Published : 19 Sep 2011, 10:59 AM
বাংলাদেশ ২০ ডিগ্রি ৩৪০ ও ২৬ ডিগ্রি ৩৮০ উত্তর অৰাংশ এবং ৮৮ ডিগ্রি ০১০ ও ৯২ ডিগ্রি ৪১০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত এবং এর বিস্তৃতি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এ দেশে মোট এবং নিট আবাদি জমির পরিমাণ যথাক্রমে ৮২.৯০ ও ৮০.২২ লাখ হেক্টর এবং ফসলের নিবিড়তা ১৮০%। নিট আবাদি জমির ৩৫.৮০%, এক ফসলি জমি ৫১.৫৪%, দুই ফসলি জমি এবং তিন ফসলি জমি ১২.৭৫%। এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৭৯ জন লোক বাস করে এবং মাথাপিছু জমির পরিমাণ মাত্র ০.০৬ হেক্টর। বর্তমানে এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি এবং ২০২০ সন নাগাদ এ জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৭.৫ কোটি। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর শুধু চালের চাহিদা মেটানোর জন্য বছরে কমপৰে ৩১.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করতে হবে (বিএআরসি-২০০০)। সুতরাং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না হলে ধান ফলাতেই এ দেশের সিংহভাগ আবাদি জমি ব্যবহার করতে হবে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানোর জন্য ধানের পাশাপাশি ডাল, তেল বীজ, মসলা, শাকসবজি এবং ফলের আবাদও বেশ কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। এদেশে কৃষি এখনও প্রকৃতি তথা জলবায়ু নির্ভর এবং কৃষি জলবায়ু এৰেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং অঞ্চলভিত্তিক কৃষি ও মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার জন্য জলবায়ু তথা কৃষি জলবায়ু সম্পর্কিত জ্ঞান একান্ত আবশ্যক।
প্রথমত আমরা জলবায়ু এবং কৃষি জলবায়ু বলতে কি বুঝি তা আলোচনা করা প্রয়োজন। জলবায়ু বলতে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময়ের বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি, শিশিরপাত, কুয়াশা ও আদ্রতা সংবলিত গড় আবহাওয়াকে বুঝায়। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার পরিমাণ সে এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো উদ্ভিদ ও ফসলের ধরন নির্ধারণ করে। তাই ঋতুভেদে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ফসল জন্মায়। বাংলাদেশ মৌসুমী ক্রান্তীয় জলবায়ুর অন্তর্গত। এখানে ষড়ঋতুর মধ্যে প্রধানত তিনটি মৌসুম জোড়ালভাবে পরিলৰিত হয়। বর্ষা মৌসুম সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি বর্ষণ এ সময় হয়। শীতকাল আরম্ভ হয় নভেম্বরে এবং শেষ হয় ফেব্র্বয়ারি মাসে। শীত মৌসুম অত্যন্ত শুষ্ক ও শীতল, কখনো কখনো সামান্য বৃষ্টি হয়। মার্চ-এপ্রিল মাসকে গ্রীষ্ম বা প্রাক বর্ষাকাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময় বাতাস খুবই উত্তপ্ত হয় এবং বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ খুবই কম থাকে। মৌসুমভেদে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আপেৰিক আর্দ্রতা উপাত্ত বিশেৱষণ করলে দেখা যায়, প্রাক-খরিফ মৌসুমে (মার্চ-মে) গড় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বৃষ্টিপাত এবং আপেৰিক আর্দ্রতা যথাক্রমে ৩২.