Published : 31 Mar 2012, 07:18 AM
তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম কারন । তামাকজনিত রোগ হতে রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রন আইনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ শতভাগ ধুমপানমুক্ত পাবলিক প্লেস ও পরিবহন । প্যাকেটের গায়ে স্বচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী নিশ্চিত, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রন, তমাক নিয়ন্ত্রন কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান ও কার্যক্রম নিয়ে অনেক মতামত রয়েছে । অধিকাংশ ক্ষেত্রে আংশিকভাবে তামাকনিয়ন্ত্রন কার্যক্রমকে মুল্যায়ন বা পর্যবেক্ষনের কারনে দেশের সার্বিক তামাক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন সম্পর্কে কেউ কেউ নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। দেশের সার্বিক তামাক নিয়ন্ত্রন কার্যক্রম মূল্যায়ন করলে তামাক নিয়ন্ত্রনে দেশের ব্যপক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হবে। একটি বিষয় আমাদের পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন তামাক নিয়ন্ত্রন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। একদিনে বা কয়েক বছরে তামাক নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয় ।
তামাক ব্যবহার হৃাস করতে একদিকে সরকার ও তামাকনিয়ন্ত্রন কর্মীরা অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, অপরদিকে তামাককোম্পানীগুলো তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যবসার প্রসারের জন্য তামাক সেবনে উদ্ভুদ্ধ করছে। তামাক নিয়ন্ত্রন আইন ও তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মতো কার্যকর পদক্ষেপগুলোকে বাধাগ্রস্থ করছে। নানা বিভ্রান্তকর প্রচারণার মাধ্যমে জনগনকে বিভ্রান্ত করে তামাক নিয়ন্ত্রন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করতে চাচ্ছে। তামাক কোম্পানীগুলোর বিভ্রান্তকর প্রচারনার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রনে তড়িৎ ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা সম্ভব হয় না । উদাহারনস্বরুপ বলা যেতে পারে, যখন তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় তখন তামাক কোম্পানীগুলো কর্মসংস্থান হৃাস পাবে, রাজস্ব ক্ষতি হবে এ ধরনের বিভ্রান্ত তুলে কর বৃদ্ধির বিরোধীতা করে । যদিও একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার তামাকের কারনে লাভবান হয় কোম্পানির মালিক আর ক্ষতিগ্রস্থ হয় চাষী উৎপাদনে নিয়োজীত শ্রমিক এবং ব্যবহারকারী । জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশ রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রন একটি জরুরী বিষয় ।
দেশের তরুন ও যুব সমাজকে রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রন আইন সংশোধন ও কর বৃদ্ধি জরুরী । যুব সমাজের মাঝে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধিতে প্রতিটি সচেতন মানুষই উদ্ভিগ্ন । তামাক ব্যবহার পরবর্তীতে অনেক যুবকই আসক্ত হচ্ছে মাদক জাতীয় নেশায় । এ নেশায় আসক্ত হয়ে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে দেশের যুব সমাজের একটি অংশ। যা রাষ্ট, সমাজ, অর্থনীতিসহ সার্বিক অবস্থার জন্য শংকার বিষয়। দেশের আগামী প্রজন্মের কান্ডারী এই যুব সমাজকে যে কোন মুল্যেই আমাদের রক্ষা করতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রন আইন সংশোধন আজ তাই একটি জরুরী বিষয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষনায় বলা হয়, যেসব ধূমপায়ী শৈশব-কৈশোরেই ধুমপান শুরু করে তাদের মধ্যে ২৫ ভাগ ১০ বছর পুর্ন হওয়ার আগেই প্রথম সিগারেট পান করে । তামাক কোম্পানীগুলো শিশু-কিশোর-তরুনদের ধুমপানে আসক্ত করে তুলতে চাই । তামাক কোম্পানির যেসব গোপন দলিল প্রকাশিত হয়ে পড়ে সেসব দলিলে এর প্রমান পাওয়া যায় । পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ তামাক কোম্পানি বৃটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি বিএটির ৭৪ সালের এক তথ্যে দেখা যায়,'কিশোর/তরুন' ধূমপায়ীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সংখ্যার এক দিক থেকে তারাই প্রধানত বাজার নিয়ন্ত্রন করে এবং তারা একবার যে ব্র্যান্ড পছন্দ তরে তা সারাজীবন চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
