ঝড় গেছে, এবার ক্ষতির হিসাব

সিত্রাংয়ের আঘাতে ক্ষতির চিত্র বেরিয়ে আসছে; পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সপ্তাহ দুয়েক লাগবে বলে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2022, 07:06 PM
Updated : 25 Oct 2022, 07:06 PM

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটে খাবি খাওয়ার মধ্যে এই বছরই বাংলাদেশে বন্যা পৌনে লাখ কোটি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে গেছে, এর মধ্যেই আঘাত হানল ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং।

ঝড় কাটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক চিত্র না মিললেও এতে যে হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে যে পড়তে হচ্ছে, তা অনুমেয়।

কেননা দুই বছর আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির হিসাব দিয়েছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

আম্পানের মূল ধাক্কা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে না গেলেও সিত্রাং পুরোটাই গেছে বাংলাদেশের উপর দিয়ে। তবে এর ধ্বংস ক্ষমতা আগের ঝড়টির চেয়ে কম ছিল।

আম্পানে ১৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেলেও সিত্রাংয়ে নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ২৫ ছাড়িয়েছে, আরও কয়েকজন নিখোঁজও রয়েছেন।

আম্পানে আমের বেশ ক্ষতি হয়েছিল, আর সিত্রাংয়ের সময় ক্ষেতে ছিল আমন ধান। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য ধানের মূল জোগানই আসে আমন থেকে।

পরিপক্ক এই ধান কাটার সময় যখন হচ্ছিল, তখন ঝড়ের তোড়ে অনেক স্থানেই গাছ নুয়ে পড়েছে। উপকূলে অনেক মাছের ঘেরও ভেসে গেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্য বলছে, ৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি এবং ১ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই ঝড়ে। গবাদি পশু তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

মোট ৪১৯টি ইউনিয়নে ঝড় ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে। উড়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার ঘর। কিছু স্থানে সড়ক ভেঙেছে, বাঁধও ভেঙেছে। 

Also Read: বন্যায় ক্ষতি ৮৭ হাজার কোটি টাকার

প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে ক্ষতির পরিমাণ আশঙ্কার চেয়ে কম বলে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পরপর তিন বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা তার হাঁফ ছাড়ারই প্রকাশ।

তার ভাষ্যে, যেভাবে সিত্রাং সৃষ্টি হয়েছিল, এর যে বিস্তৃতি ছিল, যে পূর্বাভাস ছিল, তাতে অনেক ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা জেগে উঠেছিল, তবে তেমনটা হয়নি।

তবে ক্ষতি কম হলেও এই সময়টায় সেটাই বড় বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং সানেম’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হলেও একেবারে নগণ্যও নয়। এবারের বিষয় হচ্ছে, আগে থেকেই মানুষ নানামুখী চাপের মধ্যে আছে। খাদ্য শস্যের দাম এখনই অনেক বেশি।

“এবার উৎপাদন কম হবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল থেকে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতির মধ্যে হয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতিকে ত্বরিতভিত্তিতে আমলে নিতে হবে।”

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষতিপূরণসহ যেসব পূনর্বাসন পরিকল্পনা নেওয়া হবে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন অর্থনীতির এই গবেষক।

তিনি বলেন, “মাঠের যেসব ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের হাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি সহায়তা যাতে পৌঁছানো যায়; সরকারকে এই দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।”

ফসলহানি, ঘেরের ক্ষতি, সড়কে ভাঙন, বিদ্যুতে বিঘ্ন

সার্বিক চিত্র না পাওয়া গেলেও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে স্থানীয় পর্যায় থেকে ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতেই ক্ষতি হয়েছে বেশি।

চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোর মধ্যে বাঁশখালীর সাধনপুর, খানখানাবাদ; সন্দ্বীপের সারিকাইত, মগধরা, আজিমপুর, মাইটভাঙা ও কালাপানিয়া এলাকায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে সাগর তীরে বসবাসকারী প্রায় আড়াইশ জেলে পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছে।

জেলেপাড়ার বাসিন্দা লিটন দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘরে জাল ছিল, বড় জাল। একার পক্ষে বের করা সম্ভব না। আমার ছোট ছেলে আর বউ ছিল ঘরে। তুফান শুরু হলে রাস্তার উপর চলে আসছি। কিন্তু ঘরের কিছু বের করতে পারিনি।”

বাঁশখালীর সাধনপুরে সাঙ্গুর বাঁধ এবং খানখানাবাদের দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙেছে জানিয়ে ইউএনও সাঈদুজ্জামান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেখেরখীল ও চাম্বল এলাকায় জলকদর খালের পাড় ভেঙে পানি ঢুকেছে। সাগর তীরের বেড়িবাঁধ উপচে মাছের ঘের ও ধানের জমি ভেসেছে।