৬ ডিগ্রি সে., ২২.৪ ডিগ্রি সে., ৪৫৩ মি.মি. এবং ৭৪%। খরিফ-১ মৌসুমে (জুন-আগস্ট) মৌসুমে গড় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আপেৰিক আর্দ্রতা যথাক্রমে ৩১.৫ সে., ২৫.৫ ডিগ্রি সে., ১৭৩৩ মি.মি. এবং ৮৬%। খরিফ-২ মৌসুমে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) মৌসুমে গড় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আপেৰিক আর্দ্রতা যথাক্রমে ৩০.৫ ডিগ্রি সে., ২১.৪ ডিগ্রি সে., ২১০ মি.মি. এবং ৮০%। রবি মৌসুমে গড় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আপেৰিক আর্দ্রতা যথাক্রমে ২৬.৫ ডিগ্রি সে., ১৩.৯ ডিগ্রি সে., ৪৪ মি.মি. এবং ৭৩%।
বাংলাদেশে নিম্নবর্ণিত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রাজনিত চার ধরনের নির্ণায়কের ভিত্তিতে ৩০টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চল শনাক্ত করা হয়েছে। যথা-
১. প্রাক-খরিফ ক্রান্তিকালের গড় ব্যাপ্তি অর্থাৎ অনিশ্চিত ও সবিরাম বৃষ্টিপাতের সময়সীমা।
২. বৃষ্টিনির্ভর খরিফ এবং রবি ফসল উৎপাদনকালের গড় ব্যাপ্তি।
৩. বছরে ১৫ সেলসিয়াসের নিচে সর্বনিম্ন তাপমাত্রাযুক্ত দিনের গড় সংখ্যা, যা প্রধানত রবিশস্য উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. বছরে ৪০ সেলসিয়াসের বেশি চরম তাপমাত্রাযুক্ত দিনের গড় সংখ্যা, যখন বাষ্প প্রস্বেদনের মাত্রা ৰতিকর পর্যায়ে পৌঁছে।
ফসল উৎপাদনকাল
ফসল উৎপাদনের মূলে রয়েছে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা এবং মাটির রস ধারণ ও সরবরাহ ৰমতা। বাংলাদেশে প্রায় সারা বছরব্যাপী আবাদের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা বিরাজ করে। তাই উৎপাদনকালের ব্যাপ্তিকে প্রধানত যে বিষয়টি প্রভাবান্বিত করে তা হল মাটির রস সরবরাহ ৰমতা। বর্ষার শেষে মাটির পানি অপসারিত হয়ে এক পর্যায়ে মাটিতে 'জো' আসে এরপর মাটির রস শুকাতে থাকে। এ সময় মাটি তার ধারণ করা রসের একটা অংশ মাত্র গাছ বা ফসলকে সরবরাহ করে। উদ্ভিদের আহরণযোগ্য রসের অবস্থা মাটিভেদে ভিন্ন হয়। রবি মৌসুমে উদ্ভিদের আহরণযোগ্য রসের অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে মাটিতে আহরণযোগ্য রসের পরিমাণ যত বেশি সে মাটি বিনা সেচে রবিশস্য উৎপাদনের জন্য ততো উপযোগী। উদ্ভিদের আহরণযোগ্য রসের অবস্থা মাটির বুনট ও একই বুনটযুক্ত মাটির গভীরতা, মাটির উপরিস্তরের নিম্নাংশে কর্ষণতল (পৱাউপ্যান) থাকলে এর প্রবেশ্যতা, মাটির কৈশিক ছিদ্রতা, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এবং মাটি কণার খনিজ পদার্থের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। বেলে মাটিতে আহরণযোগ্য রসের পরিমাণ কম থাকে। এঁটেল মাটির রস ধারণ ক্ষমতা বেশি, কিন্তু আহরণযোগ্য রসের পরিমাণ কম। অন্যদিকে সাধারণ দো-আঁশ মাটিতে আহরণযোগ্য রসের পরিমাণ বেশি থাকে।
