পোশাকের দাম বাড়তি মনে হওয়ায় কেউ কেউ অর্ধেক কেনাকাটা করেছেন, কেউ এখনো দামদর জানার মধ্যেই আছেন।
Published : 30 Mar 2024, 12:27 AM
সন্তানদের জন্য ঈদের পোশাক কিনতে দেশের জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ডের দোকানে ঘুরেছেন আব্দুল বাশার। ঘণ্টাখানেক ধরে হাতড়েও বাজেটের নাগালে কোনো পোশাক না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন বেসরকারি এই চাকুরে।
বাশারের ধারণা, যা বেতন পান, তার প্রায় দ্বিগুণ খরচ হবে রোজার মাসে। আর ঈদ পোশাকের যে দাম দেখছেন, তাতে ৫০ হাজার টাকাতেও কুলাবে না বলে মনে করেন তিনি।
১৫ রোজার আগেই কেনাকাটা সেরে ফেলা গৃহিনী আয়শা রহমানের কাছে এবার পোশাকের দাম গতবারের তুলনায় কিছুটা বেশি মনে হয়েছে।
“গত বছরের তুলনায় ঈদ পোশাকের দাম কিছুটা বেশি। তবে অনেক ঘুরে ঘুরে বাজেটের মধ্যে কিনতে পেরেছি। যদিও দামের তুলনায় পোশাকের মান ও নকশা দুটোই কম মনে হয়েছে।”
বাজেটের সঙ্গে পোশাকের দাম মিলছে না, মার্কেটে এমন ক্রেতাই এবার বেশি। পোশাকের দাম বাড়তি মনে হওয়ায় কেউ কেউ অর্ধেক কেনাকাটা করেছেন, কেউ এখনো দামদর জানার মধ্যেই আছেন।
পোশাকের দাম গতবছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে, তা বিক্রেতাদের কথাতেও পরিষ্কার। নামিদামি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের ও বুটিক হাউজের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তাও জানিয়েছেন একই কথা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছরই দাম বাড়ছে কাপড়, রঙ, সুতা থেকে শুরু করে সব ধরনের উপকরণের। একই সঙ্গে পোশাক তৈরির শ্রমিকদের মজুরি ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে ঈদে পোশাকের দামে। তবে কেউ কেউ বলছেন ঈদ পোশাকের দাম ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
ফ্যাশন হাউস কে ক্র্যাফটের প্রধান নির্বাহী খালিদ মাহমুদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডলারের দাম, বিদ্যুতের দাম, কাপড় তৈরির খরচ, মজুরি ও দোকানের ভাড়া ও খরচ সবই গতবছরের তুলনায় বেড়েছে। ফলে এ বছর সবমিলিয়ে পোশাক তৈরিতে ৭ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেড়েছে।”
তবে অন্যান্য পণ্যের মতো পোশাকের দাম যেন ক্রেতাদের নাগালের বাইরে না যায় এজন্য কিছু উদ্যোগের কথা জানিয়েছে খালিদ।
“পোশাকের দাম অতিরিক্ত বাড়লে কমবে ক্রেতা সংখ্যা, যা উদ্যোক্তাদের জন্য লাভজনক নয়। তাই উপকরণসহ অন্যান্য খরচ বাড়লেও পোশাকে মিনিমাল নকশা বা অলংকরণ ও কাটিংয়ে সৃজনশীলতা পরিবর্তন করে দাম সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।”
প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশিয় ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছে নিপুণ ক্রাফটস লিমিটেড।
পোশাকের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুর রহমান ফারুখ বলেন, “পোশাক উৎপাদনের প্রতিটি ধাপেই খরচ বেড়েছে। এ বছর পোশাক তৈরির মোট খরচ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।”
উৎপাদন খরচ বাড়লেও পোশাকের দাম অনেক বেশি বাড়ানো হয়নি দাবি করে এই ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ বলেন, “নিত্যপ্রয়োজনী অন্যান্য পণ্য ও ফ্যাশন পণ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এক্সক্লুসিভ রাখার জন্য ব্র্যান্ডগুলো অল্প অল্প পণ্য উৎপাদন করে। তাই বেশি দাম রাখলে ক্রেতারা অন্য ব্র্যান্ডের এক্সক্লুসিভ পোশাকে মনোযোগী হবে। ঈদ বাজারেও ক্রেতারা যেন তাদের বাজেটে পোশাক পায় তেমন করেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।”
