ব্র্যান্ডিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেক্সটের সঙ্গে লিনেকারের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মূল্য হতে পারে ২০ লাখ পাউন্ড।
Published : 01 Jul 2024, 10:40 PM
ইউরো ফুটবল আসরে যুক্তরাজ্যের ব্র্যান্ড নেক্সটের সবুজ রঙের এক জ্যাকেট পরায় জনপ্রিয় উপস্থাপক ও সাবেক ফুটবলার গ্যারি লিনেকারের বিরুদ্ধে বিবিসির নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল গেল মাসে। এবার মেইল অন সানডের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই পোশাক তৈরির বাংলাদেশি কারখানায় শ্রমিকদের বঞ্চনা আর দারিদ্র্যের চিত্র।
মেইল অন সানডের ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বরাতে ডেইলি মেইল লিখেছে, ৫৫ পাউন্ড বা ৮ হাজার টাকার সেই জ্যাকেট বানাতে ঘণ্টায় শ্রমিকরা পান মাত্র ৪৪ পেন্স বা ৬৫ টাকা। গাজীপুরে কারখানার কাছে এক বস্তিতে- টিনের ছাদের খুপরি ঘরে কোনো রকমে জীবন কাটে তাদের।
‘শ্রম শোষণের’ সেই পোশাকের প্রচারে লিনেকারের মত তারকা জড়িয়ে পড়ার খবরে মর্মাহত হয়েছেন বাংলাদেশের শ্রমিক নেতা খাদিজা খাতুন।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের এই নেত্রী বলেন, গ্যারি লিনেকারের মত তারকাদের উচিত, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা যাতে তাদের কাজের জন্য আরো ভালো মজুরি পায়, তা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা।
ডেইলি মেইল লিখেছে, গত মাসে সার্বিয়ার বিপক্ষে যুক্তরাজ্যের উদ্বোধনী ম্যাচের সময় বিবিসির অনুষ্ঠানে ফ্যাকাসে সবুজ টি-শার্ট এবং ট্রাকার’ জ্যাকেট পরে দেড় কোটি দর্শকের সামনে উপস্থিত হন লিনেকার। এসব পোশাক নেক্সট ব্র্যান্ডের লিনেকার কালেকশন হিসেবে বাজারে এসেছে।
তখন সমালোচনা শুরু হয়, উপস্থাপকরা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো পণ্যের প্রচারে অনুষ্ঠানকে কাজে লাগাবেন না বলে বিবিসির যে নীতি আছে, লিনেকার তা লঙ্ঘন করেছেন।
সাবেক এই ফুটবলারকে উপস্থাপকের নীতিমালা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসি। আর ওই বিতর্কের পর থেকে লিনেকারকে নেক্সটের পোশাক পরে পর্দায় আর হাজির হতে দেখা যায়নি।
ডেইলি মেইল লিখেছে, দুই সপ্তাহর অনুসন্ধানের পর মেইল অন সানডের দুই প্রতিবেদক গত সপ্তাহে বাংলাদেশের সেই কারখানায় যান, যেখানে লিনেকার সেই জ্যাকেট তৈরি হয়েছে। গাজীপুরে অ্যাপটেক গ্রুপের ওই কারখানার ছয়জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে তারা নিশ্চিত হন, সেখানে নেক্সট ব্র্যান্ডের ওই জ্যাকেট বানানো হয়েছিল।
তাদের মধ্যে চারজন আছেন, যারা সেই ফ্যাকাসে সবুজ জ্যাকেট বানানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বা বানাতে দেখেছেন।
অ্যাপটেকের তৈরি পোশাক কারখানার আয়তন চার লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট। তাদের দুই লাখ ২৯ হাজার বর্গফুটের আরেকটি কারখানা আছে, যেখানে বাণিজ্যিক স্যুট তৈরি করা হয়।
মেইল অন সানডের বরাতে ডেইলি মেইল লিখেছে, সেখানকার প্রোডাকশন লাইনে হাজারো কর্মীকে সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করতে হয়, কিন্তু ওভারটাইমের জন্য ‘খুব কম টাকা’ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র পরিবার থেকে আসা এই শ্রমিকরা কারখানার আশপাশের বস্তিতে থাকেন।
কাঠ ও ঢেউটিনের এসব ঘরের সঙ্গে সাধারণত বাথরুম ও রান্নাঘর থাকে। পরিবার নিয়ে সেখানেই রান্না করে খেয়ে-পরে থাকেন শ্রমিকরা।
মোরগ আর কুকরের হাঁকডাকের মধ্যে সেখানে গত সপ্তাহে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন মেইল অন সানডের প্রতিবেদক।
এক নারী শ্রমিক বলেন, মাস তিনেক আগে ধূসর সবুজ ওই জ্যাকেট বানানোর কাজ করেছেন তিনি। তার কাজ ছিল ভেতরের পকেট সেলাই করা।
