বঙ্গবাজারের ভয়াল আগুন নেভাতে সময় যত বাড়ছিল দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা বাড়ছিল ব্যবসায়ীদের; পুরো এলাকা ভারি হয়ে উঠেছে কান্না আর আহাজারিতে।
Published : 04 Apr 2023, 06:15 PM
"নতুন মাল তুলেছি, গত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত দোকানে মাল গুছিয়ে বাসায় গিয়েছি। সকালে উঠে এসে দেখি সব শেষ। দেড় লাখ টাকা ক্যাশ ছিল, রাত বেশি বলে বাসায় নিয়ে যাইনি। টাকাটাও কাপড়ের সঙ্গে পুড়ে গেছে।"
বঙ্গবাজারের পাশে ফ্লাইওভারের নিচে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন।
শোনা গেল তিনি বলছেন, “মা আমি এখন সংসার চালাব কেমনে, আমার সব শেষ, মা আমার সব শেষ। আমার কিছুই নাই। সব তো দোকানে দিছি।"
মায়ের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন তখন নজর গেল মাঝবয়সী এ ব্যক্তির দিকে। কথা শেষে কান্না থামার পর একটু ধাতস্থ হতে বললেন ঈদের আগে সব পুঁজি ঢেলেছেন দোকানে। আগের রাতেও নতুন আনা মালপত্র গোছাতে গোছাতে মধ্যরাত পেরিয় যাওয়ার কথা বললেন। হাতে থাকা বাকি নগদ টাকাও যে খোয়ালেন সে আফসোসও বলে গেলেন এক নাগাড়ে।
সব হারিয়ে এখন যে কী করবেন তা বুঝে ওঠার মতো মানসিক স্থিরতাও এখন নেই তার। বড় ছেলে বুয়েটে আর মেয়ে ভিকারুন্নেসায় পড়ছে জানিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আজিমপুরের বাসিন্দা এ ব্যবসায়ী বলেন, তাদের পড়ার খরচইবা দেবেন এখন কীভাবে।
“আমার দেড়-দুই কোটি টাকা শেষ। আমার সব শেষ, আমি এখন কী করুম," ধরা গলায় বলে চলেন তিনি।
মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস মিনিট দুইয়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেও বাতাসের মধ্যে ঘিঞ্জি ওই মার্কেটের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ততক্ষণে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন।
ঈদ সামনে রেখে বঙ্গবাজার ও আশেপাশের মার্কেটের সব দোকানেই প্রচুর নতুন পণ্য তোলা হয়েছিল। কীভাবে সেখানে আগুন লাগল তা এখনও স্পষ্ট নয়।
দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে ঈদের আগে সব মালামাল খুঁইয়ে ব্যবসায়ীদের এখন পথে বসার জোগাড়। ভয়াবহ আগুনে বিশাল এ ঘিঞ্জি মার্কেটের দোকান ও গুদাম সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।
সকাল থেকে আগুনের খবরে সেখানে জড়ো হতে থাকেন দোকানি-ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। আগুন নেভাতে যত সময় বাড়ছিল তাদের দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা বাড়ছিল। বঙ্গবাজার ও আশপাশের মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ছোটাছুটি ও কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
আশপাশের বিভিন্ন ভবনের নিচে শত শত ব্যবসায়ীকে নিজের সব হারিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়।
সকালে আগুন লাগার পর ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের যারা সেখানে ছিলেন কিংবা খুব দ্রুত আসতে পেরেছেন তাদের মরিয়া হয়ে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। তবে ভয়বাহ আগুনের হাত থেকে বেশির ভাগই কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। চোখের সামনে নিজের জীবিকার সব সম্বল পুড়তে দেখে অসহায়ভাবে কাঁদছিলেন অনেকে। বছরের বড় এ বিক্রয় উৎসবের কালে দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম ও স্বপ্নটুকুও যেন আগুনে উবে যেতে দেখেন।
"মা আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে, আমার সব শেষ। মার্কেটে আগুন লাগছে," সকাল বেলা ফোন পাওয়ার পর প্রথম কথাতেই ছেলে একটানে এভাবেই অসহায়ত্বের এ কথা জানায়।
বঙ্গ মার্কেটের ইন্টারনেট ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বাপ্পির ফোন পেয়ে আর আগুনের কথা শুনে আর বাসায় থাকতে পারেননি তার মা সাবিনা বেগম। নতুন বাজার থেকে ছোট ছেলেকে নিয়ে বঙ্গবাজারে ছুটে এসেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "সকালে আমার ছেলে বাপ্পি ফোন করে বললো দোকানে আগুন লাগছে। সে ইন্টারনেট ব্যবসা করত, বঙ্গমার্কেটে ওয়াইফাই ব্যবসা করত। সব টাকা পয়সা নিয়ে এসে ব্যবসা বড় করেছে। এখন কী করবো? সকালে আসছি এখন দুপুর হয়ে গেছে, ছেলেরও দেখা পাইনি, ফোন বন্ধ।"
ছেলের দোকানে আগুন লেগেছে শুনে সাভার থেকে এসেছেন মো. শাজাহান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "ছেলেটা ফোন করে বললো আমাদের মার্কেটে আগুন লাগছে। দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার সব শেষ আব্বা। এখন আসছি, ছেলের ফোন বন্ধ কোথায় আছে খুঁজতেছি।"
বঙ্গবাজারের কাদের ক্লথস এর মালিক আব্দুল কাদের বলেন, "সকাল সাতটার দিকে কেরানিগঞ্জের এক পার্টি ফোন করে বলল মার্কেটে আগুন লাগছে। খবর পেয়ে দ্রুত এসে দেখি আমার সব শেষ।
“আমার দুইটা দোকান একটা গোডাউন, আমার দোকানে সব গার্মেন্টের শার্ট। ৫০ হাজার পিছ শার্ট ছিল গোডাউনে, ঈদ উপলক্ষে সব মাল নিয়ে আসছি, আমার প্রায় দেড় কোটি টাকার শার্ট আগুনে পুড়ে শেষ।"
আরেক ব্যবসায়ী মো. মজিবুর রহমান বলেন, "ভাই, ভিতর থেকে কথা আসতেছে না। কথা বলতে পারছি না। আমার সব শেষ। নিজের ও ধার দেনা করে ঈদ উপলক্ষে মাল নিয়ে আসছি, কালেকশন করে মাল তুলছি। সারা বছর রমজানের আশায় থাকি, ঈদে ব্যবসা হবে, সব শেষ।
সবেমাত্র ঈদের কেনাকাটা জমতে শুরু করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এমন সময় আগুন লাগলো, আগামাছি লেইনের বাসা থেকে বাইর হইয়া আগুনের ধোয়া দেইখাই বুছছি আমার সব শেষ।"
বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় আবেগাক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ড: ঈদের আগে পুড়ে ছাই জীবিকার সম্বল