সংসদে প্রথম বাজেট উপস্থাপনের পরদিন রীতি মেনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে টক-ঝাল-মিষ্টি কথায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
Published : 08 Jun 2024, 01:32 AM
সমালোচনা উড়িয়ে দিলেন আশ্বাস, মেজাজ হারিয়ে কথাও শোনালেন সাংবাদিকদের; এরমধ্যেই ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির নাভিশ্বাস থেকে মুক্তির আশা দেখালেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিশাল ব্যাংক ঋণ নিয়েও ‘ভয়ের কিছু নেই’ বলে আশ্বাসের বাণী শোনালেন তিনি; সঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন সংকোচনের মধ্যে প্রবৃদ্ধির ধারা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার কথা।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনার বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা এসেছে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছ থেকে।
শুক্রবার দুপুরে অর্থমন্ত্রীর এই বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই মূল্যস্ফীতি এবং তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য নিয়েই প্রশ্ন হল বেশি।
জবাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল আরও কিছুদিন চালু রাখার কথা বললেন অশীতিপর অর্থমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে বাজেটে রাজস্ব খাতের বিভিন্ন সংস্কার, খরচে সংকোচন, সামাজিক সুরক্ষার আকার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কিছু কৌশলের কথাও তিনি তুলে ধরেন। তার সঙ্গে থাকা বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুও এ নিয়ে সরকারের নীতি-পরিকল্পনার কথা বলেন।
মূল্যস্ফীতির ধাক্কা কাটিয়ে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন নিয়েও অর্থমন্ত্রী কথা বললেন আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে।
তবে আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানা অনিয়ম রোধে সুস্পষ্ট পথনকশা সংবাদ সম্মেলনেও হাজির করতে পারেননি সরকারের মন্ত্রীরা। উল্টো কালো টাকা সাদা করার পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গাইলেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন মাহমুদ আলী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তার প্রথম বাজেট।
প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য দেশি উৎস থেকে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব যোগান দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বাজেটে বলেছেন তিনি। তাতে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৬ শতাংশের সমান। ঘাটতি মেটাতে শুধু ব্যাংক থেকেই ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
রিজার্ভে টান আর বিশ্ববাজারের অস্থিরতাকে সঙ্গী করে সরকার যখন আইএমএফ এর ঋণের শর্ত মেনে ভর্তুকি তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, সেই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী।
দুই বছরে ধরে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে থাকার প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী নিজের পরিকল্পনায় ঠিক থাকতে পারবেন কি-না, সেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
রেওয়াজ অনুযায়ী বাজেটের পরের দিন শুক্রবার বিকালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মাহমুদ আলী। বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সচিবরাও ছিলেন তার সঙ্গে।
শুরুতেই অর্থমন্ত্রীকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কীভাবে সম্ভব হবে সেই প্রশ্ন করা হয়। অন্যবার স্বল্পভাষায় উত্তর দিলেও এবার কিছুটা খোলা মনে উত্তর তুলে ধরেন তিনি।
লক্ষ্য অর্জনে সফল হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা পর্যালোচনা করছি।
“আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে রাখা সম্ভব হয়েছে। গতকাল উপস্থাপিত বাজেট বক্তৃতায় মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির আওতায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করেছি।”
আগামী ছয় মাসের মধ্যেই এর ফল দেখার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, এ বছরের শেষের দিকে (মূল্যস্ফীতি) কমতে শুরু করবে। দেখা যাক, চেষ্টাতো করতে হবে। এবং আপনারা এটাও লক্ষ্য করেছেন, বাজেটের আকার আমরা অনেক কমিয়ে রেখেছি, যাতে করে কোনো প্রেশার না পড়ে প্রাইসের উপরে।
“মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেহেতু এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার সেহেতু সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল আরও কিছুদিন চলমান থাকবে। আমাদের কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাত যেন তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় সব সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এর ফলে সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ স্বত্বেও চলতি অর্থবছরে ৫.৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আমরা ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবে।”
কোভিড-১৯ মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি মূল্যস্ফীতির পারদ কেন চড়েছে সেই ব্যাখ্যাও সংবাদ সম্মেলনে দেন।
অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ: ‘শুধু ওইটা রিপিট করলে হবে না’
এই বাজেট সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে না বলে সিপিডি মনে করছে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “তারল্য সংকট থাকছে না। সবকিছু আবার চালু হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে অতিমারীর সময়ে, তারপরে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর যে সংকটগুলো ছিল, সেগুলো কিন্তু কমে এসেছে।
”কাজেই একটা ধরে রেখে ওইটা শুধু যদি রিপিট করেন, তাহলে কিন্তু হবে না। কারণ আমরা এসব সংকট পার হয়ে এসেছি।”
দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “আমরা তো দেখেছি যে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ, শ্রীলঙ্কার যে অবস্থা হয়েছিল, একেবারে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। আমরা শুনেছি, কেউ কেউ বলেছে, বাংলাদেশ শ্রীলংকা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হয়নি তো।
”কাজেই এটি একটি কনটিনিউয়াস ও ডায়নামিক মডেলের মধ্যে আমরা কাজ করছি। এই জিনিসটা মাথায় রাখতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে নিজে যেমন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, কয়েকজন মন্ত্রী এবং সচিবদের তাদের সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, এবারের বাজেটে সুনীল অর্থনীতি সংক্রান্ত গবেষণা ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান।
এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
মূল্যস্ফীতি: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর ব্যাখ্যা
সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে বাজেটে কী কৌশল নেওয়া হয়েছে? এর উত্তর দেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
টিটু বলেন, বাজেটে নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। ধান, চাল, গম, ছোলা, মসুর ডালসহ অন্যান্য কিছু নিত্যপণ্যে বিদ্যমান ২ শতাংশ কর কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দাম কমাতে সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা এখন টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবারকে ভর্তুকিতে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছি। আগামীতে এর আকার বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব তৈরি করছি।”
বাজেটে নিত্যপণের দাম বাড়ানোর মত কোনো ঘোষণা নেই দাবি করে তিনি বলেন, উল্টো কমার মত ঘোষণা আছে। কয়েকটি পণ্যের উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। গুঁড়ো দুধের আমদানিতে কর যৌক্তিক করা হয়েছে। সময়ে সময়ে পণ্যের কর কমিয়ে আনা হবে।
“১০টি পণ্যের ওপর আরোপিত ন্যূনতম ভ্যালু প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১০টি পণ্যের শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। ১৯টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৭২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। অন্যান্য শুল্ক যেগুলো আছে, সেগুলো এনবিআর যথাযথ সময়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসবে।”
ব্যাংক ঋণ নিয়ে ‘চিন্তার কারণ নেই’
বরাবরের মত এবারও সরকারকে বাজেটের বিশাল ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদেশি কম সুদের ঋণের পরিবর্তে দেশি ব্যাংকের দিকেই আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে।
বাজেটে অর্থের যোগানের ক্ষেত্রে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে পাওয়ার আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। অবশ্য ঘাটতির এ পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪.৬ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার মত ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন মাহমুদ আলী।
ব্যাংক থেকে এত ঋণ সরকার নিয়ে নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যাংকের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না এমন প্রশ্ন ছিল অর্থমন্ত্রীর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া, এটা তো একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিওর। এটা সব বাজেটে সব অর্থমন্ত্রীরাই করেন, সরকারই করেন এবং উন্নত দেশে এর পরিমাণ অনেক বেশি। আমরা তো এবার ৫ শতাংশের মধ্যে এটাকে ধরে রেখেছি। কাজেই এটা এতকিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। তো, এটা নিয়ে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নাই।”
তারল্য সংকট ও চলতি হিসাবে ঘাটতির মধ্যে ব্যাংক ঋণ প্রভাব বিষয়ক প্রশ্নে অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “এই বাজেট ঘাটতির সঙ্গে ব্যাংকের তারল্য সংকট বা ঘাটতির কোনো সম্পর্ক নাই। সবসময় আমরা বিদেশি ঋণের ওপর প্রায়োরিটি দিই। কিন্তু এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদেরকে ক্রমবর্ধমান হারে অভ্যন্তরীণ ঋণের ফোকাস করতে হচ্ছে।