হিসাব কষে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বুনট শ্রেণীর মাটিতে এক মিটার গভীরতায় ফসলের সহজে আহরণযোগ্য মোট রসের মাত্রা ২৫ মি. মি. হতে ৩০০ মি.মি.-এর অধিক (সারণি-১)।
বৃষ্টিপাত, বাষ্প-প্রস্বেদন, মৃত্তিকায় মজুতকৃত রস বিষয়ক তথ্যের বিশেৱষণ ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ দুটি প্রধান ফসল উৎপাদনকাল, খরিফ ও রবি এবং এর সাথে সম্পৃক্ত তিনটি জলবায়ু-মৌসুম শনাক্ত করা হয়েছে, যথা-
ক. প্রাক-খরিফ ক্রান্তিকাল: বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পূর্ণ বাষ্প-প্রস্বেদনমাত্রার অর্ধেক অতিক্রম করলেই এ উৎপাদনকাল শুর্ব হয়। এ সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সবিরামভাবে পূর্ণ বাষ্প-প্রস্বেদানমাত্রার কম-বেশি অর্ধেক থাকে।
খ. খরিফ উৎপাদনকাল : এ সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং ১০০ মিমি. মজুতকৃত মৃত্তিকা রস (১ মিটার গভীরতা পর্যন্ত) একত্রে অবিরাম পূর্ণ বাষ্প-প্রস্বেদনমাত্রার অর্ধেক (০.৫) বা এর উপরে থাকে।
গ. আর্দ্রকাল : এ সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অবিরামভাবে পূর্ণ বাষ্প-প্রস্বদনমাত্রার উপরে থাকে। আর্দ্রকাল খরিফ উৎপাদনকালের একটি অংশবিশেষ।
ঘ. বরি উৎপাদনকাল : বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পূর্ণ বাষ্প-প্রস্বেদনমাত্রার নিচে নেমে আসার মুহূর্ত থেকে শুর্ব করে পুরোপুরি বৃষ্টি থেমে যাওয়া, উপরন্তু এক মিটার গভীরতা পর্যন্ত মৃত্তিকায় মজুতকৃত সর্বোচ্চ ২৫০ মিমি. রস নিঃশেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এ মৌসুমের ব্যাপ্তিকাল।
ঙ. শুষ্ক মৌসুম : খরিফ উৎপাদনকালের শেষ থেকে শুর্ব করে প্রাক-খরিফ ক্রান্তিকালের শুর্ব পর্যন্ত এ সময় বিরাজ করে। শুষ্ক মৌসুম রবি উৎপাদনকালের অন্তর্ভুক্ত।
খরিফ ফসল উৎপাদনকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং মজুতকৃত মৃত্তিকা রস বিনা সেচে খরিফ ফসল আবাদের জন্য যথেষ্ট থাকে। বাংলাদেশে ১২টি খরিফ উৎপাদনকাল (ক১-কে১২ অঞ্চল) চিহ্নিত করা হয়েছে। এ মৌসুম দেশের পশ্চিম-প্রান্তীয় অংশে (কে১ অঞ্চল) ১৭০-১৮০ দিন এবং উত্তর পূর্ব প্রান্তীয় (কে১২ অঞ্চল) ২৮০-২৯০ দিন বিরাজ করে। দেশের অধিকাংশেই এ মৌসুমের শুর্ব এবং শেষ হওয়ার তারিখ উল্লেখযোগ্যভাবে বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন হয়ে থাকে। কৃষির উপর এ বিভিন্নতার প্রভাব রয়েছে। যেমন- এ মৌসুম স্বাভাবিকের তুলনায় আগে শুর্ব হলে মাটিতে অতিরিক্ত সিক্ততা দেখা দিতে পারে, ফলে ভারি পলি ও এঁটেল মাটি বিশিষ্ট জমি তৈরিতে অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে।
এ মৌসুম স্বাভাবিকের তুলনায় পরে শেষ হলে আগাম খরিফ ফসল খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ মৌসুম স্বাভাবিকের তুলনায় আগে শেষ হলে গমের মতো রবি ফসল বোনার উপযুক্ত সময় শুর্ব হওয়ার আগেই মাটির উপরিস্তর শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।
