Published : 08 Mar 2017, 07:43 AM
বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী বা হিন্দুদের ভাষারূপে চিহ্নিত করার জন্য পাকিস্তানি শাসাকগণ কতই না চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ফলবতি হয়নি। কারণ ছিল, বাংলা কেবল হিন্দু কিংবা কেবল মুসলমানের ভাষা ছিল না (এখনও নেই)। এটা ছিল গোটা বঙ্গেরই ভাষা। প্রাকৃতজনদের ভাষাই কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে আধুনিক বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সপ্তম শতকে উৎপত্তি হলেও ভাষা হিসেবে বাংলার পূর্ণতা আসে এদেশে মুসলমানদের শাসক হয়ে আসার পর থেকেই। বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ বাংলাভাষার উৎকর্ষের জন্য যা করেছেন সেটা ইতিহাসের একটি স্বর্ণমণ্ডিত অধ্যায়। বিশেষ করে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-ই বাংলা ভাষার পূর্ণতা প্রাপ্তির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
কোন ভাষার উৎকর্ষ সাধনের জন্য সে ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করা অপরিহার্য। সংস্কৃত ভারত উপমহাদেশের একটি উৎকৃষ্ট ভাষা ছিল। মূলত এ ভাষার সাহিত্যই অন্যান্য ভাষাগুলোর বিকাশে বিস্তর সহায়তা করে। সংস্কৃত কাব্যগুলোর বাংলায় অনুবাদ বাংলা ভাষার স্বকীয় রূপ পরিগ্রহ করার জন্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু বাংলাসহ এ উপমহাদেশের ব্রাহ্মণগণ ধর্মীয় কাব্যের প্রচারণার বিরোধী ছিলেন। তারা মহাভারত, রামায়ণ কিংবা বেদ-পুরাণগুলোকে অব্রাহ্মণদের যেমন পড়তে দিতেন না, তেমনি অন্যভাষায় এগুলোর অনুবাদও সহ্য করতে পারতেন না। ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য কোন জাতের মানুষ ধর্মচর্চা করলে সে নরকবাসী হবে– এটাই ছিল সেই সময়ের হিন্দুধর্মীয় মতবাদ।
কিন্তু চিরকালই কিছু মানুষ প্রচলিত মতের বিরোধী ছিল। এমন ধারায় দুই কবি ছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা ও কাশীরাম দাস। ব্রাহ্মণদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কৃত্তিবাস রামায়ণ ও কাশীরাম মহাভারত সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এজন্য সেই সময়ের ব্রাহ্মণগণ তাদের 'সর্বনেশে' উপাধি দিয়ে তাদের জন্য নরকবাসের আদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু তাদের মহাভারত আর রামায়ণের ভাবানুবাদ বাংলার মানুষকে এতটাই বিমোহিত করেছিল যে ব্রাহ্মণদের ফতোয়া হালে পানি পায়নি।
এসবই সম্ভব হয়েছিল বাংলার মুসলমান শাসকদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায়। আর এ পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং তার পুত্র ও সভাসদগণ। মুসলমান শাসকদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এমন অনুরাগ ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্যই দীনেশচন্দ্র সেন বাংলাভাষার উন্নয়নের জন্য মুসলমানের বঙ্গ বিজয়কে কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে গিরিশ চন্দ্রসেন তো সর্ব প্রথম সমগ্র পবিত্র কোরান মূল আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার কৃতীত্বের দাবিদার। তাই বাংলা ভাষার উৎকর্ষের আদিপর্বে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সমান সমান কৃতীত্ব রয়েছে।