“আমাদের এই অর্ডারের কাজ চলে ১৫-২০ দিন। আমাদের লাইনে ১০০ জনের মত জ্যাকেট তৈরির কাজে ছিল। সব জ্যাকেটের আমার হাতের স্পর্শ আছে। ধরেন যদি দুই হাজার জ্যাকেট তৈরি হয়. তাহলে দুই হাজারেই আমার স্পর্শ আছে।”
তিনি জানান, দিনে ৮ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। সপ্তাহে কাজ করতে হয় ছয় দিন। তাতে মাস শেষে বেতন মেলে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা (৯১ পাউন্ড)।
মেইল অন সানডে বলছে, বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের জন্য যে ন্যূনতম মজুরি (সাড়ে ১২ হাজার টাকা) আছে, তার তুলনায় অ্যাপটেকের শ্রমিকদের মজুর বেশি। কিন্তু সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা খাটিয়ে নেওয়া হয়, আর ঘণ্টায় দেওয়া হয় মাত্র ৪৪ পেন্স বা ৬৫ টাকা।
অ্যাপটেকে কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা ও চাইল্ডকেয়ার সুবিধা আছে। বাংলাদেশের অনেক কারখানার মানের সঙ্গে তুলনা করে কারখানাটির সুবিধা আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন বলে মনে করা হয়।
তাদের ওয়েবসাইটের ভিডিওতে দেখানো হচ্ছে, গরমের মধ্যে কাজ চালিয়ে নিতে বড় বড় ফ্যান চলছে।
গত সপ্তাহেও তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল জানিয়ে মেইল অন সানডে লিখেছে, ওই নারী শ্রমিক বলেছেন, গরমের মধ্যেই তাদেরকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। টার্গেট পূরণ করতে না পারলে সুপারভাইজাররা নিয়মিতই বকাঝকা করেন।
“ফ্লোর গরম থাকে, এর মধ্যেই অনেক মানুষকে কাজ করতে হয়। কোনো টেবিল ফ্যান নাই, তবে আমাদের সিলিং ফ্যান আছে।
“উপরমহল থেকে যখন সুপারভাইজারদের ওপর চাপ আসে, তখন তারা আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। তারা খালি দ্রুত কাজ করতে বলেন, রাগ দেখিয়ে কথা বলেন। তারা আমাদের গালিগালাজ করে।”
অ্যাপটেক থেকে পাঁচ মিনিট দূরত্বের লতিফপুরের বস্তিতে থাকা আরেক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে মেইল অন সানডে। ন্যূনতম মজুরি বাড়ার পর কাটিং সেকশনের এই কর্মী মাসে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা বেতন পান। তার ঘরে একটি শিশু সন্তান আছে।
এই পুরুষ শ্রমিক তার জানুয়ারি মাসের ১২ হাজার ৭০০ টাকার পে স্লিপ দেখিয়েছেন মেইল অন সানডেকে। সেখানে দেখা যায়, বেতনের আয়ের কিছু অংশ গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে কীভাবে তাকে ওভারটাইম খাটতে হয়েছে।
লতিফপুরের বস্তিতেই এক নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে মেইল অন সানডে, তিনি যে ভবনে কাজ করেন, সেখানে ধূসর সবুজ রংয়ের জ্যাকেট বানাতে দেখেছিলেন।
পাঁচটা নড়বড়ে ঘরের মধ্যে তারটা তুলনামূলক বড়, কিন্তু এই ঘরেই তিন প্রজন্মকে নিয়ে থাকতে হয়। বেশিরভাগ সন্ধ্যায় ঘরে বিদ্যুৎ চলে যায়। কারখানার ফ্লোরে কাজ করা খুব কঠিন ঠেকছে তার কাছে।
“'ধাক্কাধাক্কি, গালিগালাজ, চিৎকার-চেঁচামেচি চলতে থাকে। ঊর্ধ্বতনরা চাপ দিলে তারা (সুপারভাইজার) আমাদেরকে চাপ দেন।”
৩০ বছর বয়সী ওই নারী জানান, তিনি মাসে ১৪ হাজার ১০০ টাকা আয় করেন, ব্রিটিশ মুদ্রায় তা ঘণ্টায় হয় ৪৬ পেন্স।
তার স্বামীও একজন পোশাক শ্রমিক। খুপড়ি ঘরে থাকা দম্পতিকে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচও দিতে হয়।
“আমার জীবন চালাতে হবে আমাকেই, আমি আর কী করতে পারি? আমি একজন গরিব মানুষ।”
এসব বিষয়ে অ্যাপটেক গ্রুপের উপ মহাব্যবস্থাপক মাহবুব সরওয়ারের সঙ্গে কথ বলার কথা লিখেছে ডেইলি মেইল।
মাহবুব সরওয়ার ব্রিটিশ এই সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো মেনেই তাদের কারখানায় বেতন দেওয়া হয়। ‘জীবনধারণের জন্য যৌক্তিক মান’ বজায় রাখার মত করেই বেতন কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
