এটিকে দেশের ‘সবচেয়ে বড়’ উৎসে কর ‘ফাঁকি’ বলছে এনবিআর; যা আদায়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলছে সংস্থাটি।
Published : 22 Dec 2024, 12:43 AM
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়া শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে আলোচনায় থাকা সামিট গ্রুপের দুটি কোম্পানির লভ্যাংশ হস্তান্তরের সময় এক হাজার কোটি টাকার বেশি উৎসে কর ’ফাঁকির’ তথ্য ‘উদঘাটন’ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
সাত করবর্ষ ধরে লভ্যাংশ হস্তান্তরের সময় উৎসে কর না কাটায় তা এখন জরিমানাসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকা; যা ’ফাঁকি’ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি সরকারের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটির সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এর।
সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দুটি কোম্পানির কাছ থেকে বড় অঙ্কের এ রাজস্ব আদায়ে এখন পদক্ষেপ নেবে সিআইসি, যেটিকে দেশের ‘সবচেয়ে বড় উৎসে কর ফাঁকি’ হিসেবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন এক কর্মকর্তা।
এ কর আদায় করা হবে কি না কিংবা কীভাবে আদায় করা হবে জানতে চাইলে ঢাকার কর অঞ্চল-২ এর কমিশনার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, “আমরা এখন কালেকশনে যাব।
"এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশনা রয়েছে, আমরা কালেকশনে যাব। কালেকশনের যে পদ্ধতিগুলো রয়েছে, দ্যাট উইল বি অ্যাপ্লাইড।”
সিআইসি করবর্ষ ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত তথ্য অনুসন্ধান ও যাচাই বাছাই করে দেখেছে, সামিট পাওয়ার এটির বিনিয়োগকারী কোম্পানি সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার সময় উৎসে কর কাটেনি।
তবে ঠিকই অন্য কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীদের এসময়ে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ২০ শতাংশ হার উৎসে কর কেটেছে কোম্পানিটি।
একই ঘটনা ঘটেছে সামিট করপোরেশন থেকে সিঙ্গাপুরের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালে লভ্যাংশ দেওয়ার বেলায়। এক্ষেত্রে পাঁচ কর বছরে ১৫ শতাংশ হারে ‘প্রযোজ্য’ উৎসে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি সিআইসি’র।
আগের সরকারের সময়ে সার্কুলার করে সামিট পাওয়ার থেকে সামিট করপোরেশনে এবং সামিট করপোরেশন থেকে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালে শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে উৎসে কর ‘প্রযোজ্য হবে না‘ বলে স্পষ্ট করা হয়েছিল।
ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে থাকার এ সময়ে এনবিআর আগের দেওয়া ‘স্পষ্টীকরণ’ বাতিল করে নতুন করে উৎসে কর প্রযোজ্য হবে বলে ‘স্পষ্টীকরণ’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এনবিআর ও সিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, আগের সরকারের সময়ে বিশেষ সুবিধা দিয়ে উৎসে কর ’ফাঁকি দেওয়ার’ এ ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল।
বড় অঙ্কের উৎসে কর ‘ফাঁকি’র বিষয়ে বক্তব্য জানতে সামিট গ্রুপ ও সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আজিজ খানের হোয়্যাটসঅ্যাপে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। মেসেজে পাঠানো প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
তবে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে দাবি করা হয়, তাদের কোম্পানি কখনও কোনো কর ফাঁকি দেয়নি।
“আমরা এখনো এনবিআর বা কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাইনি।”
আনুষ্ঠানিক চিঠি পাওয়ার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, “তারপর বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যা করা দরকার আমরা তা করব। আমরা সবসময় আইন মেনে চলেছি এবং চলব।”