“প্রাথমিক হিসাবে প্রায় ৫৫০ হেক্টর জমির আমন এবং ১৫০ হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে। কিছু বাড়িঘরেও লোনা পানি ঢুকেছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলো ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করলে মোট ক্ষয়ক্ষতি জানাতে পারব।”

সন্দ্বীপের ইউএনও সম্রাট খীসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সারিকাইত, মগধরা, আজিমপুর, মাইটভাঙা, কালাপানিয়া এবং পৌরসভায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মাটি দিয়ে তা মেরামতের চেষ্টা হচ্ছে।”

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের হিসাবে জেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ৯৪টি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৭৬০টি বাড়িঘর।

জেলার ৬৬টি ইউনিয়নের ৫৮ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম।

বরগুনায় কৃষি ও মৎস্য খাতে অন্তত ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

বরগুনার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আবু সৈয়দ জুবায়েদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমন ধানের ক্ষতি তেমন না হলেও জোয়ারের পানি আর বৃষ্টিতে ২০ হেক্টর জমির সবজি এবং ৪ হেক্টর জমির পানের বরজের ক্ষতি হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বেড়ি বাঁধের বাইরে ও নিচু স্থানের ৪৫৭টি মাছের খামার ও ৩৮টি পুকুরের ৮২ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে।

পোনা মাছ ও অবকাঠামোগত ক্ষতিসহ মৎস্য খাতে ১ কোটি ৩ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির হিসাব কষছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা।

জেলার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান জানান, ৩৬৮ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে। প্রাণী সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী অন্তত ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, জেলায় ৮৫০ হেক্টর রোপা আমন, ৩৭৫ হেক্টর সবজি, ১৭ হেক্টর পান, ৩৩ হেক্টর কলা, মরিচ বীজতলা, ৫২৫টি মাছের ঘের ও ২২৫টি পুকুর ভেসে গেছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৭২ লাখ টাকা।

মাদারীপুরে ৫০০ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পিরোজপুরে ৬৪ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। ৩২৯টি পুকুর থেকে মাছ বেরিয়ে গেছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঝড়ে বিভিন্ন বিতরণ সংস্থার প্রায় দুই হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৮০ লাখ গ্রাহক এখনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছেন। তবে বিকালের মধ্যে এর ৭০ শতাংশ বিদ্যুতের আওতায় চলে আসবে বলে আশা রাখেন তিনি।

এখনও অচল হয়ে আছে দেশের চারটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির ৫৮১৪টি সাইট। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে দেশের উপকূলীয় ১৯ জেলায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে জানিয়েছে বিটিআরসি।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিটিআরসি’র দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ঝড়ে চার মোবাইল অপারেটরের ১৩ হাজার ৯০২টি সাইটের মধ্যে ৭৩৪২টি সাইট অচল হয়ে পড়ে। তার মধ্যে ১ হাজার ৫২৮টি সাইট কোম্পানিগুলোর নিজস্ব চেষ্টায় সচল করেছে। বাকিগুলোও সচল করার চেষ্টা চলছে। 

পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের অপেক্ষা, পুনর্বাসন দ্রুত: প্রতিমন্ত্রী

ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “মাঠ প্রশাসন এটা এসেস করবে, তারপর জেলা পর্যায়ে ডিসিরা আমাদের কাছে রিপোর্ট পাঠাবে। এরপর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে। সেখানে যার যার মন্ত্রণালয় ক্ষয়ক্ষতি উপস্থাপন করবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা সহায়তা ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু করব।”

পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে ৭ থেকে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে বলে ধারণা দেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ফসলিজমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৬ হাজার হেক্টর এবং ১ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি জানান, নিহত যারা হয়েছেন, তাদের মৃতদেহ সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা, বাড়ি মেরামতের জন্য টিন এবং গৃহনির্মাণ মজুরীর জন্য নগদ অর্থ দেওয়া হবে।

এনামুর বলেন, “আগেও মৎসঘেরে ক্ষতি হয়েছে, যদিও এবার সামান্য। তারপরও ক্ষতিগ্রস্ত মৎসচাষিদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে। যে যে পরিমাণ আবেদন করবে, সে অনুযায়ী সাধারণত দেওয়া হয়। আমরা জেলা প্রশাসনকে বলেছি চাহিদা পাঠাতে। আগামীকাল চাহিদা এলেও আমরা বরাদ্দ দিতে পারবো। আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ টিন ও নগদ টাকা আছে।”

ঘূর্ণিঝড়ের সময় ৬ হাজার ৯২৫ আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ উঠেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্গতদের রান্না করা এবং শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।