উত্তর কোরিয়া এ সপ্তাহে অত্যাধুনিক একাধিক ওয়ারহেডবাহী ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের দাবি করলেও দক্ষিণ কোরিয়া তা মিথ্যা বলে অভিযোগ করেছে।
Published : 30 Jun 2024, 11:14 PM
এ সপ্তাহেই উত্তর কোরিয়ার একটি নতুন অস্ত্র পরীক্ষা দুই কোরিয়ার মধ্যে নতুন করে বিবাদের জন্ম দিয়েছে।
উত্তর কোরিয়া বলেছে, তারা অত্যাধুনিক একাধিক ওয়ারহেডবাহী ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে। আর দক্ষিণ কোরিয়া তাদের এ দাবি মিথ্যা বলে অভিযোগ করেছে।
এর কয়েক ঘণ্টা পর উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া তাদের এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সফল হয়েছে বলে ফলাও করে প্রচার করে এবং প্রমাণ হিসাবে বৃহস্পতিবার কিছু ছবিও প্রকাশ করে।
তবে দক্ষিণ কোরিয়া একে ‘প্রতারণা এবং অতিরঞ্জন’ বলে অভিহিত করেছে। উত্তর কোরিয়ার ব্যর্থ হওয়ার আভাস দিয়ে নিজস্ব প্রমাণও সিউল প্রকাশ করেছে।
বিশ্লেষকরাও উত্তর কোরিয়ার দাবির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পরও উত্তর কোরিয়া অস্ত্র উন্নয়ন করে চলেছে। এবারের অস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে বিবাদ উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র উন্নয়নের বিষয়টি যাচাই করার নানা জটিলতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ অস্ত্র পরীক্ষার দাবিটি সত্য হলে, এটাই প্রমাণ হবে যে তারা ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
একাধিক ওয়ারহেডবাহী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা কঠিন এবং এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে যে প্রযুক্তি দরকার সেটি অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং।
বর্তমানে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র - যারা ১৯৬০-এর দশকে প্রথম এ ধরনের প্রযুক্তি তৈরি করেছে - সেইসঙ্গে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চীনেরও এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলার সক্ষমতা রয়েছে বলে শোনা গেছে।
উত্তর কোরিয়া এখন বলছে যে, তারাও এমন সক্ষমতা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছে। উত্তর কোরিয়া এখন এমআইআরভি সক্ষমতা কিছু সময়ের জন্য অর্জন করতে পারে- এমন সম্ভাবনার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আলাদাভাবে একাধিক লক্ষ্যে নিক্ষেপ করার মতো পুনঃপ্রবেশকারী যান হচ্ছে, এমআইআরভি।
এটি এমন এক প্রযুক্তি যেখানে একটি ক্ষেপণাস্ত্রে কয়েকটি ওয়ারহেড জুড়ে দেওয়া যায়, যা উৎক্ষেপণের পরে আলাদা হয়ে যায়। এরপর ওয়ারহেডগুলো নিজস্ব রকেট চালিত হয়ে বিভিন্ন নিশানায় আঘাত হানে।
ওয়ারহেডগুলো বিভিন্ন গতিতে, একাধিক দিকে নিক্ষেপ করা যেতে পারে এবং একে অপরের থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে এগুলো আঘাত করতে সক্ষম। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে অস্ত্রটি বিশেষভাবে কার্যকর বলে মনে করা হয়।
উত্তর কোরিয়া বৃহস্পতিবার বলেছে, তারা সফলভাবে প্রতিটি মোবাইল ওয়ারহেডের আলাদা হওয়া এবং দিক নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা করেছে। অস্ত্রটিতে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও তিনটি ওয়ারহেড এবং একটি ডিকয় স্থাপন করা হয়েছে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ওয়ারহেডগুলো কতদূর পর্যন্ত উড়েছে তা পরিমাপ করতে ক্ষেপণাস্ত্রটি ১৭০ থেকে ২০০ কিলোমিটার (১০৫ থেকে ১২৪ মাইল) অর্থাৎ, সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিক্ষেপ করা হয় বলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার দাবি, প্রতিটি ওয়ারহেড লক্ষ্যবস্তুতে ‘সঠিকভাবে’ আঘাত হেনেছে । আর ডিকয়টিকেও অ্যান্টি-এয়ার রাডার সফলভাবে শনাক্ত করে চালনা করতে পেরেছে।