যুব সমাজকে তামাক ব্যবহার হতে বিরত রাখতে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী, ধুমপানমুক্ত স্থান এবং তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চ হারে কর বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপুর্ন বিষয়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনটি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপুণ পদক্ষেপ। এই আইনটির প্রেক্ষিতে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান হৃাস, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী জোরদার হয়েছে । তথাপিও আইনটির কতিপয় স্থানে দুর্বলতা রয়েছে । সময়ের সাথে আইনের পরিবর্তন একটি গুরুত্বপুর্ন বিষয় ।
তামাক চাষ – দেশে ক্ষতিকর তামাক চাষের পরিমান বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জানা সত্বেও বেশি লাভের আশায় তামাক চাষ করছেন চাষীরা । বাংলাদেশে ৩০ বছরের বেশী সময় ধরে তামাক চাষ হয়ে আসছে । উত্তর বঙ্গ থেকে শুরু করে বর্তমানে পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সহ ১৫ টি জেলায় ৮০ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। এত মুনাফালোভী সিগারেট কোম্পানীগুলো লাভবান হলেও বিপন্ন হচ্ছে গনমানুষের স্বাস্থ্য এবং দিন দিন বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির কবলে পড়তে যাচ্ছে যা আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য মারাত্বক হুমকি স্বরুপ। বিদেশী ও দেশী বিভিন্ন কোম্পানীর উদ্যোগে কৃষকদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে উদ্ভুদ্ধ করা হচ্ছে । তামাক কোম্পানিরা কৃষকদের শীতকালীন ফসল থেকে সরিয়ে এন তামাক উৎপাদনে নিয়োজীত হতে উদ্ভুদ্ধ করছে । কোম্পানী কৃষকদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে তামাক চাষে নিয়োগ করে এবং তামাক বীজ,সার,কীটনাশকসহ সকল উপকরন,নগদ টাকা এবং তামাক পাতা কিনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কৃষকদের আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলে । তাই তামাক চাষ করে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া সত্বেও তামাক চাষীরা কোম্পানীর কাছে বাধ্যবাধকতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে তামাক চাষ থেকে বের হতে পারছে না। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদনের জন্য সরকার এবং অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এই ধরনের সহায়তা না পাওয়ার কারনে কৃষকরা অসহায় বোধ করে, ফলে তারা সহজেই তামাক কোম্পানীর মরন ফাদে ধরা পড়ে । এর ফলে একদিকে
উবিনিগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট তামাক চাষের আওতাভুক্ত ৭৪,০০০ হেক্টর জমির মধ্যে বিভিন্ন জেলায় তামাক চাষের আওতাভুক্ত জমির পরিমান – কুষ্টিয়া : ২৮,০০০ হেক্টর, নীলফামারী : ৬৫৩৬ হেক্টর, বান্দরাবান : ৬০৩০ হেক্টর, রংপুর : ৫২৫০ হেক্টর, মানিকগঞ্জ : ২৭০০ হেক্টর, ঝিনাইদহ : ২৫৪১ হেক্টর, কক্সবাজার : ২০০০ হেক্টর, রাঙ্গামাটি : ৭৪৩ হেক্টর, খাগড়াছড়ি : ৬৮০ হেক্টর, চুয়াডাঙ্গায় : ৭৩০ হেক্টর, মেহেড়পুর : ৪৩০০ হেক্টর, রাজবাড়ী : ৫০৩ হেক্টর, নাটোর : ৪২৩ হেক্টর, টাঙ্গাইল : ২৩৫ হেক্টর, যশোর : ৭ হেক্টর।
তামাক চাষের কারনে ফসলের বৈচিত্র কমে যাচ্ছে। তামাক চাষে ব্যপক পরিমান রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় এর ফলে পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি হয়। তামাক ৮ মাসের দীর্ঘমেয়াদী ফসল হওয়ায় অন্য তিনটি মৌসুমের ফসলের ক্ষতি করে । তামাক চাষের কারনে এলাকায় শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ শাক-সবজি অন্য এলাকা থেকে আমদানি করতে হয় । কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে প্রতি একর জমিতে চারার পরিমান ১০,০০০ প্রতি একর জমিতে সারের পরিমান দিতে হয় আট বস্তা এর মধ্যে রয়েছে ইউরিয়া ১২৫ কেজি, এস ও পি ১২৫ কেজি এবং টিএসপি ১২৫ কেজি । তামাক কোম্পানীগুলো এই সারের সরবারহ করে দেয়। তামাক চাষ মাটির গুনাগুন এবং পানি ধারন করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে। ফলে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে ফসল উৎপাদনের উপযোগীতা নষ্ট হয়ে যায় । ফলে যে সব রবি শস্য এবং সবজি হতো তা আর হতে পারে না।
