Published : 04 Apr 2015, 01:22 PM
দৃষ্টান্তে সংজ্ঞার খোঁজ
'তুমি কিন্তু তৃতীয় ওভার শুরু করার আগ পর্যন্ত চমৎকার খেলেছো',- ক্রীড়া অভিভাবকের এই মন্তব্যের জবাবে ক্রিকেটার বললো, 'থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার'। এদিকে দেরীতে আসা শিক্ষার্থিকে ক্লাসরুমে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার সময় শিক্ষক বললেন, 'উই আর ওয়েটিং ফর ইউ', আর এটা শুনে শিক্ষার্থিরও একই উচ্চারণঃ থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। উভয় ক্ষেত্রেই শ্রোতা ত্রুটিপূর্ণ অনুধাবনের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ মন্তব্যের মূলভাব বুঝতে অসফল হয়েছে। আসলে 'তুমি কিন্তু তৃতীয় ওভার শুরু করার আগ পর্যন্ত চমৎকার খেলেছো'- এটা বলে বক্তা যা বুঝিয়েছেন তা হলো, 'তৃতীয় ওভার থেকে তুমি খুব বাজে খেলেছো'; আর 'উই আর ওয়েটিং ফর ইউ' বলে শিক্ষক যা বুঝিয়েছেন তা হলো, 'ইউ আর লেইট'। আর উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত জবাব হতে পারতো, 'আই এ্যম সরি…'।
অভিধান কী বলে
' Euphemism (সুভাষণ) is a word or phrase used to avoid saying an unpleasant or offensive word', অর্থাৎ ইউফ্যামিজ্ম হলো অস্বস্তিকর বা কষ্টদায়ক শব্দ পরিহার করে ব্যবহৃত ভিন্ন শব্দ। এ ক্ষেত্রে বাক্যের মূল বক্তব্যের কোনোরূপ অর্থ বিকৃতি ঘটেনা, বরং উপস্থাপনা প্রাঞ্জল হয় (যদিও কখনও কখনও দ্ব্যর্থবোধক হয়ে উঠে) এবং তা শ্রোতাকে বিব্রত করেনা বা যথাসম্ভব কম করে। যেমন 'পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটি মুক্তিযোদ্ধার জন্য অপমানজনক। 'যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা' বললে সুন্দর হয়। তেমনি 'এক ঘণ্টার মধ্যে রক্ত জোগাড় করতে হবে, না হলে রোগী মারা যেতে পারে'-এর পরিবর্তে 'এক ঘণ্টার মধ্যে রক্ত জোগাড় করতে হবে, না হলে রোগীকে বাঁচানো মুশকিল হবে'-এটি বলা উচিৎ, কারণ রোগীর আত্মীয়দের কাছে 'মৃত্যু' এক ভীতিকর শব্দ, যা তারা শুনতে চায়না। একইভাবে, 'তিনি খাটো'-এই বাক্যের ইউফ্যামিস্টিক রূপ হতে পারে 'তিনি আরও লম্বা হলে ভালো হতো'। ডিসফেমিজ্ম (Dysphemism)হলো ইউফ্যামিজ্ম-এর বিপরীতার্থক শব্দ।
হরেক রকম ইউফ্যামিজ্ম
বাংলা ও ইংরেজিতে বহুল ব্যবহৃত ইউফ্যামিস্টিক শব্দগুলোর কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলোঃ
Dysphemistic (কুভাষণ) | Euphemistic(সুভাষণ) |
আপনি না আসাতে বেশ ক্ষতি হয়েছে | আপনি যদি আসতে পারতেন, তাহলে অনেক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচা যেতো |
আমার গ্রামে অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি | আমার গ্রামে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা তুননামূলকভাবে বেশি না |
তিনি আনস্মার্ট, তাই তাকে নেয়া গেলোনা | তিনি স্মার্ট হলে নেয়া যেতো |
তিনি খাটো মানুষ, তবে বেশ চতুর | লম্বায় তিনি তেমন না হলেও বুদ্ধিতে কিন্তু অসাধারণ |
এ তো খুবই বাজে লেখা, এইরকম লেখা লেখলে পরিক্ষায় আর জিন্দেগীতে পাশ জুটবেনা | এই লেখা প্রমাণ করে যে, তুমি পারো বা না পারো, চেষ্টা করতে জানো। আর এই চেষ্টাটা চালিয়ে গেলে আগামিতে ভালো লেখা অবশ্যই সম্ভব। |
বিষয়টি আমাকে জানালে উপকৃত হতাম | বিষয়টি আমাকে জানতে দিলে উপকৃত হতাম |
