স্বপ্নের ভ্যাটিকান সিটিতে

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 9 May 2018, 07:03 AM
Updated : 9 May 2018, 07:03 AM

ভ্যাটিকান সিটি – ছোটবেলা থেকেই আমার কৌতুহলের দেশ। কত লুকানো অজানা গল্প যে এর অানাচে-কানাচে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রয়েছে তা চিন্তা করে আমি শিহরিত হতাম। তাই সুযোগ পাওয়া মাত্রই সেখানে না যাওয়ার তো কোনো কারণই থাকতে পারেনা। দূর থেকে প্রাচীরটা দেখতে পেয়েই যেন আমি হাজার বছর অাগে চলে গেলাম। ভেতরে ঢোকার গেটে বিশাল লাইন, টিকেটের জন্য এই লাইনে দাঁড়াতে গেলে অনেকটা সময়ই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমার বর আগেই অনলাইনে টিকেট কেটে রেখেছিল। তারপরেও চেকিং এর লাইন অাছে, তাই ঢোকার সময় কিছুটা সময় লেগেই যায়।

উত্তর-পশ্চিম রোমের ভ্যাটিকান পাহাড়ের উপর একটি ত্রিভুজাকৃতি এলাকায়, তিবের নদীর ঠিক পশ্চিমে, ভ্যাটিকান শহর অবস্থিত। দক্ষিণ-পশ্চিমের পিয়াৎসা সান পিয়েত্রো বা সেইন্ট পিটার চত্বর বাদে বাকি সবদিকে ভ্যাটিকান শহর মধ্যযুগ ও রেনেসাঁর সময়ে নির্মিত প্রাচীর দিয়ে রোম শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। আমার কাছে ভ্যাটিকান সিটি হলো প্রাচীরঘেরা একটি অন্য দুনিয়া, যেখানে কি না ক্যাথেলিক গির্জার অর্ধেক সম্পত্তিই এর ভেতরে থাকে যুগ যুগ ধরে। দূর্লভ পেইন্টিং, বই, স্কাল্পচার, দামি গহনা কী নেই এর ভেতরে?

আর ভ্যাটিকান ব্যাঙ্কে দুনিয়ার তাবৎ গির্জার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে বলেই শুনেছি। কি ক্ষমতাধর ছোট্ট একটি দেশ! আর পৃথিবীর সবচেয়ে সংরক্ষিত অার্কাইভ তো এখানেই। সেখানে ঢোকার জন্য অবশ্য অনুমতির প্রয়োজন হয়। সর্বসাধারণের জন্য এটি নয়। হাজার বছরের পুরোনো দলিল, বই, ছাপা না হওয়া বাইবেল, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির হাতে লেখা ডায়েরি, গ্যালিলিও এর বই – কি নেই এই সংগ্রহশালায়!

আমরা তিনজন- পুত্র,বর আর আমি। শুরু করলাম ভ্যাটিকান মিউজিয়াম দিয়ে, বিশাল সেই জাদুঘর। আশেপাশের সবার মুখে উত্তেজনা। কেন? কারণ এই মিউজিয়ামটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ও সমৃদ্ধশালী। ঢোকার মুখেই দেখলাম যে এই মিউজিয়ামটি মিশরীয় ভাষ্কর্য, রাফায়েল কামরা, সিস্টেইন চ্যাপেল বা রোমান চিত্রকলা এরকম অনেকগুলো অংশে ভাগ করা।

অ্যালার্ম সেট করা রয়েছে নিরাপত্তার জন্য।এদিকে পুত্রকে নিয়ে অামরা অস্থির, সবকিছু শুধু সে হাত দিয়ে ধরতে চায়, আবার বেষ্টনির মধ্যেও চলে যেতে চায়। একবার খানিকটা মনোযোগী হয়ে যখন দেখছিলাম, আর পুত্রের বাবা ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত; হঠাৎ শুনি অ্যালার্ম বেজে উঠলো। নিরাপত্তা রক্ষী ব্যস্ত হয়ে উঠলো। পুত্র কই?

