“ভারতে পাটের ফেব্রিক হয় ২০০ ধরনের বেশি। অথচ আমাদের পাট দিয়ে মাত্র তিন ক্যাটাগরিতে তৈরি করা ১০ রকমের ফেব্রিক বাজারে পাওয়া যায়।”
Published : 09 Oct 2024, 01:54 AM
পাট উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম আর রপ্তানিতে দ্বিতীয় হলেও সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
দেশে পাটপণ্যের উদ্যোক্তারা বলছেন, পাটপণ্যের মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তি এবং কারিগরি প্রশিক্ষণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার বাড়াতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ২২ বছর আগে। তবে দেশি পাটপণ্যের বিক্রি ও প্রচার বাড়াতে জেডিপিসির বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয় এর অনেক পরে, ২০১৭ সালে। যদিও দুই দশকের অধিক সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের সাফল্য কমই।
রাজধানীর মণিপুরীপাড়া এলাকায় জেডিপিসি অফিসের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে প্রায় ১০ হাজার বর্গফুটের একটি বিক্রয়কেন্দ্র। প্রায় ৫০০ ধরনের পাটপণ্য দিয়ে সাজানো কেন্দ্রটিতে পণ্য বিক্রি ও প্রদর্শন দুটোই হয়।
পেশায় ব্যাংকার সঞ্চিতা দাশ ঘুরে দেখছিলেন জেডিপিসির বিক্রয়কেন্দ্রটি। বললেন, “বিক্রয়কেন্দ্রটি তো অনেক পুরনো কিন্তু প্রচারের অভাবে আগে কখনও নাম শুনিনি।”
পাটের পণ্য সঞ্চিতার বিশেষ শখের বস্তু। কিন্তু এখানে এসে হতাশ হয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনেক পণ্য আছে কিন্তু নতুনত্ব নেই। পাটের জুতা, পোশাক সারাবছর ব্যবহারের উপযোগী করে বানানো হয়নি। তাই শখ করে একটি দুটি পণ্যই কেনা সম্ভব। বিক্রি বাড়াতে হলে ফেব্রিক ও নকশার উন্নয়ন খুবই দরকার।”
দেশে পাটের উৎপাদন থাকলেও পণ্যের বৈশ্বিক মান ও ব্যবহার উপযোগিতার কমতির কথা স্বীকার করেছেন জেডিপিসির পরিচালক¬ (এমআরপি-বাজার গবেষণা ও উন্নয়ন) সীমা বোস অধরা।
তিনি বলেন, “ভারতে পাটের ফেব্রিক হয় ২০০ ধরনের বেশি। ভারতে পাট উৎপাদন হয়। তবু তারা আমাদের এখান থেকে পাট নিয়ে যায়। অথচ আমাদের পাট দিয়ে মাত্র তিন ক্যাটাগরিতে তৈরি করা ১০ রকমের ফেব্রিক বাজারে পাওয়া যায়।
“এত কম প্রকরণ বা বৈচিত্র্যের কারণে দাম কমানো, বৈশ্বিক মান, ব্যবহার উপযোগিতা ও নতুনত্ব কিছুই পাওয়া যায় না দেশীয় পাট পণ্যে।”
প্রচারও দুর্বল
জেডিপিসির ওয়েবসাইটিতে তাদের দায়িত্বের একটি লম্বা তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বহুমুখী পাটপণ্যের প্রচার, প্রসার ও ব্যবহার সহযোগিতা জোরদারকরণ, বহুমুখী পাটপণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে সহযোগিতা, উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, স্থানীয়ভিত্তিক নকশা, নমুনা উন্নয়ন ইত্যাদি। তবে এসব কাজীর ‘গরুর’ মতই, ‘কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’।
তালিকা অনুযায়ী খুব বেশি এগোতে পারেনি জেডিপিসির পণ্য উৎপাদনে কাজ করা উদ্যোক্তারা।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের পাশাপাশি একটি ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলও আছে। তবে তাতে খুব বেশি কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ফেইসবুক পেইজটিতে লাইকের সংখ্যা ১০ হাজার।
অনলাইন ব্যবসায়ী আনিকা জাহান মনে করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার না থাকা ‘অবাক করার মত’ বিষয়। বিক্রয়কেন্দ্রটির অবস্থান নিয়েও আপত্তি আছে তার।
“মণিপুরী পাড়ার মত এলাকায় মাত্র একটি বিক্রয়কেন্দ্র থাকলে প্রচার না থাকাই স্বাভাবিক। কোনো বাণিজ্যিক এলাকায় বিক্রয়কেন্দ্রটির শাখা চালু হলে অনেকেই জেডিপিসি সম্পর্কে জানতে পারবেন।”
পরিচালক সীমা বোস বলেন, “সামনের বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব চ্যানেল, অ্যাপে প্রচার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মণিপুরী পাড়া ও মতিঝিলের সরকারি ভবনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক এলাকায় শাখা চালুর কথা চলছে।”
বাজেট স্বল্পতার বিষয়টি তুলে ধরে এই কর্মকর্তা বলেন, “প্রচারের জন্য বছরে ৬/৭টি একক মেলার আয়োজন করা হয়, যা কয়েক বছর আগেও হত ২০/২৫টি। এছাড়া যৌথভাবে প্রায় ১০টির মত মেলায় অংশ নেয় প্রতিষ্ঠানটি।”
পণ্যের মান বাড়াতে প্রশিক্ষণ আর প্রযুক্তিতে কতটা এগোল
“পণ্যের মান বাড়াতে উদ্যোক্তাদের জন্য সময় উপযোগী প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি, কোনোটিই নেই আমাদের দেশে”, বলছিলেন সীমা বোস।
আরব আমিরাতের বাজারে ভারতের তৈরি পাটের ব্যাগের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যেও বড় আকারের ব্যাগ পাওয়া যায়।
একই ধরনের ব্যাগ বাংলাদেশে তৈরিতে ‘৩৫০ থেকে ৪০০’ টাকা খরচের কথা বলেছেন উৎপাদনকারীরা।
জেডিপিসির সক্রিয় উদ্যোক্তা সদস্য সংখ্যা ৯৮৭ জন। এর মধ্যে বিক্রয়কেন্দ্রে পণ্য সরবরাহ করেন প্রায় ৩০০ জন। সব উদ্যোক্তাই প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি সাইটে (https://www.mygov.bd/) আবেদন করতে পারেন। সেখানে সরকারি যে কোনো বিভাগের তথ্য, প্রশিক্ষণ, ঋণ, নিবন্ধন ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা করা হয়। তবে জেডিপিসিতে আবেদনের স্বতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা নেই।
জেডিপিসির প্রতি প্রশিক্ষণে প্রায় ২৫ জন উদ্যোক্তা এক সঙ্গে অংশ নিতে পারেন। তবে বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ করা হয় ৫ দিনে। এছাড়া মাঝে মধ্যে ১/২ দিনের কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ পেইজে কোনো তথ্য না থাকা নিয়ে সীমা বোস বলেন, “কেন নেই ঠিক বলতে পারব না। আমি কালই দেখছি।”
দুই উদ্যোক্তার অভিযোগ
নুপুর ফ্যাশন ও হ্যান্ডিক্রাফট এর উদ্যোক্তা নুপুর খানম। ২০১৩ সাল থেকেই তিনি পাটপণ্যের ব্যবসা করছেন। পূর্ব বাড্ডায় তার একটি কারখানা রয়েছে। নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষিত ৫০০ ধরনের বেশি পাটপণ্য দেশে বাজারজাত করার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিও করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জেডিপিসিতে ‘কমিশন বাণিজ্য’ হয়, তাই আমি তাদের সঙ্গে কাজ করি না। এছাড়া ডিজাইন নকল হওয়ার আশঙ্কা আছে।
“জেডিপিসির সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই ব্রোকার ও ট্রেডার। সদস্যদের জন্য যে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা হয় তাও নামেমাত্র, অনেকটাই প্রাথমিক পর্যায়ে হাতেখড়ির মত।”
প্রণোদনা নিয়ে এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, “শুনেছি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৩ কোটি টাকার বাজেট হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই চোখে দেখি নাই। উদ্যোক্তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় কাজ করছেন।”
নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া নিয়ে বিডি জেপিএমইএ নামে পাট পণ্য উৎপাদনকারীদের সমিতির সদস্য মেহেদি হাসান বলেন, “ডিজাইন উন্নয়নের ব্যাপারে আলোচনা ও প্রশিক্ষণের চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো কাজই হয়নি।”
জেডিপিসির বিক্রয়কেন্দ্রের কেনাবেচা ও অর্ডার নিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, “বিক্রয়কেন্দ্রে উদ্যোক্তার পণ্যের ৬ শতাংশ জেডিপিসি পাবার কথা বাকিটা উদ্যোক্তার। কিন্তু অর্ডার বিষয়ে উদ্যোক্তাদের কিছুই জানানো হয় না।”
এই উদ্যোক্তার দাবি প্রতিমাসে জেডিপিসির বিক্রয়কেন্দ্রে অর্ডার আসে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার। কিন্তু এসব বিষয়ে জবাবদিহিতা কম।