তিনি প্রচুর মিথ্যা বলেন | সত্য বলার ক্ষেত্রে তিনি ভীষণ মিতব্যায়ী |
Deaths in an accident/a war | Casualty |
Bribe | Pay to play/ speed money |
Die | Pass away |
Unemployed | Jobseeker |
Housewife | Homemaker |
Maid-servant | Home help |
Prostitute | Escort |
Sex slave (Woman forced into sex) | Comfort woman |
Unwanted/accidental pregnancy | Unintended pregnancy |
Abortion | Pregnancy termination |
Disabled | Differently able |
Mass firing of employees | Layoff/ RIF |
Old person | Senior citizen |
Illegal immigrant | Illegal alien |
Have sex | Sleep together |
Vomit bag | Motion discomfort bag |
Toilet | Rest room |
Toilet paper | Bath tissue |
Unwanted mass killing/ geno cide | Collateral damage |
Garbage collector | Sanitation worker |
Garbage dump | Sanitary landfill |
Alcohol | Adult beverage |
Ugly | Appearance deficit |
রাজনীতিতে কেনো জরুরী
প্রথম কথা হলো বিশ্বব্যাপী ইউফ্যামিজ্মের ব্যবহার রাজনৈতিক প্রয়োজনেই বেশি হয়ে থাকে। পতিতার আধুনিকায়ন করেছেন রাজনীতিবিদরা ইউফ্যামিক টার্ম 'যৌনকর্মী'-ও তাদেরই সৃষ্টি। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর প্রেসিডেন্ট কিংবা কুটনীতিকদের বক্তব্যে
বিভিন্ন সময়ে তীব্র সমালোচনা হুমকি-ধমকির বহু নজির পাওয়া যায়, যেগুলো এই ইউফ্যামিজম শিল্পে মোড়ানো, কুৎসিত শব্দের গলাফাটানো উচ্চারণে নয়। বুশ কিংবা ওবামার অনেক বক্তব্যেও এমন অসংখ্য উচ্চারণ আছে যা শিষ্টাচারের পরিচয় বহন করে এমনকি তীব্র উষ্মা প্রকাশের ক্ষেত্রেও। আমি উষ্মার প্রকাশকে উৎসাহিত করছিনা বরং উচ্চারণের নগ্নতা পরিহার করে শব্দের সুন্দরকে ধারণ করার প্রয়োজনের কথা বলছি। বাংলাদেশকে ওরা উন্নয়নশীল দেশ বললে আমাদের খারাপ না লাগেনা কারণ ওরা 'গরীব দেশ' বলেনা। এটাও একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিজাত ট্যাগিং, যা পুঁজিবাদী দেশগুলো আমাদেরকে উপহার দিয়েছে। আমরাও হাসিমুখে তা গ্রহণ করেছি। নিজেদেরকে উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক ভাবতে পারছি, গরীব দেশের না। একজন মাওলানা সাহেবকে আমরা যেমন পানশালাতে দেখতে চাইনা, তেমনি রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকেও অশ্লীল, অপরিশীলিত শব্দের উচ্চারণ শুনতে চাইনা। তাই শব্দের এই শিষ্টাচার একজন রাজনীতিবিদের দরকার।
রাজনীতি কিভাবে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে তা আমাদের চেয়ে আর কে ভালো জানে? আবার অর্থনীতি যেহেতু জীবন
থেকে আলাদা নয়, তাই জীবনও রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়। সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক আচরণ আর ভাষাপ্রয়োগে শিষ্টাচারের সংকট বেশ স্পষ্ট। জনসভা, টিভি টক শো, সংবাদ সম্মেলন কিংবা সংসদীয় বিতর্কে ভাষার এমন অসংখ্য অপরিশীলিত ও বিরূপ প্রয়োগ আমাদেরকে প্রতিনিয়ত আহত করছে, বিব্রত ও লজ্জিত করছে। যেহেতু শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদগণ এসবের চর্চা করছেন আর মিডিয়ার কল্যাণে এসব ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশজুড়ে, দেশের জনগণের বিরাট একটা অংশে এসব অশালীন, উদ্ধত উচ্চারণ, আচরণ যেনো ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ ঘটিয়ে চলছে। মিছিল, মিটিং, টক-শো ছাপিয়ে এইসব অপরিশোধিত শব্দপ্রয়োগের সংস্কৃতি শিশুদেরকেও রেহাই দিচ্ছেনা। তাই শব্দের এই শিষ্টাচার একজন রাজনীতিবিদের দরকার।