“অভ্যন্তরীণ ঋণের ক্ষেত্রে আমাদের মেজর ফোকাসটা সঞ্চয়পত্রের ওপর যেত, সেখানে যেহেতু সুদের হার অত্যন্ত বেশি, সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়, সে কারণে আমরা সঞ্চয়পত্রকে নিরুৎসাহিত করে আসছি এবং আস্তে আস্তে আমরা ব্যাংক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি।”
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানও বলেন, “ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া একটা নৈমিত্তিক কাজ। ব্যাংক থেকে ঋণ না নিলে ব্যাংকের ব্যবসা বন্ধ হবে। নন পারফর্মিং লোনের যে বিষয়টা সেটা একদিনে হয়নি। বিভিন্ন সময় ব্যাংকের দুর্বলতার জন্য, অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য বা বিভিন্ন কারণে এটা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে এটা কমিয়ে আনা।”
কালো টাকার পক্ষে সাফাই
প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা, অপ্রদর্শিত সম্পদ, জমি, ফ্ল্যাট-প্লট, শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনাপ্রশ্নে ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
বিভিন্ন মহল থেকে এর সমালোচনা আসছে। সিপিডিসহ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এমসিসিআই এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী এনবিআরের চেয়ারম্যানকে এর উত্তর দিতে বলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান রহমাতুল মুনিম কালো টাকা সাদা করার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরলেও অতীতে এই সুযোগ নিয়ে কেউ টাকা সাদা করেছিল কি না এবং এর পরিমাণ কত সেই তথ্য বলেননি।
এ সুযোগ দিতে ‘ব্যবসায়ী মহল ও সাধারণের’ দাবি ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ শতাংশ কর দেওয়ার মাধ্যমে সুযোগটি দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আসলে যখন এ ধরনের অ্যামনেস্টি দেওয়া হয়, তখনই সাধারণের প্রশ্ন আসে যে, এটা কালো টাকাকে সাদা করার জন্য। কিন্তু আমরা মূলত এ অ্যামনেস্টি দিয়ে থাকি বিভিন্ন কারণে অপ্রদর্শিত কিছু সম্পদ থাকতে পারে।
“রিটার্নে দেখানো হয়নি আগে, সেটা নানা কারণে হতে পারে। অসতর্কতার জন্য হতে পারে। অজ্ঞতার কারণে রিটার্নে দেখানো যায়নি অথবা অন্যের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দেওয়ার কারণে হতে পারে। আমাদের অনেকেই নিজে রিটার্ন জমা না দিয়ে অন্যের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দেন।”
অন্যের মাধ্যমে রিটার্ন দেওয়ার কারণে তথ্যগুলো (অপ্রদশির্ত অর্থ-সম্পদ) নথিতে বাদ পড়ে যায় বা ভুল হয়ে যায় বলে মনে করেন তিনি।
জমি কেনা-বেচার ফলে ‘অজ্ঞাতে’ কিছু টাকা কালো হয়ে যায় মন্তব্য করে রহমাতুল মুনিম বলেন, “আরও একটি বিষয় রয়েছে, সেটা আপনারা স্বীকার করবেন যে, জমি ক্রয়-বিক্রয়ে আমাদের কিছু টাকা আমাদের অজ্ঞাতেই কালো হয়ে যায় বা অপ্রদর্শিত হওয়ার সুযোগ হয়ে যায়। এ ধরনের কিছু অনিবার্য কারণে রিটার্নে যে সমস্ত সম্পদ দেখাতে পারেননি, সেই সম্পদ দেখানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য অনেক দেশেই এ প্র্যাকটিসটি আছে।”
কমপ্লায়েন্স ও টাকা পাচার রোধের বিবেচনা থেকেও কালো টাকা বৈধ করার পক্ষে যুক্তি দেন তিনি।
তিনি বলেন, “কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি আমরা যখন এনশিওর করতে যাচ্ছি, তখন দেখা যাচ্ছে কিছু অপ্রদর্শিত জিনিস রয়ে গেছে, যেগুলো ব্যবসায়ীরা দেখাতে চান, ব্যক্তি পর্যায়ে দেখাতে চান। নতুন করদাতা যারা, তারা করের আওতায় আসতে চান এবং এগুলো দেখাতে চান। সেজন্য আমরা এ ধরনের একটি সুযোগ করে দিয়েছি।
“কালো টাকা যারা তৈরি করেন, আমরা কথায় কথায় বলি, কালো টাকাকে যারা প্রশ্রয় দেন, তারা অর্থনীতিতে এই কালো টাকাকে ব্যবহারের জন্য করেন না। কালো টাকা মূলত দেশের বাইরেই বেশি চলে যায় এবং বিভিন্ন ভোগ বিলাসের কাজেই ব্যয় হয়ে যায়। সেই জায়গা থেকেই রিটার্নে বিষয়টি রাখার জন্য সুযোগটা রেখেছি।”
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীরের কালো টাকা কি ১৫ শতাংশ কর দিয়ে দিয়ে সাদা হয়ে যাবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বেনজিরের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।
”এই ধরনের বিষয় কীভাবে ট্যাক্স দিয়ে বৈধ হয়ে যাবে। এটা তো আইনি প্রক্রিয়ায় পড়ে গেছে। এত ঢালাওভাবে আমি বিষয়টি দেখতে চাই না। তার কালো টাকা সাদা বা অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শন বিষয়টি এত সহজভাবে আমরা দেখছি না “
সংবাদ সম্মেলনে ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে তুলে ধরা হয়।
‘চুপ’ থাকলেন গভর্নর
দুই মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে ‘নিষেধাজ্ঞার’ কারণে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) দাবির মুখে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে কোনো কথা বলেননি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
এরপর পুরো অনুষ্ঠানে বাজেট, খেলাপি ঋণ, মুদ্রার বিনিময় হারে টাকার মান পড়ে যাওয়া, ব্যাংক ঋণ, অর্থপাচার ঠেকাতে ব্যর্থতা, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন অন্যরা।
পুরো সংবাদ সম্মেলনে ‘চুপ’ করে ছিলেন গভর্নর; যাকে গতবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অনেক বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখা গিয়েছিল।