গ্রিড উপকেন্দ্রের পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাবে ‘কম মূল্যের’ এ বিদ্যুৎ পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
Published : 13 Feb 2024, 11:23 PM
বছর খানেক আগে নির্মাণকাজ শেষে বেসরকারি খাতে দেশের সবচেয়ে বড় বাঁশখালী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ছয় মাস ধরে; তবে সক্ষমতার চেয়ে অর্ধেক উৎপাদন করেই বসে থাকছে চট্টগ্রামের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি।
এ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ নিয়ে যেতে সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত থাকলেও গ্রিড উপকেন্দ্রের পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাবে ‘কম মূল্যের’ এ বিদ্যুৎ পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
তবে আগামী মে মাস নাগাদ এ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ পরিস্থিতি উন্নতির আশার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ- পিজিসিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা এ বি এম বদরুদ্দোজা খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট গ্রিড সাবস্টেশনে একটি ৪০০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফরমার চালু হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
তিনি বলেন, বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট হয়ে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট গ্রিড উপকেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানোর একটি প্রকল্প চলমান আছে। মদুনাঘাটে আগামী মে মাসের মধ্যে একটি এবং সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আরেকটি ৪০০ কেভি ট্রান্সফরমার চালুর চেষ্টা চলছে। এ প্রকল্প শেষ হলে শুধু বাঁশখালী নয়, মাতারবাড়িতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই সঞ্চালন করা সম্ভব হবে।
বর্তমানে মদুনাঘাটে একটি ৪০০ কেভি ট্রান্সফরমার চালু রয়েছে। বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মদুনাঘাটের দিকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে।
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই মদুনাঘাট গ্রিড সাবস্টেশনের দুটি ট্রান্সফরমার স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার কথা জোর দিয়ে বললেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম গাউছ মহীউদ্দিন আহমেদ।
তখন এ কেন্দ্রের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদার যোগান মেটানোর পাশাপাশি তা জাতীয় গ্রিডেও সরবরাহ বাড়াবে।
উপকূলের চেহারা পাল্টাচ্ছে আলোচিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্র
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী গণ্ডামারা এলাকায় লবণ চাষের উপযোগী ৬০৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে দুটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এস. আলম গ্রুপ।
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যৌথভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। সাত বছর পর ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়া শুরু হয়।
জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে নির্মাণকালীন সময়ে বেশ কয়েকবার সেখানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি দল তৈরি হয়। পুলিশ ও এলাকাবাসীর মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন মানুষ হতাহতও হয়।
বেসরকারি খাতে দেশের সবচেয়ে বড় এ বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘুরে দেখেন সাংবাদিকরা। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসএস পাওয়ারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির বলেন, “বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের উস্কানিতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। এসব ঘটনায় হতাহতদের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
“কিন্তু বর্তমানে এই প্রকল্পের সুবাধে আর্থিক ও সামাজিকভাবে উপকৃত হওয়া স্থানীয়দের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখানে জমির দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং রাস্তাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটছে। ফলে ভবিষ্যতে এলাকাবাসীর সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক আরও উন্নত হবে বলেই আমরা আশা করছি।”
কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে এস. আলম গ্রুপের অংশীদারিত্বের পরিমাণ ৭০ শতাংশ এবং বাকি ৩০ শতাংশের মালিকানায় রয়েছে চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচটিজি।
এক নজরে এসএস পাওয়ার
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যৌথভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়।
৬৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি ইউনিটের মধ্যে ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম ইউনিট এবং ২৬ অক্টোবর দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।
>> দেশি-বিদেশি অর্থায়নে দেশের প্রথম বেসরকারি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এটি।
>> এটি পূর্ণ সক্ষমতায় দৈনিক প্রায় ২.৯৩ কোটি ইউনিট ও মাসে প্রায় ৮৮ কোটি ইউনিটের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম।
>> পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে থাকলে এ কেন্দ্রে ঘণ্টায় প্রয়োজন ৫৬৪ টন কয়লা, দৈনিক প্রয়োজন হবে ১১ হাজার ৭৩৫ টন।
>> ধোঁয়া নির্গমণ চিমনির উচ্চতা ২৭৫ মিটার।
>> চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৮ দশমিক ২৫৯ সেন্ট; যা চুক্তিকালীন সময়ে (এক ডলার সমান ৭৮ টাকা হিসাবে) গড়ে ৬ টাকা ৬০ পয়সার কাছাকাছি ছিল।
এসএস পাওয়ারের উপদেষ্টা এএসএম আলমগীর কবির বলেন, ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য ধরে কয়লার দাম বিবেচনায় নিয়ে এ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ পড়ছে ১০ থেকে ১২ টাকার মত। আর এখন ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুতের দর প্রতি ইউনিট ২৫ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে প্রতি ইউনিট ১৫ টাকা। সেই হিসাবে এ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সবচেয়ে সাশ্রয়ী।
এসএস পাওয়ার ওয়ান এর সিএফও এবাদত হোসেন ভুঁইয়া বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে যখন চারিদিকে কর্মহীনতা ও অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তখন টানা ৪ বছর ধরে ৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর আগে প্রকল্প এলাকায় বেকারত্বের হার ছিল ৫০ শতাংশ। এখন তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে বলেই সরকারি জরিপ সংস্থা বিবিএসের ভাষ্য।
তিনি জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫২৭ জনবলের মধ্যে ৫৩ জন চীনের নাগরিক এবং বাকি ৪৭৪ জনই বাংলাদেশি, তাদের বড় একটি অংশ স্থানীয়। এখানে ২৭৪ জন স্থানীয় প্রকৌশলী কর্মরত আছেন।
প্রকল্প এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরবর্তী সাগরে নির্মাণ করা হয়েছে কয়লা আনলোড করার জেটি। জেটি এলাকার দুই পাশে সাগরের ঢেউ নিয়ন্ত্রণে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি কংক্রিটের তৈরি বাঁধ।
জেটির দুটি আনলোডার দিয়ে ঘণ্টায় ২ হাজার টন কয়লা জাহাজ থেকে কোল ইয়ার্ডে নেওয়া যাওয়া সম্ভব। কোল ইয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত দুটি কনভেয়ার বেল্টের সক্ষমতা রয়েছে ৪ হাজার টন।
ছাই সংরক্ষণের জন্য দুটি সাইলো নির্মাণ করা হয়েছে, যার প্রতিটির ধারণক্ষমতা রয়েছে ২ হাজার ৬০০ টন। ৮০ একর এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘অ্যাশপন্ড’। সাইক্লোন কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ‘হেভি ওয়েভ’ প্রাচীর।