এই পরীক্ষা উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া ‘এমআইআরভি সক্ষমতা’ অর্জন করতে পেরেছে। এটি তাদের শীর্ষ অগ্রাধিকারের বিষয় ছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী এসব দাবি খণ্ডন করে বলেছে যে, অস্ত্রটি স্বাভাবিকভাবে উড়েনি। উড়ার মাঝপথেই সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে। তারা তাদের এই কথার স্বপক্ষে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা প্রচুর ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন। একটি সফল পরীক্ষা চালানোর পর যতটা ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার কথা তার চাইতেও বেশি পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তারা।
তারা আরও বলেছেন যে, উত্তর কোরিয়ার ছবিগুলোয় ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ওয়ারহেড এবং ডিকয় আলাদা হতে দেখানো হয়েছে। এসব ছবি গত মার্চ মাসে চালানো একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বলে দাবি দক্ষিণ কোরিয়ার।
দক্ষিণ কোরিয়ার বার্তা সংস্থা ইয়োনহাপ বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, পরীক্ষাটি যে পরিসরে চালানো হয়েছে, সেটি সাধারণত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় দেখা যায়।
তাদের আরও ধারণা, ক্ষেপণাস্ত্রটির দিক নির্দেশনা এবং এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়ও ঘাটতি থেকে থাকতে পারে। অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরীক্ষা কিছুটা সফল হয়েছে - যদিও অনেক কিছু এখনও জানা যায়নি।
দক্ষিণ কোরিয়ার ‘আসান ইন্সটিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ’ থিংকট্যাং এর গবেষক ইয়াং উক বিবিসি-কে বলেছেন, তিনি মনে করেন, ওয়ারহেডগুলো আকাশে উড়েছে এবং সেগুলো ঠিকমত আলাদাও হয়েছে। কিন্তু তিনি বলেন, “ওয়ারহেডগুলো নিশানায় পৌঁছেছে কিনা উত্তর কোরিয়া এ সংক্রান্ত প্রমাণ প্রকাশ করেনি।তাই আমরা বলতে পারি না যে তারা সফল হয়েছে।”
জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্রটি সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় উড়েছে। এর মানে, এটি বাইরের মহাকাশে প্রবেশ করেনি বরং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতরেই ছিল।
গবেষক ইয়াং বলেন, এর মানে হল "ওয়ারহেডগুলো উচ্চতাপ ও চাপ সহনীয় কিনা তা পরীক্ষা করা হয়নি। কোনও বস্তু একবার মহাকাশে ওঠার পর বায়ুমণ্ডলের দিকে নেমে আসার সময় এরকম তাপ বা চাপ সহ্য করতে হয়, তাই আমরা এই ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষমতা জানতে পারিনি।”
সীমান্তে বসবাসকারী দক্ষিণ কোরীয়রা এ অস্ত্র পরীক্ষা দেখেছে এবং এক বেসামরিক পর্যবেক্ষক এই অস্ত্র পরীক্ষার একটি ভিডিও ধারণ করেছেন, যা পরে দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যম প্রকাশ করে।
ভিডিওতে আকাশে একটি সাদা রেখা দেখা যায়। ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর যেদিক বরাবর যায় সেদিকে রয়ে যায় এমন সাদা রেখা।
উত্তর কোরীয় অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাবেক কর্মকর্তা ভ্যান ভ্যান ডিয়েপেন বলেছেন, “ভিডিওটি দেখে সেখানে বড় কোনও বিস্ফোরণ হয়েছে বা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বিপর্যয়করভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এমন কোনও লক্ষণ আছে বলে মনে হয়নি।”
ওদিকে, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম যে ছবিগুলো প্রকাশ করেছে সেখানে সাদা লাইনগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তবে ভ্যান বলেন, এ থেকেই বলা যায় না যে, পরীক্ষা শতভাগ সফল হয়েছে। ওয়ারহেডগুলো বেরিয়ে যাওয়া এবং সেগুলো সফলভাবে নিজেদের মতো উড়েছে কিনা এর কোনও নিরপেক্ষ প্রমাণ নেই।
অস্ত্র পরীক্ষা সফল হয়েছে কিনা এ বিষয়ে প্রকৃত সত্য যাই হয়ে থাকুক, একটি বিষয় স্পষ্ট। আর তা হল, এতে উত্তর কোরিয়ার হয়ত কিছুটা লাভই হয়ে থাকবে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পিয়ংইয়ং এ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ থেকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত তথ্য পাবে। এভাবে তারা এমআইআরভি সক্ষমতা অর্জনের পথে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। উত্তর কোরিয়া সরকার ২০২১ সালে প্রকাশ্যে এ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।