এই দুই উদ্যোক্তার অভিযোগের বিষয়ে জেডিপিসির পরিচালক সীমা বোস বলেন, “নুপুর খানম নামের এই উদ্যোক্তাকে একবার ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়েছিল। পরে আমি আবার সুপারিশ করে সদস্য করেছি।”
কমিশন বাণিজ্য ও পণ্যের ডিজাইন নকলের অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, “এমন কিছুইও সে প্রমাণ করতে পারবে না। তার কোনো পণ্য জেডিপিসি নেয় না। কারণ, তিনি সঠিক সময়ে সরবরাহ করতে পারেন না।”
মেহেদি হাসানের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “সরকারি অনেক অর্ডার আমরা পাই। তাই ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার অর্ডারের বিষয়টি সত্য। আর জবাবদিহিতা কম এমন নয়। আমরা চাইলেই সব প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে পারি না।”
প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, “নতুন এই উদ্যোক্তাকে আমি ২০ জনের একটি টিমে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছিলাম। তাও কেন তাদের এত অভিযোগ।”
কমেছে রপ্তানি
পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিকল্প সোনালী ব্যাগ, পাট পাতার চা, পাটের তৈরি টিন ‘জুটিন’, ১৭টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে, যার কোনটিই তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।
বাজারে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে ও পাটজাত পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ২০২৩ সালে পাটকে কৃষি পণ্য হিসেবেও গণ্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে এতে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি বরং দেশের বাজারে পাটের ব্যবহার ও রপ্তানি আয় দুটোতেই ভাটা দেখা যায়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯১ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৭৮ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম।
রপ্তানি কমার কারণ নিয়ে প্রশ্নে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে আমি সঠিক তথ্য দিতে পারব না।”
পাট পাতার চা, জুটিন, সোনালী ব্যাগ ও পাটজাত মোড়কের উদ্যোগ কতদূর
দেশের বাজারে পাট পাতার চা খুব বেশি প্রচলিত না হলেও ২০১৯ সালে পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের সহযোগিতায় ও উদ্যোগে এই ভেষজ চা জার্মানিতে রপ্তানি করা শুরু হয়েছিল।
দেশটির একটি স্টার্টআপ কোম্পানি ‘ইন্টারট্রোপ’ পাট পাতার চা কিনেছিল।
সচিব আব্দুর রউফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারীর পর প্রকল্প বন্ধ হয়। পরে যোগাযোগ করে ও নানা ধরনের পরীক্ষার ফলাফল পাঠিয়েও লাভ হয়নি। অনেক তৈরি করা পাট পাতার চা আটকা ছিল কিন্তু তারা আর নিল না।”
সাধারণ টিনের থেকে পাট থেকে তৈরি জুটিন মজবুত হলেও দামের কারণে এটির টিকে থাকা কঠিন বলে মনে করেন সচিব। বলেন, “ক্রেতারা কম দামের প্রতিই বেশি ঝুঁকবে। তাই এই পণ্যের দাম সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা উদ্যোক্তাদের করতে হবে।”
বহু বছর ধরে আলোচনায় থাকা সোনালী ব্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে অনুমতি পেলেই পাইলটিং চালু হবে।”
বর্তমান যে সোনালী ব্যাগ দেখা যাচ্ছে তা ল্যাবে উৎপাদিত বলে জানান তিনি।
পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩ অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টাসহ ১৯টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু সেটিও কার্যকর হয়নি।
সবিচ আব্দুর রউফ বলেন, “এসব বিষয়ে আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হয়। এই সরকার কঠিন নির্দেশনা দিয়েছে, তাই পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারে অভিযানের সময় মোড়কীকরণের বিষয়টিও দেখা হবে।”