Published : 18 Jun 2016, 11:39 PM
পুলিশের সাথে 'বন্দুকযুদ্ধে' গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম নিহত হয়েছেন। ফাহিম বলেছিলেন, 'তাকে আটকে রাখা সম্ভব হবে না'। তাঁর কথাই সত্য ছিল, তাকে আটকে রাখা যায়নি।
কয়েকদিন আগে মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে জখম করার সময় হাতেনাতে আটক হয়েছিল গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম। রাজধানীর দক্ষিণখানের ফাইদাবাদের বাসিন্দা ফাহিমের বয়স মাত্র বিশ বছর। ২০১৪ সালে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পাওয়া ফাহিম এবার উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছিলেন।
শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর সাথে ফাহিমের কিসের দ্বন্দ্ব ছিলো? ব্যক্তিগত শত্রুতা দূরে থাক, একের সাথে অপরের চেনা-জানাও ছিল না। বিনা অপরাধে, বিনা শত্রুতায় একজন মুসলমান কেন একজন হিন্দুকে হত্যার চেষ্টা করলো? এ কিসের নেশা?
পুলিশের বরাতে প্রকাশ, জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুল্লাহ বলেছিলেন যে তিনি নিষিদ্ধ ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফাহিমের সহপাঠীরা জানান যে মাধ্যমিক পর্যন্ত তাঁর আচরণ স্বাভাবিক ছিল। তবে একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর আচরণে পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তন ছিল তাঁর ধর্মীয় উগ্রতা, ধর্ম নিয়ে কিছু বললেই তিনি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। কোনো সংবাদপত্র এটা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি যে শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে কোনো মন্তব্য করেছেন, ধর্মবিরোধী কোনো মতবাদ প্রচার করেছেন। তবে কিসের হাতছানিতে পরিবারের স্নেহ, ভালোবাসা ত্যাগ করে তাঁকে হত্যার নিয়তে ঘর ছেড়েছিলেন ফাহিম?
যদিও ধর্মীয় মতবাদের পার্থক্যের কারণে হত্যা করার ধর্মীয় বা আইনি কোনো ব্যাখ্যা নেই, তবুও ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর সাথে ফাহিমের ধর্মীয় মতবাদের কোনো বিরোধ নেই তাহলে তিনি কেন তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন? কোন জাদুবলে মোহাচ্ছন্ন হয়ে তিনি নিজ জীবনের মায়া পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন?
নিজের জীবনের বিনিময়ে ফাহিম কি চেয়েছিলেন? শহীদী 'জান্নাত'? আমরা কি জানি আর কতজন ফাহিমের পিছনে লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে?
কয়েক বছর ধরে শুনছি বাংলাদেশে জঙ্গিদের একটি স্লিপার সেল কাজ করেছ। স্লিপার সেল হলো এমন একটি ঘাতকের দল যারা যতক্ষণ না আক্রমণ করে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে সনাক্ত করা খুবই মুশকিল। এরা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে, তারা জানে তাদেরকে একটি 'গুরুত্বপূর্ণ' কাজ করতে হবে কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত জানে না সে কাজটা কি। নির্দেশ প্রদানের অল্প কিছুকাল আগে এরা স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নেয় এবং সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিকতার পরজীবী হয়ে ওঠে। পারলৌকিক মোহাবিষ্ট এ সকল সদস্যদেরকে নির্দেশের সাথে সাথে 'অপারেশনে' যেতে হয়; অর্থাৎ নির্দেশ প্রদান ও কার্যসম্পাদনের মাঝে সময় এতটাই কম থাকে যে তখন তাদের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি সক্রিয় হয়ে ওঠার আগেই এরা কাজটি করে ফেলে। টার্গেট ক্লিলিংয়ে তাই স্লিপার সেলের সদস্যকে ব্যবহার করা হয়।
স্লিপার সেলের সদস্য না হলে ফাহিম এ কাজ হয়তো সে কখনোই করতেন না। সুস্থ স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ কোনো মানুষের পক্ষে উদ্দেশ্যহীন এমন জঘন্য কাজ করা সম্ভব নয়। বিপ্লবের, বিদ্রোহের চেতনাবোধ তরুণ-যুবাদের মধ্যে বেশী বলে স্লিপার সেলের সদস্য হিসেবে এদেরকে নির্বাচন করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন টার্গেট কিলিংয়ের সাথে জড়িত সন্দেহে যাদেরকে আটক করা করা হয়েছে তারা সবাই তরুণ যুবক। এদের তেমন কোনো রাজনৈতিক ইতিহাস নেই, এরা একেবারে 'ফ্রেশ রিক্রুটমেন্ট'। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। এদের পিতামাতারাও জানে না তাদের আদরের সন্তানটি হয়তো কালকের সূর্যটা দেখতে দেখবে না। এরা আত্মঘাতি, তাই ভয়ানক; এরা মানুষরূপী 'জমবি' (zombie বা জীয়ন্ত লাশ), তাই বিবেকহীন; এরা ওপারের স্বপ্নে বিভোর, তাই অপ্রতিরোধ্য।
এই ধরণের অপমৃত্যু দিয়ে কী 'জান্নাত' পাওয়া যায়! যদি তাই হয় তবে এত কষ্টেসৃষ্টে ধর্মপালনের প্রয়োজনীয়তা কি? হুশ হারিয়ে ঠুস করে একদিন কিছু একটা…।
====০====