ভাষার কোন ধর্মীয় পরিচিতি নেই। কোন ভাষায় কোন ধর্মগ্রন্থ নাজিল হলে সেই ভাষার উপর একটা অতিন্দ্রিয় বা পারলৌকিক মোড়ক পড়ে সত্য। কিন্তু তাই বলে ভাষাই ধর্মের ধারক– এমনটি ভাবা হয় অতি সরলতা কিংবা অতিবেশি কুটিলতা। পবিত্র কোরানের ভাষা আরবি। কিন্তু তাই বলে আরবি কেবল মুসলমানদের ভাষাই ছিল না, যেমনটি আজও নয়। কোরান নাজিল হওয়ার সময় আরব ভূখণ্ডেই ছিল সর্বাধিক সংখ্যক ইহুদি ও খ্রিস্টানের বাস যাদের সাথে আমাদের মহানবী(স:)চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন।
কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের চতুর ধর্মাশ্রয়ী সামরিক-বেসমরিক আমলা নির্ভর রজানীতির ধারক-বাহকগণ ভাষাকে ধর্মীয় মোড়কে পরিবেশন করার কৌশল উদ্ভাবন করেন। এ কৌশলের নিকৃষ্টতম স্বীকার হয় আমাদের বাংলাভাষা। যে ভাষার লালন-পালন ও পুষ্টি সাধন মুসলমানদের হাতে, সেই ভাষাকেই তারা কেবল হিন্দুদের ভাষা বলে প্রচার করতে থাকল।
মুসলিম উম্মাহর আফিম দিয়ে তারা এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীকেও ক্রয় করতে সক্ষম হল। এসব বুদ্ধিজীবী পাক-শাসকদের দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নে এমন সব কিছু করতে শুরু করল, যেগুলোর বালখিল্যপণা শিশুদেরও হাসির উদ্রেক করত। তারা এক সময় বাংলা ভাষাকে মুসলিম বানানোর মতো হাস্যকর কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকল যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আরবি হরফে বাংলা লিখন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত যে বাংলা ভাষার সাহিত্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করে পৃথিবীর আধুনিক ভাষাগুলোর সমকক্ষতা অর্জন করেছে, সেই ভাষার লিপি পরিবর্তনের জন্য আইয়ূব শাহীর হাতুড়েপনা আমাদের বিস্ময়াবিভূত করে বৈকি।
পাক শাসকদের স্ববিরোধীতাপূর্ণ প্রচারণার রূপটি কতই না ধূর্ত ছিল! আইয়ূব, ইহায়িয়াসহ সেই সময়ের পাকিস্তানী জান্তারা ছিল মূলত পাঞ্জাবি। তারা রীতিমত পাঞ্জারি ভাষায় কথা বলত; এখনও বলে। উর্দুতে সেই সময় সমগ্র পাকিস্তানের মাত্র ৬% লোক কথা বলত। বাংলা যেমন ১৯৪৭ সালে ভাগ হয়ে পূর্ব-পশ্চিম হয়েছিল, তেমনি পাঞ্জাবও ভাগ হয়েছিল। মানুষ ভাগ হলেও ভাষা কিন্তু ভাগ হয়নি। ভারতীয় পাঞ্জাবের হিন্দু ও শিখরা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে। আর আইয়ূবখানের মাতৃভাষাও ছিল পাঞ্জাবি। কিন্তু কি স্ববিরোধীতা! হিন্দু ও শিখদের পাঞ্জাবি ভাষা আইয়ূবশাহীর কাছে পবিত্র ও ইসলামী ভাষা। আর আমার বাংলা ভাষা হল হিন্দুদের।
পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার প্রায় অর্ধশত বছর হতে চলল। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করতে হয়, এখনও এই স্বাধীন বাংলায় অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের ভাষাকে উর্দু বা আরবির চেয়ে নিম্নমানের মনে করে। এখনও অনেকে এ ভাষাকে অজু করানোর চেষ্টা করে যাচেছ। এদের সস্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। ভাষার মালিকানা সেই ভাষাভাষী সকল মানুষের। ভাষার মালিকানা কোন শাসকের নয়, কোন রাষ্ট্রেরও নয়। তাই তো শাসকদের ফসিলের উপর দিয়ে রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে গিয়েও একই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষগণ নিজেদের আপন করে নেয়, একটি অভিন্ন সংস্কৃতির ছাতার নিচে মনের শীতলতা খোঁজে, ভাবের সাগরে একাকার হয়ে যায়।
(০৬ মার্চ, ২০১৭; ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)
সূত্রঃ
১. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক (২০০৯): বাংলার ইতিহাসঃ ভারতের ইংরেজ রাজত্বের সূচনাপর্ব (১৬৮৯-১৭২০)। বাংলা একাডেমি
২. বাংলাপিডিয়া