তিনি আমাদের অল্প সময়ের অন্যমনস্কতায় বেষ্টনীর ভেতর ঢুকে যেতেই নিরাপত্তা ঘন্টা বেজে উঠেছে। এদিকে নিরাপত্তা রক্ষী এসে দেখে এই কাণ্ড। ওয়্যারলেসে তখন অন্যদেরকে তিনি জানালেন অাসল ঘটনা। পুত্র আমার কিছু সময়ের জন্য বিহ্বল, কি যে ঘটছে সে বুঝতেই পারছে না। কেন সবাই এত ব্যস্ত হয়ে উঠলো? আম্মুও বা কেন যে মুখ হাসি হাসি করে রাখার চেষ্টা করে নিচু গলায় দাঁত কিড়মিড় করে হুমকি ধামকি দিচ্ছে!

মিউজিয়ামের ভেতরে ফ্লাস দিয়ে ছবি তোলা একদমই নিষেধ। কত যত্ন বলুন তো দেখি! তবে আমি ঠিক জানি না যে, তারা আর্টগুলোকে আলোকিত করার জন্য যে লাইটগুলো ব্যবহার করে সেগুলো কি ক্ষতিকর নয়?

সিস্টিন চ্যাপেলে ঢুকতে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এত অসাধারণভাবে কেউ যে সিলিং জুড়ে পৃথিবীর সৃষ্টি, আদম ও ইভের গল্প বা এরকম আরও হাজারও গল্পকে এতটা জীবন্তভাবে উপস্থাপন করতে পারে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। লাস্ট জাজমেন্ট চিত্রকর্মটিকে আমার সবচেয়ে বেশি জীবন্ত মনে হয়েছে, মনে হয়েছে যেন চোখের সামনে লাস্ট জাজমেন্ট দেখছি। সেই সময়কার ভয়াবহতা অবিশ্বাস্য  সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এত দর্শনার্থী থাকে যে, ভালই জ্যাম লেগে যায় সেখানে। টুরিস্ট দলগুলোর কেউ কেউ অডিও বিবরণ শুনছেন। কেউ  গাইডের কথা শুনছেন। কিন্তু সবার চোখেই মুগ্ধতা আর কৌতুহল উপচে পড়ছে।

এত মানুষ কিন্তু কোন বিশৃঙ্খলা নেই। সবাই শান্তভাবে লাইন দিয়ে হাঁটছেন আর দেখছেন। কেউ যদি একটু বেশি সময় নেন, তখন অন্যরাও অপেক্ষা করতে থাকেন ধৈর্য নিয়ে, একটুও বিরক্ত হন না, উশখুশ করেন না।

তবে চিত্রকর্মগুলোর প্রকৃত সৌন্দর্য আদৌ ক্যামেরাবন্দী করা যাবে না, যদি না নিজের চোখে দেখা যায়। কার্ডিনালরা মূলত সিস্টিন চ্যাপেলেই নতুন পোপ নির্বাচন করে থাকেন। কার্ডিনালদের ভেতরে ঢুকিয়ে কনক্লেভ সিল করে দেয়া হয়, ভেতরে মোমবাতির আলোয় নির্বাচন চলতে থাকে। এটাই প্রথা।

অামরা ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। এত বড় মিউজিয়াম, এতগুলো কক্ষ। এর ভেতর পুত্র ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েই পড়লো। তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমরা অারও দ্বিগুণ ক্লান্ত। মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে নিচে দেখি ভিড় উপচে পরছে; কেউ বা বের হয়েছে, আবার কেউ বা ভেতরে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। যারা বের হয়েছে, তারাই সবাই ক্লান্ত। পানির ব্যবস্থা আছে, কেউ পানি ভরছে, কেউ বসে আছে। আমরা একটা বসার জায়গা ফাঁকা পেয়ে বসলাম।

ছেলের বাবার খাটনি আমার চেয়েও বেশি, কারণ পুত্রকে তো তারই বেশিরভাগ সময় কোলে রাখতে হয়েছে। বসার জায়গাটাও এমনভাবে ডিজাইন করা যে অন্যরকম  শান্তি  বোধ হয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার দিকে এগোলাম। যাবার পথের পুরোটাই নানান  ভাষ্কর আর চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো।

সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চার্চ। সেইন্ট পিটারের সমাধিকে আচ্ছাদিত করেই এটি নির্মিত হয়েছে। এর ভেতরে প্রবেশ এর জন্য টিকেট লাগে না। কিন্তু কেউ স্বল্প পোশাকে এখানে ঢুকতে পারবে না। এটি সেইন্ট পিটার্স স্কয়ার সংলগ্ন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধর্মীয় ও টুরিস্ট গন্তব্য। রোমান সম্রাট কনস্টান্টটাইন গ্রেটের সময় থেকে এই চার্চটি এই স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ক্যাথেলিকরাই এটিকে তীর্থস্থান বলে মনে করে।

চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল মূল সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা। পরবর্ততীতে এটিকে ১৫০০ সালে পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছিল। এই স্থানে প্রথম শতাব্দিতে রোমানরা হাজার হাজার খ্রিষ্টানদের হত্যা করেছিল। তাই মূল ব্যাসিলিকাটি এখানেই তৈরী হয়েছিল। এখানে গিয়ে আমি  শিহরিত হলাম। আজ যেখানে হাজার হাজার দর্শনার্থী, প্রাচীন লেখকদের মতে, যীশুর শিষ্য পিটার এবং অন্যান্য অনেক বিখ্যাত খ্রিস্টান নেতা এখানে শহীদ হয়েছিলেন। তাদের আর্তনাদ, দীর্ঘশ্বাস কি এখনও বাতাসে ভেসে বেড়ায়?

এর ভেতরে ঢুকে সত্যিই অাবারও মন ভাল হবার পালা। জাঁকজমকপূর্ণ মনুমেন্ট দিয়ে পুরোটি সাজানো। এর মধ্যকার অনেকগুলোই মহান বার্নিনির তৈরী। খুবই শান্ত পরিবেশ। এতো মানুষ অথচ কোনো হইচই নেই। সবাই মগ্ন হয়ে রয়েছে দেখায় এবং প্রার্থনা করায়।

আমরা বলি সেন্ট পিটার্স স্কয়ার।  স্থানীয়রা একে চেনেন পিয়াজা সান পিট্রো নামে। সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার সামনে অবস্থিত বিশাল প্লাজা। এটি এতই বড় যে এখানে নাকি প্রায় ৪০০০০০ মানুষের একসাথে জমায়েত হওয়াও সম্ভব।  ক্যাথলিকরা না কি তাদের প্রথম পোপ হিসেবে সেইন্ট পিটার্সকেই দাবি করেন। প্লাজাটি এত বিশাল করে বানানোর পেছনেও গল্প রয়েছে।

প্রথম প্লাজাটি তৈরী হবার প্রায় এক শতাব্দী পরে পোপ আলেকজান্ডার সপ্তম , এটিকে আরও বড় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন যে, অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের সাথে যেন তাঁর দেখা হওয়া সম্ভব হয় এবং তিনি সকলকে একসাথে অাশীর্বাদ করতে পারেন। মহান বার্নিনি তখন প্লাজাটিকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেন যেন মায়েরা তাদের মাতৃস্নেহের হাত দিয়ে সন্তানদের বা দর্শকদের আলিঙ্গন করা হচ্ছে বলে মনে হয়। এমনকি প্রতিটি ভাষ্কর্যকেও তিনি মায়ের আলিঙ্গন হিসেবেই দেখিয়েছেন।

বিশাল প্লাজাটির মাঝে আমি বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিলাম। অামার সত্যিই খুব ভাল লাগছিল। আর পুত্র? তিনি তো ঘুম থেকে উঠে নতুন উদ্যমে বিশাল প্লাজায় দৌঁড়ে তার বাবাকেও নাস্তানাবুদ করছেন।

ততক্ষণে সূর্য ঢলে পড়ছে। সেই শেষ বিকেলের আলো দারুণ সুন্দর। জীবন সত্যিই আনন্দময় মনে হচ্ছিল, যখন এই পড়ন্ত বিকেলের আলোয় বাবা-ছেলেকে হাসতে হাসতে দৌড়ে মজা করতে দেখছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম এর পরের বার কোথায় যাওয়া যায় তিনজনে মিলে?