নদীর দুই ধারে তামাক চাষের কারনে বর্ষায় বিষাক্ত ময়লা ধুয়ে পানি মিশে পানি দূষিত হচ্ছে । নদীতে মাছের ডিম ছাড়ার সময় তামাকের মৌসুম শেষ হয় । ঐ সময় বৃষ্টির ধোয়া পানি নদীতে এসে পড়লে মাছের ডিম নষ্ট হয় এবং বংশ বিস্তার হয় না। তামাক চাষের কারনে এলাকায় গো খাদ্য না থাকায় গবাদি পশু কমে গেছে । অন্যদিকে দুধ, ডিম ও মাংস খাওয়ার পরিমান কমে যায় যার ফলে ঐ এলাকার মানুষ মারাত্বক পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে । অন্যদিকে তামাক পোড়াতে প্রতি কেজিতে ৫ কেজি জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয় । প্রতি একর তামাক পাতার জন্য ৫ টন জ্বালানী কাঠের প্রয়োজন হয় । পাহাড় বৃক্ষশুন্য হওয়ায় পাহাড় ধসে পড়ছে এবং নদী ভরাট হচ্ছে । তামাক চাষের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের মারাত্বক ক্ষতি হয় । যেমন-শ্বাসকষ্ট, গ্যাস্টিক, কোমর ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, কাশি, হাপানি, চর্ম রোগ, মহিলাদের গর্ভপাত, জন্ডিস ইত্যাদি। ফলে একদিকে যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে অন্যদিকে পরিবেশ বিপন্ন ও খ্যাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে ।
তামাক নিয়ন্ত্রন আইন সংশোধন: তামাক নিয়োন্ত্রন আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি । আইনের সীমাবদ্ধতার কারনেও অনেক ক্ষেত্রে আইনটির সুফল জনগনের নিকট তুলে দেওয়া যাচ্ছে না। তামাক নিয়ন্ত্রন আইন উন্নয়ন বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা প্রেক্ষিতে তামাক নিয়ন্ত্রন কর্মীরা পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের স্থান সংক্রান্ত বিধান বাতিল করা; সকল তামাকজাত দ্রব্যকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সকল ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০% শতাংশ স্থান জুড়ে ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদান; সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে তামাক কোম্পানীর নাম লগো ব্যবহার করে প্রমোশনার কার্যক্রম নিষিদ্ধ; তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক বা কৌটার অনুরুপ বা সাদৃশ্য অন্য কোন প্রকার দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যে কোন নাগরিককে মামলা করার অধিকার প্রদান; আইনভঙ্গেও প্রেক্ষিতে তামাক কোম্পানিগুলোর জরিমানা ও শাস্তির পরিমান বৃদ্ধি; তামাকের বিকল্প চাষ ও কর বৃদ্ধি জন্য নীতিমালা প্রনয়ন, তামাক কোম্পানিগুলো হতে স্বাস্থ্যকর আদায়, কতৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিধি বৃদ্ধি এবং ধৃমপানমুক্ত স্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষেও শাস্তিও ব্যবস্থা গ্রহনের বিষয়গুলো আইনে যুক্ত করা প্রয়োজন ।
তামাকজাত পন্য হতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় তামাক চাষী, শ্রমিক এবং সেবনকারী । কোম্পানির মালিকদের লাভের জন্য দরিদ্রতা, রোগ অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহানি এবং মৃত্যু এ সকল জোটে জনগনের ভাগ্যে । আমরা মানুষের মৃত্যুঘাতী পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি দেখার পরও চুপ করে থাকতে পারি না । স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি'র গবেষনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ৪৩.