আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে কর ছাড় দাঁড়াবে ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। কর ভর্তুকি হিসাব করলে তা ঘাটতির চেয়ে বেশি।
Published : 12 Jun 2024, 01:50 AM
কর ছাড় তুলে দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের শর্ত সরকার মেনে নিলেও সেভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি; আগের ধারাবাহিকতায় এবারও বিপুল ছাড়ের সুযোগ থাকছে।
অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন সেটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বছরের পর বছর দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি কর ছাড় দিয়ে আসছে। যদিও কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন হচ্ছে না। অথচ বাজেট ঘাটতি ছাড়িয়ে গেছে আড়াই লাখ কোটি টাকা।
সরকারের ব্যয় মেটাতে এমন টানাটানির মধ্যে চলতি অর্থবছর শেষে ‘কর ছাড়’ দেড় লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে বলে বাজেট বক্তব্যে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-২৪ এর তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে কর ছাড় এক লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা হবে। এর সঙ্গে কর ভর্তুকির পরিমাণ যোগ করলে তা দাঁড়াবে দুই লাখ ৮৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর ছাড় দাঁড়াবে ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। কর ভর্তুকি হিসাব করলে তা বাজেট ঘাটতির চেয়েও বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর পাশাপাশি এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে সুবিধা দিয়ে আসা খাতগুলো থেকে ধীরে ধীরে ছাড় প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
তাদের ভাষ্য, ছাড় দেওয়ার কারণে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। সেই ঘাটতি পূরণে সরকারকে আবার ঋণ করতে হচ্ছে। বেশি বেশি ব্যাংক ঋণের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ চাপে পড়ছে; ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কমছে। রাজস্ব আদায়ে তা প্রভাব রাখছে। পাশাপাশি সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে পরের বাজেট বিপুল চাপে পড়ছে।
সংসদে বৃহস্পতিবার (৬ জুন) আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে ফর্দ দিয়েছেন, সেখানে দেশীয় উৎস থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে বিদেশি অনুদান যোগ করে ঘাটতির সম্ভাব্য হিসাব করা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা।
কর ছাড়ে লাগাম টানার লক্ষ্য
বিশ্বের যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। এখন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর আহরণ মাত্র ৮ শতাংশের মত। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরামর্শ দীর্ঘদিনের। কর আদায় কম হওয়ায় বাংলাদেশ উচ্চ হারে শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করে। এটি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে বলে মত দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা।
তাদের মতে, বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণে কর্মসংস্থান হয় না, আবার পরোক্ষভাবে এটিও কর আদায় কম হওয়ার আরেক কারণ।
এমন প্রেক্ষাপটে রাজস্ব বাড়াতে বিভিন্ন পর্যায়ে কর ছাড় কমিয়ে আনার বিষয়ে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, ‘‘অদূর ভবিষ্যতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত/অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত পরিপালন ইত্যাদি বিবেচনায় আমদানি পর্যায় থেকে আহরিত শুল্ক-করের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর খাত হবে সরকারের অর্থ সংস্থানের মূল উৎস।’’
পাশাপাশি ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট দেশে পৌঁছাতে চায় সরকার। এজন্য কর-জিডিপি অনুপাত না বাড়ানোর বিকল্প নেই। যে কারণে বাজেট ঘাটতি কমানো ও রাজস্ব সংগ্রহে প্রত্যক্ষ কর ছাড় কমিয়ে আনতে শুরু করেছে সরকার।
অন্যদিকে ব্যক্তি খাতে আয়কর সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
কর ছাড় কী
‘করছাড়’কে ‘কর ব্যয়’ বলছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ এর প্রতিবেদনে ‘প্রত্যক্ষ কর ব্যয়’ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “প্রত্যক্ষ কর ব্যয় বলতে রেয়াত, ছাড়, অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে করারোপ এবং মোট করযোগ্য আয় পরিগণনা হতে আয় বাদ দেওয়াকে বোঝায় এবং মোট করযোগ্য আয় পরিগণনা হতে বাদ দেওয়াকে বোঝায়।
“এটি এক ধরনের কর ভর্তুকি। অর্থাৎ এই ভর্তুকি যদি কর হিসেবে আহরিত হত, তাহলে মোট আহরিত করের সঙ্গে এটি যুক্ত হত এবং করের পরিমাণ বৃদ্ধি হত।’’
বছরে কত টাকা ছাড়
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে এটির একটি ধারণা মিলেছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ছাড় ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে তা দাঁড়ায় এক লাখ ১৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে কতটুকু ছাড় দেওয়া হয়েছে সেটির একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ওই অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ৫৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা ছাড় পেয়েছেন চাকরিজীবীরা।
প্রত্যক্ষ কর ব্যয় প্রতিবেদন তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া এনবিআরের সাবেক সদস্য শামস উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘সরকারি ও বেসরকারি খাতের কর্মজীবীদের পুরো বেতনের উপর কর নেওয়া হয় না। যদি নেওয়া হত, তাহলে করের পরিমাণ বেড়ে যেত।”
বাংলাদেশে করমুক্ত আয়ের সীমা বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এর বাইরে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ অথবা মাসে ২৫ হাজার টাকা হিসেবে বছরে আরও তিন লাখ এর মধ্যে যেটা কম; সরকারি চাকরিজীবীদের সর্বোচ্চ মাসে সাড়ে ২৮ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া; মূল বেতনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ অথবা বছরে ৬০ হাজার টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং মাসে ৩ হাজার টাকা করে বছরে ৩৬ হাজার টাকা পরিবহন ভাতা ছাড় দিয়ে থাকে সরকার।
এ হিসাবে চাকরিজীবীদের সর্বোচ্চ ৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়।
এর বাইরে নগদ রপ্তানি সহায়তায় ২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা, শিক্ষায় ২৮৪ কোটি টাকা, লভ্যাংশ খাতে ২ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা, আইটি ও সফটওয়্যার খাতে ১ হাজার কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে ওই অর্থবছরে।
এছাড়া পোলট্রি ও মৎস্য চাষে ২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা, পোশাক ও বস্ত্র খাতে ৪ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ৪ হাজার ২২ কোটি টাকা, জ্বালানি ও খনিজ খাতে ৭ হাজার ৬১১ কোটি টাকা, রেমিটেন্সে ১১ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ঋণে ১১ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা, শেয়ার হতে মূলধনি আয়ে ১২ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে মূলধনি মুনাফার ওপর ছাড় কিছুটা তুলে নেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি খাতে ৫০ লাখ টাকা মুনাফা হলে ১৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ হিসাবে কত টাকা আসবে, সেটি এখনই বলা সম্ভব নয়।
এনবিআরের সাবেক সদস্য শামস উদ্দিন বলেন, “সরকারি কর্মকর্তাদের ভাতা, বিমান ভাড়া ও আনুতোষিক কর মুক্ত রাখা হয়েছে। কয়েকটি খাত ও শিল্পেও আছে ট্যাক্স হলিডে, কোনো করই নেওয়া হয় না তাদের থেকে। নতুন খাতকে বড় করতে বা বিশেষ কোনো সুবিধা দিতে এই ট্যাক্স হলি ডে দেওয়া হয়।’’
বিদ্যমান কর কাঠামো থেকে ছাড় দেওয়া কর ও সম্ভাব্য আদায় হওয়া কর, এ দুটো মিলিয়েই তিনি প্রত্যক্ষ কর ব্যয় প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বলে জানিয়েছেন।
সব ছাড় বাদ দেওয়া ‘উচিত হবে না’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান সব ছাড় পুরোপুরি তুলে দেওয়ার বিপক্ষে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশেই করমুক্ত আয় সীমা রয়েছে। আবার রেমিটেন্সেও কেন কর হবে? তাদের আয় তো এদেশে হচ্ছে না, বিদেশে তো তারা কর দিচ্ছেন।”
তাহলে সরকারের আয় বাড়বে কীভাবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ব্যক্তি পর্যায়ের কর ছাড়ের তুলনায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কয়েকটি খাত বছরের পর বছর ছাড় পেয়ে আসছে। তা ধীরে ধীরে তুলে নিতে হবে, এর পরিমাণই বেশি।’’
তৈরি পোশাক খাত, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কৃষি খাতে নাম লিখিয়ে করপোরেট কোম্পানি ও রপ্তানি খাতের সবচেয়ে বেশি কর ছাড় পাওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘কৃষককে সুবিধা দিতে কৃষি খাতকে করমুক্ত রাখা হয়েছিল। একজন প্রান্তিক কৃষক খুব বেশি আয় করতে পারেন না। এখন করপোরেট প্রতিষ্ঠান কৃষিতে বিনিয়োগ করে সেই সুবিধা নিচ্ছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য তো কর ছাড় সুবিধা দেওয়ার কথা না, এটি তুলে নিতে হবে।’’
তবে হুট করে কিছু করা উচিত না মত দিয়ে তিনি বলেন, “বাজেটে একটি দিক নির্দেশনা থাকতে হবে। হুট করে তো চালু থাকা ছাড় বন্ধ করা যায় না। তাহলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে পরিকল্পনা সাজাবেন। তাদের তো আগেই জানাতে হবে, কবে থেকে কতটা ছাড় তোলা হবে।”
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের অবস্থান আবার ভিন্ন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘সব দেশেই পুরো আয়ের উপর কর দিতে হয়। বেতন, বাড়ি ভাড়া, প্রণোদনা, ভাতা ও সম্পদ সবই করের আওতায়।
“ধাপে ধাপে কর ছাড় তুলতে হবে আগে শিল্প খাত থেকে। কর আদায় বেশি হলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, তখন বাজেট ঘাটতি পূরণে ঋণ নেওয়া লাগবে না।’’
ঘাটতি বাজেটে ঋণ ও তার সুদের দায় জনগণকেই বহন করতে হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। এই বর্ধিত মূল্যস্ফীতিও এক ধরনের কর, যা জনগণ পরিশোধ করছে।”
পুরো আয়ের ওপর কর নিলে জনগণের কষ্ট হবে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “কর ছাড় বন্ধ হলে মোটা দাগে জনগণের লাভ ও লোকসান কোনোটিই হবে না। মূল্যস্ফীতি এত হবে না। জনগণ সরকারকে প্রশ্ন করতে পারবে, করের টাকা কোথায় খরচ করছে। এতে সরকারের জবাবদিহিতা বাড়বে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
“এখন কাউকে বেশি কাউকে কম ছাড় দিচ্ছে, এতে বৈষম্য তৈরি হয়, দুর্নীতির সুযোগ থাকে। আমাদের প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার দিকেই যেতে হবে।’’
আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হয় না এনবিআরের
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল সরকার। বিপুল এ অর্থ আদায় করা সম্ভব হবে না বুঝে পরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। অর্থবছরের ১০ মাসে আদায়ের যে ধারা, তাতে গত অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পরও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে না।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম গত ১৯ মে রাজধানীতে এক সেমিনারে বলেন, “প্রতিবছরই এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা বেশি দেওয়া হয়, যা আদায় করা সম্ভব হয় না। কর আদায়ে ডিজিটাইজেশন ও অটোমোশন বাড়াতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ করলে ২২ পয়সার বিপরীতে ১০০ টাকা কর আদায় বাড়তে পারে।’’
ছাড় বন্ধ ও যৌক্তিকীকরণের তাগিদ
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘ট্যাক্স লিকেজ বন্ধ করার কথা আইএমএফ বলেছে তাদের ঋণ শর্তে। তারা বলেছে, কর ব্যয় কমাতে। এটা আসলে কর ছাড়।
‘‘মানে হল এনবিআর যে কর পাওয়ার কথা ছিল তা আদায় না করে ছাড় দিচ্ছে। সরকার একদিকে বলছে, রাজস্ব বাড়াতে আবার করছাড় সুবিধা অব্যাহত রেখেছে। করছাড় দিলে এখানে দুর্নীতির সুযোগ থেকে যায়। কারণ, কে কত ছাড় পাবে তা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হচ্ছে।’’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘‘যারা ফাঁকি দেয়, তাদের ধরতে হবে। করছাড় বন্ধ করতে হবে, এখানে যৌক্তিকীকরণ লাগবে।’’
ক্ষমতা এনবিআর থেকে সংসদে নেওয়ার তাগিদ
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি আইএমএফ এর কাছ থেকে পায় বাংলাদেশ। এ ঋণ কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে ও পরে আর্থিক খাতে নানা ধরনের সংস্কার করা হচ্ছে। প্রথম কিস্তির অর্থ ব্যবহার দেখে ঋণ শর্তে থাকা সংস্কারের বিষয়গুলো প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণ কর্মসূচিতে থাকতে বাংলাদেশকে দেওয়া আর্থিক খাতের নানামুখী সংস্কারের শর্তগুলো দুই শ্রেণিতে মূল্যায়ন করা হবে। একটি হচ্ছে আর্থিক খাতের কাঠামোগত সংস্কার ও অন্যটি সময়ে সময়ে বিভিন্ন সূচকের বিপরীতে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার অর্জন।
কাঠামোগত সংস্কারের প্রায় সবগুলোতে অগ্রগতি হলেও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব খাতে তা আশাব্যঞ্জক নয় এখনও। প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতেও বাধা ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ।
রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিষয়ে সংস্থাটি বলেছে, সব পর্যায়ে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং শুল্ক খাতে করছাড় পর্যায়ক্রমে শূন্যে নামিয়ে আনা।
দ্বিতীয় কিস্তির ব্যবহার দেখে সংস্থাটি করছাড় বা কর ব্যয় ক্ষমতা এনবিআরের কাছ থেকে সংসদের কাছে নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
এমন প্রস্তাবের যুক্তির বিষয়ে জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘জনগণ তো কর দিচ্ছে। সেখানে বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে কর ছাড় দিলে তা জানার অধিকার তো জনগণের রয়েছে। সংসদের কাছে ক্ষমতাটা গেলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।’’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ঢালাওভাবে করছাড় দেওয়া চলতে থাকলে দুর্নীতির জন্ম হয়। ‘কর ছাড় ছোটরা পায় না, বড়রাই নিয়ে যায়।
আমদানি শুল্ক কমাতে হবে
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী আমদানি পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক হার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে করতে হবে বাংলাদেশকে।
এতে আমদানি করা পণ্যের উপর খুব বেশি শুল্ক বসাতে পারবে না সরকার। বর্তমানে দেশি পণ্যের সুরক্ষা দিতে গাড়িসহ অনেক পণ্য আমদানিতে বাড়তি কর নিচ্ছে বাংলাদেশ।
তা তুলে দেওয়ার চাপ রয়েছে আইএমএফ এর পক্ষ থেকেও। সেই চাপে চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরেও আমদানি পর্যায়ে ১০টি খাতের পণ্যে ন্যূনতম মূল্য প্রত্যাহার, পাঁচটিতে ন্যূনতম মূল্য যৌক্তিকীকরণ ও তিনটিতে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
রেগুলেটরি ও সম্পূরক শুল্ক পর্যায়ক্রমে তুলে দিতে আগামী অর্থবছরে শুল্ক কর কমানোর প্রস্তাবে বলা হয়, বিলাসী নয় এমন পণ্য, যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় না, যে পণ্য আমদানি করলে রিজার্ভের উপর চাপ পড়বে না, এমন পণ্য আমদানি করা যা দেশীয় পণ্যের বাজার প্রভাবিত করবে না।
দেশি শিল্পে কর ছাড় কমিয়ে আনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেন, ‘‘দেশীয় শিল্পের জন্য বিদ্যমান নীতি সহায়তা যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও নতুন সম্ভাবনাময় উৎপাদনমুখী খাতের বিকাশে সহায়তা করা।
‘‘ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার তথা সকল পর্যায়ে কর অব্যাহতি সুবিধা ভোগ করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা।’’
ঘাটতির বাজেটে ১৭% আসবে ব্যাংক ঋণ থেকে