সামিট গ্রুপের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে তালিকাভুক্ত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আজিজ খান। তিনি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের একজন। সরকার পতনের পর তার এবং তার পরিবারের ১১ জন সদস্যের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশে।
বিভিন্ন তদন্তের অংশ হিসেবে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক কোম্পানিকে তাদের হিসাব অবরুদ্ধ করতে নির্দেশনা দেয়। এ পরিবারের বিরুদ্ধে আর্থিক খাতের এ গোয়েন্দা সংস্থাসহ দেশের বিভিন্ন সংস্থা অনুসন্ধান এখনও চলমান।
‘সুবিধাভোগী’ বড় কোম্পানির ‘অনিয়মের’ খোঁজে এনবিআর
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৫ বছরের বেশি সময় পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব এলে আগের সরকারের সুবিধাভোগী বড় শিল্প গ্রুপের অনিয়মের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামার ঘোষণা দেয় এনবিআর। এর অংশ হিসেবে একক গ্রুপের একটি কোম্পানির তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ তথ্য বেরিয়ে আসার পাওয়ার কথা বলেছেন সিআইসির এক কর্মকর্তা।
শনিবার এনবিআরের গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় টিডিএস (ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স-উৎসে কর) ‘কেলেঙ্কারি’ হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করেন।
দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে সামিট পাওয়ারের সব ধরনের শেয়ারহোল্ডিং, লভ্যাংশ ঘোষণা ও প্রদানের তথ্য-উপাত্ত যাচাই বাছাই করে এ সিদ্ধান্তে এসেছে সিআইসি বলে তুলে ধরেন ওই কর্মকর্তা।
সিআইসি গত ২০ অগাস্ট থেকে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, সামিট, ওরিয়ন ও নাসার চেয়ারম্যান ও নীতি নির্ধারকদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে।
তখন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠিও পাঠানো হয়।
এসব ব্যক্তির নামে কর ফাঁকির পরিমাণ কম থাকার সন্দেহে পরে কার্যক্রম বাড়িয়ে এসব কোম্পানির বিষয়েও অনুসন্ধানে নামে এনবিআরের এ গোয়েন্দা সংস্থা। লোকবল বাড়ানো হয় তখন। প্রতি কোম্পানির বিপরীতে তদন্ত কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়। এ অনুসন্ধান চলার মাঝে এটিই বড় ফাঁকির তথ্য এখন পর্যন্ত।
তবে এখনও অনুসন্ধান চলতে থাকায় প্রতি কোম্পানির বিপরীতে এবং বড় অংশীদারদের আরও দুর্নীতি কিংবা ফাঁকির তথ্য উঠে আসতে পারে বলে ধারণা গোয়েন্দা দলের একাধিক কর্মকর্তার।
‘অনুসন্ধান’ শেষে কী পেল সিআইসি?
দেশের বাজারে তালিকাভুক্ত সামিট পাওয়ার লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৬৭ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৯০ টাকা। কোম্পানিটির অংশীদারত্বে রয়েছে সামিট করপোরেশন, লিমিটেড, ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডসহ আরও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ।
শতাংশের হিসেবে সামিট করপোরেশনের ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্টের ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
আয়কর আইন, ২০২৩ এর ১১৭ ধারায় বাংলাদেশে নিবন্ধিত কোনো কোম্পানির লভ্যাংশ দেওয়ার সময় উৎসে কর কেটে রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে; অর্থাৎ এ অর্থ কেটে সরকারকে দেওয়া বাধ্যবাধকতামূলক।
তবে সিআইসির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামিট পাওয়ার তার বিনিয়োগকারী কোম্পানি সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার সময় উৎসে কর কাটেনি। ঠিকই অন্য কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ২০ শতাংশ হার উৎসে কর কেটেছে।
সামিট পাওয়ার লিমিটেডের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ঘেটে সিআইসি দেখেছে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত সামিট করপোরেশনকে দেওয়া লভ্যাংশের ক্ষেত্রে কোম্পানিটি ৩১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা উৎসে কর কাটেনি।
সিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন জরিমানা বেড়ে ফাঁকির এ পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ কোটি ৭ লাখ টাকা।
একই রকম উৎসে কর না কাটার ঘটনা ঘটে সামিট করপোরেশন থেকে লভ্যাংশ সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালে দেওয়ার ক্ষেত্রে।
তখন এ বিষয়ে সামিট পাওয়ার এনবিআর থেকে আইনের একটি ব্যাখ্যা বা স্পষ্টীকরণ নেয়। সেখানে বলা হয়, সামিট পাওয়ার থেকে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালে লভ্যাংশ প্রেরণে উৎসে কর দিতে হবে না। সুবিধাভোগী কোম্পানি হওয়ায় এ ব্যাখ্যা দেয় এনবিআর ২০২৩ এর শুরুতে।
তবে সামিট পাওয়ার তার সুবিধাভোগী কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালে সরাসরি লভ্যাংশ পাঠাচ্ছে না বরং সামিট করপোরেশন লভ্যাংশ দিচ্ছে সিঙ্গাপুরের এ কোম্পানিকে। এ কারণে এক্ষেত্রে আগের স্পষ্টীকরণের মাধ্যমে উৎসে কর না কাটার সুযোগ নেই বলে এক্ষেত্রেও ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে সিআইসির দাবি।
বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশের উপর ২০ শতাংশের বদলে ১৫ শতাংশ হারে কর কাটার বিধান রয়েছে।
সে অনুযায়ী সিআইসি দেখেছে, সামিট করপোরেশনের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মালিকানায় থাকা সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালে লভ্যাংশ পাঠানোর সময়ে ২০১৮-১৯ করবর্ষ থেকে পরবর্তী পাঁচ কর বছরে তথা ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৪৩৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা উৎসে কর কাটা হয়নি।
জরিমানাসহ ফাঁকির অঙ্ক এখন দাঁড়িয়েছে ৬৪৭ কোটি ৭৩ লাখ কোটি টাকা।
‘ফাঁকি’ নিয়ে এনবিআরের সিদ্ধান্ত
সামিট পাওয়ার লিমিটেড ও সামিট করপোরেশন লিমিটেড এনবিআরের কর অঞ্চল-২ এর অধীন করদাতা কোম্পানি। এগুলোর লভ্যাংশ হস্তান্তরের বেলায় এনবিআরের কর নীতি শাখা থেকে দেওয়া আগের স্পষ্টীকরণ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয়। এ অঞ্চলের অধীন কোম্পানি হওয়ায় কর আদায়ের দায়িত্বও তাদের।
কর অঞ্চল ২ এর অনুরোধের পর এনবিআর আগের দেওয়া স্পষ্টীকরণ বাতিল করে নতুন সিদ্ধান্ত দেয়। এই ‘স্পষ্টীকরণে’ বলা হয়, "সামিট পাওয়ার লিমিটেড কর্তৃক সামিট করপোরেশন লিমিটেডকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে।
“একইসাথে বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের বিদ্যমান দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি মতে সিঙ্গাপুরভিত্তিক অনিবাসী কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লি. এর অনুকূলে বাংলাদেশের কোম্পানি সামিট করপোরেশনর লি. এর লভ্যাংশ প্রদানের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে উৎস কর কর্তন প্রযোজ্য হবে “
এ কর অঞ্চলের কমিশনার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, “স্পষ্টীকরণ যখন ইনভ্যালিড হয়ে যায়, তখন এটার দ্বারা যে সুবিধাগুলো পেয়েছে সেটি থেকে তারা বঞ্চিত হবে। তো আমরা সেভাবে চিন্তা করছি। মূল কথা হচ্ছে, যখন ইনভ্যালিড হয়, আগেরটা সঠিক না, আন ল ফুল। তখন নতুন করে কর প্রযোজ্য হবে।”
সামিটের আজিজ খানসহ পরিবারের ১১ সদস্যের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, এস আলমসহ ৭ কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর স্থগিত
বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, সামিট, ওরিয়ন ও নাসা গ্রুপের মালিকদের বিষয়ে
সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় সামিটের আজিজ খানের নাম
সামিট-আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের দাবি ক্যাবের
বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, সামিট, ওরিয়ন ও নাসা গ্রুপের মালিকদের বিষয়ে অ