যদিও দাম ও পোশাকের মান ক্রেতাদের অভিযোগ করতে দেখা গেছে। অনেকেরই পোশাক পছন্দ হলে দাম বেশি মনে হচ্ছে। আবার দাম ঠিকঠাক মনে হলে পোশাকের মান খচখচানি থেকেই যাচ্ছে।
গৃহিনী ফারজানা আক্তার অনেক ঘুরে নিজের বাজেটের মধ্যে পোশাক কিনেছেন একটি জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড থেকে। কিন্তু দামের তুলনায় নকশা, কাপড়ের মান পছন্দ না হওয়ায় পোশাকটি পরিবর্তন করে বাজেটের বাইরে গিয়ে নতুন পোশাক কেনেন।
“প্রায় সব দোকানেই দেখেছি খুব হালকা নকশার জামাগুলোর দাম ৩/৪ হাজার টাকার বেশি। রমজানের আগেও এ ধরনের কুর্তি, ওয়ান পিসগুলো অর্ধেক দামে পাওয়া গেছে। ঈদের জন্য ডিজাইন করা জামাগুলোর গলা ও হাতায় চিকন কাজ করা। দামের সঙ্গে তুলনা করলে এই পোশাক পছন্দ হয় না।”
ধানমন্ডির রাপা প্লাজার এক দোকানি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, সবকিছুর দাম বেশি তাই পোশাকের দামও এবার বেড়েছে। আর কম বাজেটের চিন্তায় যে পোশাক তৈরি করা হয়েছে, তার নকশা ও কাপড়ের মানে কমতি তো থাকবেই।
পোশাকের দাম বাড়ার পেছনে কাপড়ের বাড়তি মূল্য, বিদ্যুৎ, অন্যান্য উপকরণ, কাঁচামালের দাম বাড়া, আন্তর্জাতিক প্রতিকূল পরিস্থিত ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিকে কারণ মনে করেন ফ্যাশন ব্র্যান্ড টুয়েলভ ক্লদিং লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও পরিচালক মতিউর রহমান।
তার মতে, পোশাক তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়ের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের মজুরিসহ আরো ২০ শতাংশ বাড়তি খরচের হিসাব দিয়ে মতিউর রহমান বলেন, “দাম বাড়াকে সমস্যা নয় বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি এবং মোকাবেলার চেষ্টা করছি। এছাড়া করোনাপরবর্তী ধাক্কাও আমরা এখনো সামলে উঠতে পারিনি।”
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নিয়ে তিনি বলেন, “এত নামিদামি ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পোশাকের দাম কমিয়ে, মান ঠিক রেখে টিকে থাকা কঠিন। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের তুলনায় আমাদের দেশি ব্র্যান্ডের পোশাকের দাম প্রায় অর্ধেক।”
তৈরি পোশাকের পাশাপাশি দামের বাড়াবাড়ি সব ধরনের গজকাপড়ের দোকানেও দেখা গেছে। নিউমার্কেট ও চাঁদনীচকের দোকান ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের দাম বাড়ার সত্যতা জানা যায়।
ক্রেতারা জানান, সুতি, বিদেশি ও সিনথেটিক কাপড়ের দাম গজ প্রতি প্রায় ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
দোকানিরা জানিয়েছেন, ঈদ উপলক্ষ্যে সুতি কাতান প্রতি গজ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর সিনথেটিক কাতানের দাম পড়ছে ৩৫০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। ক্রেতারা নকশা করা জর্জেট কাপড় কিনছেন ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা গজে। সুতির টাইডাই ও বাটিক কাপড় কিনতে খরচ করতে হবে গজ প্রতি ৯০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।