এ মৌসুম বিলম্বিত বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় পরে শেষ হলে মাটির সিক্ততার কারণে রবি ফসল বোনা বিলম্বিত অথবা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
তাপমাত্রা অঞ্চল
বাংলাদেশে দুই ধরনের তাপমাত্রা অঞ্চল শনাক্ত করা হয়েছে, যথা-রবি বা শীতল তাপমাত্রা অঞ্চল এবং চরম গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা অঞ্চল। শীতল তাপমাত্রাযুক্ত (অর্থাৎ গড় সর্বনিম্ন ১৫ সে-এর কম) কালের ব্যাপ্তির ভিত্তিতে ৫টি অঞ্চল (টি১-টি৫) শনাক্ত করা হয়েছে। এ সময়ের গড় ব্যাপ্তি উপকূলবর্তী এলাকায় সবচেয়ে কম (৩০-৪০ দিন) এবং উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম প্রান্তীয় অংশে সবচেয়ে বেশি (প্রায় তিন মাস)। এ নিম্নতাপমাত্রার সময়সীমা পার্থক্য রবি মৌসুমের ফসলকে বিভিন্নভাবে প্রভাবান্বিত করে। সাধারণত যত বেশি কালব্যাপী গড় দৈনিক তাপমাত্রা ২০ সেলসিয়াসের নিচে অথবা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ সেলসিয়াসের নিচে থাকবে, গম, আলু ও ডালজাতীয় ফসল আবাদের জন্য ততো বেশি উপযোগী হবে।
বছরে ৪০ সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রাযুক্ত দিনের গড় সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশে ৪টি চরম উষ্ণ তাপমাত্রা অঞ্চল (ই১-ই৪) শনাক্ত করা হয়েছে। ৪০ সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বছরে ৫ দিন অথবা তারও বেশি দিন সংঘটনের অঞ্চলগুলো দেশের পশ্চিমাংশে অবস্থিত। দেশের মধ্যভাগ, পূর্ব এবং দৰিণাংশে এ ধরনের তাপমাত্রা অপেৰাকৃত স্বল্প সংখ্যক দিনে ঘটে। যেমন- ঢাকায় এর গড় সংখ্যা দুই বছরে মাত্রা একদিন। চরম উষ্ণ তাপমাত্রা সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে এবং কখনো কখনো জুন মাসের প্রথমাংশে সংঘটিত হয়। এ সময় বাষ্প-প্রস্বেদনের পরিমাণ খুব বেশি হয়।
বাংলাদেশকে কৃষি জলবায়ু শ্রেণীবিন্যাসের ৰেত্রে এলাকাগতভাবে ফসল উৎপাদনকাল, ফসল উৎপাদন, মৌসুমের ব্যাপ্তিকাল ও শুরুর আদর্শ বিচ্যুতিকাল, শুষ্ক দিনের সংখ্যা, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, চরম উষ্ণ ও চরম শীতল তাপমাত্রাযুক্ত দিনের সংখ্যা এবং সম্ভাব্য বাষ্পপ্রস্বেদন এসব জলবায়ুবিষয়ক নির্ণায়ক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। কোন ফসলের ভালো উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে কৃষি জলবায়ুগত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মনে রেখে পরিকল্পনা করা আবশ্যক। নিম্নে উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের ফসল ও মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলার সিংহভাগ এইজেড ১৩ এবং কিয়দংশ এইজেড ১২ -এর অন্তর্গত। এ এলাকার পশ্চিমাংশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৭০০ মিমি যা বৃদ্ধি পেয়ে দৰিণ-পূর্বাংশে ৩৩ মিমি অতিক্রম করে। বর্ষাকালে তিন মাসের গড় বৃষ্টিপাত ৫০০ মিমি ছাড়িয়ে যায়। এ এলাকার ভূ-প্রকৃতি প্রধানত সমতল। জোয়ার-ভাটা সমৃদ্ধ অসংখ্য নদী-নালা সমগ্র এলাকাটিতে জালের মতো বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ এলাকার গড় উচ্চতা ১ মিটার । এ এলাকার জমি প্রধানত মাঝারি উঁচু তবে কিঞ্চিৎ পরিমাণ উঁচু এবং মাঝারি নিচু জমিও রয়েছে। বাঁধের বাহিরের এলাকা কোথাও কোথাও বর্ষাকালে স্বল্প গভীরভাবে পৱাবিত হয়। অধিকাংশ ডাঙ্গা এলাকা সারা বছরব্যাপী জোয়ারের পানিতে স্বল্প গভীর এবং বিল এলাকা মাঝারি গভীরভাবে পৱাবিত হয়।