বর্তমান বেতন কাঠামোতে ‘শ্রমিকরা সন্তুষ্ট’ বলেও দাবি করেছেন অ্যাপটেক গ্রুপের উপ মহাব্যবস্থাপক।
তিনি বলেছেন, কোম্পানির ভ্যান্টিলেশন সিস্টেম ‘ফ্যাক্টরির ফ্লোর ঠান্ডা রাখার জন্য কার্যকরী। ‘নিরাপদ ও সম্মানজনক’ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করছে অ্যাপটেকের ‘হয়রানিবিরোধী কমিটি’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এ বিষয়ে মাহবুব সরওয়ার বা অ্যাপটেক গ্রুপের কারো সঙ্গে কথা বলতে পারেনি।
ডেইলি মেইল লিখেছে, গত সপ্তাহে দারিদ্র্যের যে দৃশ্য মেইল অব সানডে দেখেছে, তা লিনেকারের কাছে পরিচিতই হওয়ার কথা। বিবিসি স্পোর্ট রিলিফের জন্য শুটিং করতে ২০২২ সালে তিনি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। ঢাকার ১০০ একরের আবর্জনা স্তূপে শিশুদেরকে প্লাস্টিক টোকাতে দেখে লিনেকারের চোখে জল ঝরতে দেখা গিয়েছিল।
তিনি বলেছিলেন, “এটা আমার দেখা সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা। নরকে স্বাগতম।”
ওই সফর নিয়ে পরে তিনি সানডে টাইমসকে বলেছিলেন: "আমি এর আগেও দরিদ্র দেশে গেছি, তবে সেখানকার পরিস্থিতি আরও বেশি নাজুক। এটা খুব মর্মস্পর্শী ছিল।”
ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের কয়েক সপ্তাহের সহিংস আন্দোলনে গত বছর উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
গত ডিসেম্বরে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়। তবে এই মজুরিকে অনেক কম হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর লেবার স্টাডিজের সমীক্ষা ধরে ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণের দাবি জানিয়েছিল শ্রমিক সংগঠনগুলো।
ভালো মজুরি নিশ্চিতে নেক্সট এবং ১২টি বড় ব্র্যান্ডের ভূমিকায় ‘বেদনাদায়ক নিষ্ক্রিয়তা’ এবং ‘হতাশাজনক ব্যর্থতা’র অভিযোগ তুলেছিল ক্লিন ক্লোথস ক্যাম্পেইন।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেত্রী খাদিজা খাতুন বলেন, “বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য যে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হয়েছে, তা দিয়ে কারও জীবনধারণ সম্ভব নয়। লিনেকারের আবার বাংলাদেশ সফর করা উচিত। যারা ন্যূনতম মজুরির চেয়ে সামান্য বেশি পায়, তাদের জীবনযাত্রার অবস্থাটা উনি দেখুক।”
নেক্সট বলছে, তাদের ‘কোড অব প্র্যাক্টিস’ টিম গত বছরই পণ্য সরবরাহকারীর কারখানা পরিদর্শন করেছে এবং ‘গ্রহণযোগ্য’ রেটিং দিয়েছে। শ্রমিকদের বেতন বকেয়া হওয়ার তথ্য মেলেনি, দমবন্ধ হওয়া গরম বা সুপারভাইজারের মাধ্যমে হয়রানির তথ্যও মেলেনি।
এ কোম্পানি বলছে, যুক্তরাজ্যের সব না হলেও প্রধান পোশাক বিক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে কাপড় আমদানি করে এবং যুক্তরাজ্যে বিক্রি হওয়া প্রতি চারটি কাপড়ের একটি বাংলাদেশে তৈরি।
নেক্সটের একজন মুখপাত্র বলেন, “বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি এক দশকের দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের জীবনযাত্রার বড় ধরনের মানোন্নয়নে পোশাক উৎপাদনকারীরা কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাপক উন্নতির পরও পরিবর্তনের গতি যে হতাশাজনক, তা আমরা বুঝতে পারছি।”
ডেইলি মেইল লিখেছে, পোশাক ব্র্যান্ড নেক্সটের মত কোম্পানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গ্যারি লিনেকার ২০ লাখ পাউন্ডের মত আয় করে থাকতে পারেন বলে একজন বিশেষজ্ঞ ধারণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “গ্যারি লিনেকার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং তিনি খুব অথেনটিক ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার বয়স আর চেহারাও তাকে উঁচু মর্যাদায় রেখেছে।”
বক্তব্য জানতে লিনেকারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি।