রাষ্ট্রপক্ষ-দুদকের সঙ্গে সুইস রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য ‘সাংঘর্ষিক’: হাই কোর্ট

এ বিষয়ে শুনানিতে আদালত বলেছে, রাষ্ট্রদূতের ওই বক্তব্য ‘বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে’।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2022, 08:20 AM
Updated : 14 August 2022, 08:20 AM

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের তথ্য চাওয়া হয়নি দাবি করে দেশটির রাষ্ট্রদূত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বক্তব্যের সাথে ‘সাংঘর্ষিক’ বলে মন্তব্য করেছে হাই কোর্ট।

এ বিষয়ে রোববার রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের ব্যাখ্যা শোনার পর বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে এমন মন্তব্য আসে।

ঢাকায় সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি শুয়ার বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল আদালত।

রোববার এ বিষয়ে শুনানিতে আদালত বলেছে, রাষ্ট্রদূতের ওই বক্তব্য ‘বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে’।

এদিন রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক; দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।

গত বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত ‘ডিক্যাব টকে’ সাংবাদিকদের প্রশ্নে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি শুয়ার বলেন, সুইস ব্যাংকের কাছে ‘সুনির্দিষ্ট কারও তথ্য’ বাংলাদেশ চায়নি।

পরদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রাষ্ট্রদূদের ওই বক্তব্য ‘অসত্য’।

সেদিনই হাই কোর্ট এ বিষয়ে সরকার ও দুদকের ব্যাখ্যা চেয়ে আদেশ দেয়। সে নির্দেশনা অনুসারে রোববার বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ চারটি জাতীয় পত্রিকা এবং দুদক একটি পত্রিকার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে।

আদালত ওই প্রতিবেদন ও বক্তব্য ‘হলফনামা’ আকারে দাখিলের নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি ২১ অগাস্ট আদেশের জন্য রেখেছে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক শুনানিতে বলেন, “এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য ‘সঠিক নয়’, ‘মিথ্যা’ বলেছেন।”

আদালতকে এই আইন কর্মকর্তা বলেন, সুইস ব্যাংক চলতি বছরের ১৬ জুন বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরদিন এগমন্ড সিকিউর ওয়েবের (ইএসডব্লিউ) মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যাংক ও ব্যক্তির জমানো অর্থের বিষয়ে তথ্য চেয়ে বিএফআইইউ থেকে সুইজারল্যান্ডের এফআইইউকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে এখনও কোনো তথ্য বাংলাদেশ পায়নি।

অর্থপাচার ও সন্ত্রাসীকাজে অর্থায়ন প্রতিরোধ, অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য বিএফআইইউ বিদেশি ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী এ তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম হল ইএসডব্লিউ।

২০১৩ সালের জুলাই মাসে ইএসডব্লিউর সদস্য হওয়ার পর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৬৭ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বাংলাদেশ তথ্য চেয়েছে বলে আদালতকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

তিনি বলেন, “ইএসডব্লিউর মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের এফআইইউকে এ তথ্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু একজন ছাড়া অন্যদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বলে জানায় সুইজারল্যান্ড। আর এই একজনের তথ্য দুদককে দিয়েছে বিএফআইইউ।”

আদালতে আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, “রাষ্ট্রদূত না জেনে বক্তব্য দিয়েছেন। উনি সঠিক বলেননি।”

তখন বিচারপতি খিজির হায়াত বলেন, “তার মানে বাংলাদেশ চেষ্টা করেছে, উনারা তথ্য দেননি?”

জবাবে আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, “জি, রাষ্ট্রদূত সঠিক তথ্য বলেননি।”

Also Read: সুইস ব্যাংকের কাছে কেন তথ্য চায়নি সরকার, ব্যাখ্যা চায় হাই কোর্ট

Also Read: অর্থ জমার তথ্য নিয়ে সুইস রাষ্ট্রদূত মিথ্যা বলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

Also Read: সুইস ব্যাংকের কাছে ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য’ চায়নি বাংলাদেশ: রাষ্ট্রদূত

Also Read: সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের রেকর্ড টাকা, এক বছরে বেড়েছে ৫৫%

পরে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতে বলেন, “এখন এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের একটা বক্তব্য দিতে হবে। কারণ ডিক্যাব টকে উনার দেওয়া বক্তব্য সঠিক নয়। হুট করে কীভাবে এমন কথা বললেন, এটা আমাদের বোধগম্য নয়।”

দুদকের আইনজীবী আদালতকে জানান, ২০১৪, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে বিএফআইইউ থেকে দুদক তথ্য চেয়ে অনুরোধ করেছিল। বিএফআইইউ তখন সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর কাছে তথ্য চায়। কিন্তু বিএফআইইউ শুধু একটা তথ্য পেয়েছে।

“রাষ্ট্রদূত সেটা জানেন না। জানলে এমন বক্তব্য দিতেন না। এটা টোটালি ইগনোরেন্স (অজ্ঞতা) থেকে দেওয়া।”

তখন বিচারপতি খিজির হায়াত বলেন, “এ বক্তব্য বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। আপনাদের (দুদক-রাষ্ট্রপক্ষের) বক্তব্যের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করবে।”

রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের বক্তব্য শুনে বিচারপতি খিজির হায়াত রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের সাথে তা ‘সাংঘর্ষিক’ বলে মন্তব্য করেন।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, যা আগের বছরের চেয়ে ৫৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় ওই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

বিশ্বজুড়ে ধনী ব্যক্তিদের টাকা সুইস ব্যাংকে রাখার আগ্রহের পেছনে মূল কারণ দেশটির গোপনীয়তার নীতি। সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না।

তবে কোন দেশের গ্রাহকদের কী পরিমাণ অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা আছে, তার একটি ধারণা প্রতিবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি ওই তথ্য প্রকাশ করে। তবে সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য হল, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা জমা রয়েছে, তার বেশিরভাগটাই অবৈধভাবে অর্জিত এবং বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের কতজনের কত টাকা আছে তার তালিকা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতেও এক আদেশে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল হাই কোর্ট। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল সে সময়।