কৃষি উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতা : অসংখ্য নদী-নালা এ এলাকায় জালের মতো বিস্তৃত বিধায় নৌকা ব্যতীত যাতায়াত প্রায় অসম্ভব। ফলে গবেষণা করে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এবং কৃষি উপকরণ কৃষকের নাগালের মধ্যে পৌঁছানো কষ্ঠসাধ্য। এ এলাকার সিংহভাগ জমি অকৃষক মালিকের অধীন। গো-চারণ ভূমি ও গো-খাদ্যের অভাবে গবাদিপশু প্রতিপালন কষ্টকর। শুষ্ক মৌসুমে মাটি ও পানির অত্যধিক লবণাক্ততা ফসল উৎপাদনের প্রতিবন্ধক। কোথাও কোথাও বিল এলাকায় পৱাবনের গভীরতা বেশি বিধায় উফশী রোপা আমন আবাদ করা সম্ভব হয় না।
এ এলাকাটি সামদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আশংকাযুক্ত। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে কখনও কখনও অতি বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতার কারণে রোপা আমন ৰতিগ্রস্ত হয়। অগভীর নলকূপ এবং এলএলপি-র মাধ্যমে সেচের বহুল প্রচলন হওয়ায় বিল এলাকায় আবাদকৃত উফশী বোরো জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এতে লৌহের বিষক্রিয়া এবং নেমাটোড জনিত উফরা রোগে ধান ৰতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বিরাজমান। বাঁধ তৈরির কারণে সংলগ্ন নদীগর্ভে পলি জমে নদীর গভীরতা ও নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বাঁধের ভেতরের জমির পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাদ্ধতা তৈরির আশংকা রয়েছে।
কৃষি উন্নয়ন সম্ভাবনা : জৈবসারসহ সুষম সার প্রয়োগ, মানসম্মত বীজ ব্যবহার এবং উন্নত পরিচর্যার মাধ্যমে বর্তমানে আবাদকৃত ফসলের ফলন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। স্বল্পমেয়াদি রবি ফসল (মিষ্টি আলু, গিমা কলমি, লালশাক, ডাঁটাশাক, মরিচ, ঢেঁড়শ) আবাদ করে কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব। এছাড়া গোখাদ্যের জন্য রবি ভুট্টা, নেপিয়ার, জার্মান ঘাস আবাদ করা যেতে পারে। রোপা আমন মৌসুমে সমন্বিত ধান-মাছ চাষ সমপ্রসারণ করা হলে কৃষকের আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। জলাবদ্ধতার আশংকাযুক্ত এলাকায় নির্দিষ্ট দূরত্বে মাটির উঁচু ঢিবি তৈরি করে ফল বাগান এবং সাংবাৎসরিক শাকসবজির আবাদ করা সম্ভব। ডিবলিং/রিজ-ফারো পদ্ধতিতে স্থানীয়/উফশী জাতের আউশ ধান আবাদ করা যেতে পারে।
যশোর, নড়াইল জেলা এইজেড ১১ এর অন্তর্গত। এ এলাকাটি সাধারণত বিস্তৃত সমতল ডাঙ্গা এবং বিল নিয়ে গঠিত। কোথাও কোথাও অসমতল, সংকীর্ণ ডাঙ্গা ও নিচু এলাকা রয়েছে। এ এলাকায় স্থানভেদে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৪০০ মিমি এর কম থেকে ১৮০০ মিমি। এ এলাকায় শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগ উঁচু, ৩৫ ভাগ মাঝারি উঁচু, ১০ ভাগ মাঝারি নিচু এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ নিচু জমি। ডাঙ্গার উঁচু অংশ সাধারণত বর্ষাকালে পৱাবিত হয় না। ডাঙ্গার নিচু অংশ এবং বিলের কিনারা স্বল্প গভীরভাবে পৱাবিত হয়। বিলের জমি মাঝারি গভীর থেকে গভীরভাবে পৱাবিত হয়। ডাঙ্গার মাটি ৰারীয়, হালকা বাদামি রঙের দো-আঁশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ প্রকৃতির। ডাঙ্গার নিচু অংশ এবং বিলের মাটি বাদামি ছিটযুক্ত গাঢ় ধূসর, এঁটেল প্রকৃতির। উপরিস্তরের মাটি প্রতিক্রিয়া সাধারণত নিরপেৰ থেকে ৰারীয়। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ নিম্ন থেকে মধ্যম। সাধারণভাবে এলাকার মাটি অনুর্বর যদিও সিইসি ও পটাশিয়াম-এর মাত্রা মধ্যম থেকে উঁচু। জিংক ও বোরন-এর মাত্রা নিম্ন থেকে মধ্যম।
কৃষি উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতা : এ অঞ্চলটি দেশের শুষ্ক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানকার বৃষ্টিপাত অনিয়মিত, ফলে আবহাওয়া কখনও শুষ্ক কখনও আর্দ্র্ কখনও কখনও আগাম বৃষ্টিপাত হয়ে দীর্ঘ খরা চলতে দেখা যায়। বর্ষাকালে পৱাবনের গভীরতা এবং বন্যার শুর্ব ও শেষ অনিশ্চিত বিধায় কখনও ফসল জলাবদ্ধতায় আবার কখনও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোথাও কোথাও স্বল্প গভীরে বেলে মাটির স্তর রয়েছে ফলে এসব জমির ফসল সহজেই খরায় আক্রান্ত হয়। বিলের এঁটেল মাটি শুষ্ক মৌসুমের শুর্বতে ভেজা এবং পরবর্তীতে অল্প দিনের ব্যবধানে শুকিয়ে যায় বিধায় সেচবিহীন রবি ফসল আবাদ সম্ভব হয়ে উঠে না। ভূ-উপরিস্থ পানির স্বল্পতা এবং ভূ গর্ভস্থ পানি প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা সেচ পরিকল্পনা প্রণয়ণে বিরাট বাধা। বিশাল এলাকা জুড়ে জিংক এবং সালফারের ঘাটতি লৰ্যণীয়।
কৃষি উন্নয়ন সম্ভাবনা : গঙ্গা-কপোতাৰ সেচ প্রকল্পের আওতায় এ এলাকায় রোপা আউশ, রোপা আমন এবং বোরো আবাদ করা হচ্ছে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের আওতা বহির্ভুত এলাকায় অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের ব্যবস্থা করা হলে রবি মৌসুমে তৈল (সরিষা), ডাল (মসুর, মুগ, মাসকলাই) ও মসলাজাতীয় (পেঁয়াজ, রসুন আদা, হলুদ) ফসলের আবাদ বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেচসহ অর্থকরী ফসল যেমন- আখ, ভুট্টা, চিনাবাদাম আবাদ করা সম্ভব। রবি মৌসুমে স্বল্প সেচ প্রয়োগ করে রবি শাকসবজি আবাদ করা যেতে পারে। প্রান্তিক জমিতে আগাম পানি অপসারণের জন্য নিষ্কাশন নালা ব্যবস্থা রেখে রবি মৌসুমে গম, যব, মসুর, সরিষা, চিনা, কাউন, তিল আবাদ করা সম্ভব। পরিকল্পিতভাবে কলা, পেঁপে, আম, কাঁঠাল বাগান সৃজন করা সম্ভব।
মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলা এইজেড ৮, ১০, ১২, ১৫, ১৯-এর অন্তর্গত।
নব্য ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা পললভূমি অঞ্চলটি প্রশস্ত ও সংকীর্ণ ডাঙ্গা, ডাঙ্গা মধ্যবর্তী নিচু এলাকা এবং ভরাট হওয়া নদীতল ও বিল এলাকা নিয়ে গঠিত। ডাঙ্গার মাটি ধূসর রংয়ের দো-আঁশ থেকে পলি এঁটেল দো-আঁশ, বিলের মাটি এঁটেল। ডাঙ্গার জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ নিম্ন এবং বিলের জমিতে মধ্যম মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও সালফার-এর পরিমাণ মধ্যম।
সক্রিয় গাঙ্গেয় পললভূমি অঞ্চলটি অসমতল প্রশস্ত এবং সংকীর্ণ ডাঙ্গা এবং বিল এলাকা নিয়ে গঠিত। এখানে মাটি অগঠিত ৰারীয় বেলে, পলি এবং এঁটেল প্রকৃতির। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ নিম্ন , ক্যাট আয়ন এঙচেঞ্জ ক্যাপাসিটি (সিইসি) উচ্চ কিন্তু নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও সালফার-এর পরিমাণ নিম্ন এবং বোরন-এর পরিমাণ মধ্যম।
নিচু গাঙ্গেয় নদী বিধৌত পললভূমি অঞ্চলটি প্রায় সমতল প্রশস্ত ডাঙ্গা এবং বিল এলাকা নিয়ে গঠিত । নদী তীরবর্তী এলাকায় অপেৰাকৃত উঁচু ডাঙ্গা রয়েছে। এ এলাকার মাটি ধূসর থেকে গাঢ় ধূসর এঁটেল। কোথাও কোথাও স্বল্প গভীরে পিট পাওয়া যায়। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ মধ্যম থেকে বেশি। মাটির উপরিস্তরের প্রতিক্রিয়া অত্যধিক অমৱ এবং মাটিতে ফসফরাস ও জিংক-এর পরিমাণ নিম্ন মাটির সাধারণ উর্বরতা মধ্যম। পুরাতন মেঘনা মোহনা পললভূমি অঞ্চলটি পরবর্তী অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, চাঁদপুর, লৰীপুর, ফেনী, নোয়াখালী জেলাগুলো এইজেড ১৬, ১৭, ১৮, ও ১৯ -এর অন্তর্গত। মধ্য মেঘনা পললভূমি অঞ্চলটি মূলত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর চর এবং নদী সংলগ্ন মূল ভূখন্ড নিয়ে গঠিত। এ এলাকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২২০০-২৩০০ মিমি। এ এলাকায় শতকরা প্রায় ১০ ভাগ উঁচু, ৩০ ভাগ মাঝারি উঁচু, ২৫ ভাগ মাঝারি নিচু এবং ১০ ভাগ নিচু জমি। ডাঙ্গার মাটি ধূসর রঙের এঁটেল দো-আঁশ। বিলের মাটি ধূসর থেকে গাঢ় ধূসর রঙের এঁটেল । মাটির উপরিস্তরে প্রতিক্রিয়া অত্যধিক অমৱ। সাধারণভাবে মাটির উর্বরতা মান মধ্যম, জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেন নিম্ন। ফসফরাস, জিংক ও বোরন-এর পরিমাণ নিম্ন থেকে মধ্যম।
নিম্ন মেঘনা পললভূমি এলাকাটি সাধারণভবে সমতল। ডাঙ্গা এবং ডাঙ্গার মধ্যবর্তী নিচু এলাকাগুলোর মধ্যে উচ্চতা তেমন কোনো তারতম্য নেই। এ এলাকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০০ মিমি । এ এলাকায় শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ জমি উঁচু, ৩০ ভাগ জমি মাঝারি উঁচু, ৩০ ভাগ জমি মাঝারি নিচু। অপেৰাকৃত উঁচু এলাকার মাটি ধূসর রঙের দো-আঁশ এবং নিচু এলাকার মাটি এঁটেল দো-আঁশ। মাটির উপরিস্তর অমৱীয়। মাটির উর্বরতা মান মধ্যম থেকে উচ্চ। জৈব পদার্থ ও পটাশিয়ামের মাত্রা নিম্ন থেকে মধ্যম।
তথ্যসূত্র: ড. মো. আলতাফ হোসেন, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, এসআরডিআই, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা