিজনেস স্কুলের’র প্রেসিডেন্ট কেইসি বার্নেট।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে কম্বোডিয়া মূলত মোজা, শর্টস, জিনস, টি-শার্ট ও অ্যাথলেটদের জুতাসহ বিভিন্ন তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। কম দক্ষতাসম্পন্ন ও ব্যাপক শ্রমিকনির্ভর এ উৎপাদনব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।”
‘নিশানায় চীন’
কিছু বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন, দক্ষিণপূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ঘনিষ্ঠ রপ্তানিকারক দেশগুলোকে লক্ষ্য করে ট্রাম্প নতুন শুল্ক আরোপ করেছেন।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে লাওসের পণ্যে ৪৮ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৪৬ শতাংশ ও মিয়ানমারের পণ্যে ৪৪ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়েছে। কম্বোডিয়ার মত লাওস ও মিয়ানমারের অর্থনীতিও দুর্বল।
তৈরি পোশাকের আরেক বড় উৎপাদনকারী দেশ ভিয়েতনাম। দেশটিতে গত কয়েক বছরে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে।
সিএনএন বলছে, গেল বছর ভিয়েতনাম যত পণ্য রপ্তানি করেছে, তার ৩০ শতাংশই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইএসইএএস-ইউসোফ ইশাক ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ধার্মা নেগারা বলেন, “ট্রাম্পের নীতির মূল নিশানা হল চীন।
“তৃতীয় দেশ হয়ে আমেরিকান বাজারে প্রবেশের যে কৌশল চীনের রয়েছে, নতুন শুল্কের মাধ্যমে ট্রাম্প মূলত সেটাই প্রতিহত করতে চান।”
হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এডউইন লাই মনে করেন, “এসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। দেশগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগও এই ঘাটতির একটা কারণ।
“যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি জানে। আর এ কারণেই ট্রাম্প অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেন এসব দেশে চীনের বিনিয়োগ কমে যায়।”
তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী ‘নির্বিচারে’ শুল্ক আরোপের ফলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। আর চীন হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব বাণিজ্যের কর্তা।”
আরও পড়ুন:
মার্কিন পণ্যে অতিরিক্ত ৩৪% শুল্ক বসাচ্ছে চীন
শাস্তি নাকি উপহার? ট্রাম্পের শুল্ককে ৫ বৃহৎ অর্থনীতি যেভাবে দেখছে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিলম্বে শুল্ক তুলে নেওয়ার আহ্বান চীনের