৩% প্রাপ্ত বয়স্ক লোক তামাক ব্যবহার করে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতি রক্ষায় এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে ধূমপান ও তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে সকল তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চ কর বৃদ্ধি করা জরুরি। মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা ও জীবন অপেক্ষা কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১ এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) সমূহের এ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর মদ ও ভেজষের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। আন্তজার্তিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-র আর্টিকেল-৬ নং ধারায় তামাক ব্যবহার হ্রাসে কর বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতির উপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনায় তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে কর আরোপ করার অর্থ সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন।
বিগত কয়েক বছরের অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেলেও তামাকজাত দ্রব্যের দাম সে অনুসারে বৃদ্ধি পায়নি বরং কমেছে। সস্তায় তামাকজাত দ্রব্য প্রাপ্তির কারণে মানুষের মধ্যে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৭,০০০ জন মৃত্যুবরণ করছে এবং প্রতি বছর ১২,০০,০০০ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত প্রধান ৮টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রোগীর চিকিৎসা, অকালমুত্য, পঙ্গুত্বের কারণে বছরে দেশের অর্থনীতিতে ১১০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
তামাক ব্যবহার দারিদ্র জনগোষ্টীর উপর প্রভাব ফেলছে । গবেষনায় দেখা যায়, তামাকের পিছনে ব্যয়কৃত অর্থের ৬৯% খাদ্যের পিছনে ব্যয় করা হলে ৫০% শিশুকে অপুষ্টি থেকে বাচাঁনো সম্ভব । এছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি তামাক ব্যবহার হৃাস করে এবং তামাক কোম্পানির নতুন ধূমপায়ী ( বিশেষ করে যুবক ও দারিদ্র জনগোষ্টীকে) তৈরিকে বাধাগ্রস্থ করে । তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব সরকার প্রয়োজনে দরিদ্র লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করতে পারে। প্রায়শই কোম্পানিগুলো অনেক টাকা রাজস্ব দেয় বলে নিজেদের জাহির করতে চায়। তামাক কোম্পানিগুলোর কর বৃদ্ধি হলে রাজস্ব এবং কর্মসংস্থান হৃাস পাবে বলে কর বৃদ্ধির বিরোধীতা করে থাকে। গবেষনায় দেখা যায়, কর বৃদ্ধি হলে তামাক ব্যবহার হৃাস পেলেও দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রন হলে ১৮.৭% চাকুরি বৃদ্ধি পাবে। অপর গবেষনায় দেখা যায়, প্রতিবছর বিড়ির পেছনে প্রায় ২৯১২ কোটি টাকা খরচ হয়, যা দিয়ে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে। এ গবেষনা অনুযায়ী বিড়ির বার্ষিক খরচ দিয়ে ৪৮৫ কোটি ডিম অথবা ২৯ কোটি ১ কেজি ওজনের মুরগী, অথবা ২৯ লক্ষ গরু অথবা ১৪ লক্ষ টন চাল কিনা সম্ভব । তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব সরকারের প্রয়োজনে দরিদ্র লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করতে পারে। তামাকের উপর কর বৃদ্ধির ফলে সরকার তিনভাবে লাভবান হবে, প্রথমত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে, দ্বিতীয়ত জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন হবে, তৃতীয়ত তামাক হকে আদায়কৃত রাজস্ব তামাক শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানে ব্যয় করা সম্ভব হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, কোম্পানিগুলো মূলত সংগৃহীত ভ্যাট রাজস্ব খাতে জমা দেয়, ভ্যাট পুরোটা জনগনের টাকা। কিছু অর্থ রাজস্ব খাতে দিয়ে, সরকারের উপর রোগ ও অসুস্থ্যতার বোঝা চাপিয়ে অনেক অনেক টাকা লাভ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের স্বাস্থ্য অপেক্ষা অর্থ কখনই মুখ্য হতে পারে না । তামাক কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র তাদের মুনাফা লাভের আশায় দেশের জনস্বাস্থ্য, পরিবশ এবং অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে তা আমরা কখনই মেনে নেব না । সরকার প্রশাসন তামাক নিয়ন্ত্রন সংগঠন, গনমাধ্যমকর্মীদের পারষ্পরিক সহযোগীতা ও পদক্ষেপ কোম্পানির অশুভ উদ্দেশ্য প্রতিহত করে জনগনের স্বাস্থ্যকে রক্ষা করবে এ আমাদের বিশ্বাস । সকল তামাক নিয়ন্ত্রন সংগঠন কর্মীদের অসংখ্য ধন্যবাদ অনেক প্রতিকুলতার মাঝেও তারা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে ।