আগে সকাল ৮টা পর্যন্ত কেনাবেচা হলেও এখন গভীর রাতের আগেই ক্রেতা কমে যায়। পাইকারি বাজারের চিত্র ওলটপালট হয়ে যাওয়ায় চাহিদা-সরবরাহ নিয়ে উভয় সংকটে ব্যবসায়ী ও কৃষক।
Published : 12 Nov 2023, 12:43 AM
‘‘হরতাল-অবরোধে কাঁচামাল আসা মিছ নাই। রাইতেই ট্র্যাক ঢুকে আড়তে। এসময় তো রাস্তায় কেউ থাকে না। কিন্তু মালের গাড়ি কোনোদিন কম, কোনো দিন বেশি।’’
অবরোধে সবজির সরবরাহের বিষয়ে বলছিলেন যাত্রাবাড়ীর আড়তদার পেয়ার আলী।
এ আড়তের বিভিন্ন ধরনের সবজির পাইকারি বিক্রেতা মেসার্স মোল্লা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মাহবুবুর রহমান বাদল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পণ্য নিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। পুরোটাই অনুমান নির্ভর করে পণ্য আনছেন তারা। যারা আগে আড়তে আসতে পারছেন তারা দাম ভালো পাচ্ছেন। যারা রাতের শেষ ভাগে আসছেন তাদের মধ্যরাতের চেয়ে অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঢাকার খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা তখন কেউ আর আড়তে থাকেন না। যে কারণে পরে যারা পণ্য আনেন তারা ক্রেতা পান কম।
উদাহরণ দিয়ে মাহবুবুর বলেন, শুক্রবার রাত ২টার সময়ে ফুলকপি প্রতি পিস পাইকারি দরে ২২-২৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। ভোরে ক্রেতা না থাকায় তা ৮-১০ টাকায় বিক্রি করতে হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের, যাতে তাদের লোকসান গুনতে হয়। পচনশীল পণ্য হওয়ার মজুত রাখার সুযোগ থাকে না বলে কম দামে ছেড়ে দিতে হয়।
এমন সংকটে শীতের আগাম সবজি উঠতে শুরু করলেও অবরোধের কারণে যত দ্রুত দাম কমার কথা খুচরায় তা হচ্ছে না বলে মনে করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের বিক্রেতারা।
শীতের সবজি পুরোদমে উঠতে শুরু করলেও অবরোধ অব্যাহত থাকলে এর প্রভাব থাকবে বলে মনে করছেন মাহবুবুরের মতো অন্য ব্যবসায়ীরাও।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতকালীন সবজি সিম এখন বিক্রি হচ্ছে কেজি ১২০ টাকায়, মূলা ৫০ টাকায়। গোল বেগুন ৬০ টাকা, টমেটোর দাম এক দিনেই ৪০ টাকা বেড়ে আবার হয়েছে ১৬০ টাকা কেজি।
অন্য সবজির মধ্যে গাজর ১২০ টাকা, পটল ৮০ টাকা কেজি, বরবটি ৮০ টাকা, উচ্ছে ১০০ টাকা, কাঁচামরিচ মান ভেদে ২০০-২৫০ টাকা, পেঁয়াজের দাম এখন ১২০-১৫০ টাকা প্রতি কেজি খুচরা পর্যায়ে।
যাত্রবাড়ী আড়তের সিনথিয়া বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী লাল মোহাম্মদ বলেন, ঢাকার আশপাশের খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা ব্যবসায়ীরা রাতেই কেনাকাটা শেষ করে এমন সময়ে আড়ত থেকে বের হন যেন সূর্য্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এলাকায় পৌঁছে যেতে পারেন। এতে মধ্যরাতে যখন আড়তে পণ্য কম কিন্তু ক্রেতা বেশি থাকে তখন দাম থাকে বেশি। ভোরের দিতে ক্রেতা না থাকায় দাম কমতে থাকে।
অবরোধ ছাড়া অন্য স্বাভাবিক সময়ে আড়তে ও পাইকারি পর্যায়ে সকাল ৮টা পর্যন্ত বেচাবিক্রি হয়। এখন মধ্যরাতের কিছু সময় পরই ক্রেতা কমতে থাকে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। অথচ তখনও অনেক পণ্য আড়তের পথে আসতে থাকে।
এ কারণে অবরোধে কাঁচামাল অন্য সময়ের তুলনায় কম আসছে জানিয়েছে আড়তদার হাফিজুল ইসলাম জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে শুধু মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করছেন তিনি।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বাজারে কতটুকু সবজির চাহিদা আছে তা বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে অবরোধে। এজন্য মিষ্টি কুমড়া তুলছি, কয়েকদিন রেখেও বিক্রি করা যাবে।
পাবনার আড়ত থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী আড়তে শশা, সিম, মূলা নিয়ে আসা ব্যবসায়ী শঙ্কর সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অবরোধ থাকায় আগে রাস্তার অবস্থা বুঝে ৯-১০টার দিকে রওয়ানা দেই। ঢাকায় ঢুকতে দেড়টা দুইটা বেজে যায়। তখন বিক্রি করতে পারি।
এসময়ে ঢুকতে না পারলে বিক্রি সম্ভব হয় না জানিয়ে অবরোধের মধ্যেকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, কোনো দিন লোকসান হলে পরের দিন মাল আনা হয় না। তখন আবার দাম বাড়ে। তাই বোঝা মুশকিল কী হয়।
ঢাকার আশপাশের ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরের এলাকা থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা আসেন যাত্রাবাড়ীর আড়তে। তবে অবরোধের দিনগুলোতে তারা আসছেন কম। যারা আসছেন দ্রুত অল্প কিছু পণ্য নিয়ে চলে যাওয়ায় ট্রিপের সংখ্যাও কমেছে ছোট ছোট ট্র্যাক-পিকআপ চালকদের।
খুচরা ব্যবসায়ীদের সবজি পরিবহনকারী এক টন ওজন পরিবহনের সক্ষমতা সম্পন্ন ছোট ট্র্যাকের চালক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ভোর রাত থেকে বেলা ৮-৯টা পর্যন্ত প্রতিদিন দুইটা ট্রিপ দিতে পারতাম মদনপুর, সাইনবোর্ড বা চিটাগাং এলাকার ব্যবসায়ীদের সবজি পৌঁছে দিতে। এখন একটার বেশি পাই না, অনেক পিক-আপই বসে থাকে।’’
দিনের অন্যান্য সময়ে সাধারণ পণ্য পরিবহন করলেও অবরোধে সে সুযোগও বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার।
ঢাকা জেলা ট্র্যাক ট্যাংকলড়ি কভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘গাড়ির চাপ কিছুটা কম এখন। সব ড্রাইভার বের হতে চায় না। অর্ধেকের মতো বের হয় পেটের টানে। তাই সব মাল ঢাকায় আসে না।”
অবরোধ চলতে থাকলে কৃষক যেমন পণ্যর দাম পাবেন না-তেমনি ট্র্যাক মালিকদেরও আয় কমে যাওয়ার কথা জানালেন আন্তঃজিলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক ও কভাডর্ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জাফর আহম্মদ।
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের গাড়ি চলাচল কমেছে ২০ শতাংশের উপরে। কেউ চালাতে সাহস করছেন না। আবার পণ্য পরিবহনের চাহিদা কমেছে। কৃষি পণ্য পরিবহন যদি কমতে থাকে তাহলে কৃষক ও আমরা দুই পক্ষই ক্ষতির মধ্যে পড়বো।
‘‘তারপরও আমরা গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছি। সরকার আশ্বস্থ করেছে অতীতের মতো ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দিবে।’’