শিক্ষাক্ষেত্রে কেনো জরুরী
রাজনৈতিক অঙ্গনের এই সঙ্কট আসলে আরেকটি বড় সঙ্কটের ইঙ্গিতবাহী আর সেটি হলো শিক্ষার সঙ্কট। আর শিক্ষার কথা আসলে শিক্ষাক্ষেত্রের কথাও চলে আসে। সেটা শুধু রাজনৈতিক নেতাদের অর্জিত শিক্ষা নয়, দেশের নাগরিকদের জন্য প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও সমানভাবে তাৎপর্যবাহী। মেজাজ খারাপ হলে আমরা আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার
করি, কিন্তু সেটা সবক্ষেত্রে নয়। ক্ষেত্র সংক্রান্ত জ্ঞানের পাশাপাশি মাত্রাজ্ঞানটাও গুরুত্বপূর্ণ। আবার শিক্ষিত মানুষ হিসেবে শব্দচয়নে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়ার বিষয়টিও কম গুরুত্বের নয়। দুঃখজনক হলো, এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষকদের একটা বিরাট অংশের কোনো ভূমিকা নেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শহর কিংবা গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোতে যারা পড়াচ্ছেন তারা অবলীলায় ক্লাসে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করছেন এবং পড়ানোর নাম করে প্রায়ই অশ্রাব্য ভাষায় শিক্ষার্থিদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ছেন। দিনের শেষে শিক্ষার্থির মস্তিষ্কে তার শিক্ষকের নিষ্ঠুর আচরণ আর রূঢ় শব্দগুলো সেঁটে থাকে। তার পারসোনালিটি গড়ে উঠে এইসব শব্দের উচ্চারণ আর উপলব্ধিতে। পারসোনালিটির শৈশব-কৈশোর এখনও এভাবেই বেড়ে উঠছে। কারও সন্দেহ হলে সরেজমিন খোঁজ নিলেই বিষয়টি পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ সমস্ত বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের প্রধানদের এ ব্যপারে কোনো মাথাব্যথা নেই কারণ তারা নিজেরাও একই রোগে আক্রান্ত। ইউফ্যামিজ্ম তো দূরে থাক, সাধারণ বাংলা বাক্যের বিন্যাসেই হাজারও সমস্যা। ইংরেজির অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। মাধ্যমিক/উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে বাংলা/ইংরেজি পড়াচ্ছেন যারা তাদের কতোজন যে অন্ধকার ফেরি করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন তা জানতে হলে আপনাকে সামান্য অনুসন্ধিৎসু হতে হবে। তবে আগামি ২১শে ফেব্রুয়ারিতে স্কুল-কলেজে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য যদি আপনার হয় আর ওখানে উপস্থিত সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের বক্তব্য শুনে আপনার যদি বুক ব্যথা করে তবে বুঝবেন আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো এমনটি হবে। রোগের বিস্তার থেমে নেই।
শেষ কথা
ইউফ্যামিজ্মকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা যারা করেন তাদের যুক্তিগুলো মেনে নিয়েও এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটি সকল শিক্ষিতজনের বাক্চর্চায় ব্যবহৃত হলে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে দূষণ কমার একটা সুযোগ হতো।