ডাক্তারি পড়ে অন্য পেশায় যাওয়ার ঝোঁক বাড়ছে কেন

এ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মতো একজন শিক্ষাবিদ এতে দেশের সেবা বঞ্চিত হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছেন।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2023, 07:48 PM
Updated : 25 July 2023, 07:48 PM

দীর্ঘ প্রচেষ্টা, পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় শেষে মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়েও চিকিৎসক হতে আগ্রহ কম তাদের; সংখ্যায় বা শতকরা হারে তা খুব বেশি না হলেও বছরওয়ারী হিসাবে সরকারি অন্য ক্যাডারে নাম লেখানোর এ সংখ্যা বাড়ছে।

অন্য ক্যাডারের পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে এমন এমবিবিএস ডিগ্রিধারীরা নিজেদের ভাবনা-যুক্তির কথা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা সুযোগ-সুবিধা ও ক্যাডার বৈষ্যমের প্রসঙ্গ তোলেন; আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মতো একজন শিক্ষাবিদ এতে তাদের কাছ থেকে দেশের সেবা বঞ্চিত হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিসিএসের মাধ্যমে ক্যাডারভিত্তিক সরকারি অন্য চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনেকে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কয়েক বছরের চাকরি ছেড়েও কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের চাকরি বাদ দিয়ে আসছেন।

এসব এমবিবিএস ডিগ্রীধারী গত কয়েক বছরে বিসিএসের প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, আয়কর, কাস্টমস ক্যাডারকে বেছে নিয়েছেন।

চিকিৎসা পেশা ছেড়ে গেছেন এমন ব্যক্তি এবং চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা সমসাময়িক সরকারি অন্য ক্যাডারে সুযোগ সুবিধা বেশি, চাকরির শীর্ষ পদে যাওয়ার সুযোগকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত ২ মার্চ চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা করে অন্য সরকারি চাকরিতে যোগদান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন।

সোমবার এমবিবিএস পাস করে অন্য ক্যাডারে চলে যাওয়ায় বিষয়ে আক্ষেপ জানিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এতে কয়েক বছরে পড়ালেখা, তাদের পেছনে খরচ করা অভিভাবক ও রাষ্ট্রের অর্থ বৃথা গেল। তাদের কাছ থেকে জনগণ সেবা পেল না।

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে এই দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে কিন্তু পড়ালেখা হচ্ছে। যারা সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ে তাদের একেকজনের পেছনে কোটি টাকা ব্যয় হয়। এটা ভুলে গেলে চলবে না। কাজেই জনগণের একটা দাবি রয়েছে তারা যেন চিকিৎসা পায় ভালো ডাক্তারের কাছে। কাজেই আমি আশা করব যারা এখানে আছ তারা যে শিক্ষাটা নিচ্ছ সেই শিক্ষাটা দেশের মানুষের জন্য কাজে লাগাও।”

মেডিকেলে শিক্ষার্থীদের পেছেন রাষ্ট্রের ও পরিবারের যথেষ্ট বিনিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  সেই জায়গা থেকে এটাকে অপচয়ই বলা যেতে পারে। এখানে আরেকটা ব্যাপার হয়, ওই শিক্ষার্থী মেডিকেলের একটা সিট দখল করে রাখল, সেখানে অন্য একজন পড়ালেখা করতে পারত।”

বিশেষায়িত শিক্ষা নেওয়ার পর তারা অন্য সাধারণ স্নাতকদের মতো হয়ে গেল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ফলে এদের এই পেশাগত যোগ্যতা কোনো কাজে লাগানো গেল না। দেশ তাদের সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হল।”

কোন ক্যাডারে যাচ্ছেন তারা

বাংলাদেশ ক্যাডার সার্ভিসে ২৬টি পদে নিয়োগ হয়। এরমধ্যে ১৪টি সাধারণ ক্যাডার এবং ১২টি কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডার। চিকিৎসকরা বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ পান।

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফল প্রকাশের পর সবশেষ নিয়োগ পাওয়া ৪০তম বিসিএসে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে অন্য ক্যাডারে গেছেন ২৩ জন। এরমধ্যে নয়জন প্রশাসনে, পাঁচজন পুলিশে, চারজন আয়কর বিভাগে, দুইজন কাস্টমস এবং অডিট, পররাষ্ট্র ও আনসার ক্যাডারে একজন করে নিয়োগ পেয়েছেন। ওই বিসিএসে মোট ১৯২৯ জন নিয়োগ পান।

এর আগের ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে ৪ হাজার ৭৯২ জনকে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার আগের ৩৮তম সাধারণ বিসিএসে ২২০৪ জনের মধ্যে ২২ জন চিকিৎসক অন্য ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন, যাদের মধ্যে পাঁচজন ডেন্টাল অনুষদের। এদের মধ্যে ছয়জন প্রশাসন, পাঁচজন পররাষ্ট্র, চারজন পুলিশ ও আয়কর, দুজন তথ্য এবং একজন অডিট ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন।

৩৭তম বিসিএসে ১৩১৪ জনের মধ্যে ১২ জন চিকিৎসক অন্য ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন, যাদের ৫ জন ডেন্টাল অনুষদের। তাদের মধ্যে ১০ জন প্রশাসন, একজন পররাষ্ট্র এবং একজন পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ২০২২ সালের হিসাবে দেশে ১ লাখ ৮ হাজার এমবিবিএস এবং ১১ হাজার ৩৫০ জন বিডিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক রয়েছেন।

কী বলছেন তারা

স্বাস্থ্য ক্যাডার বদল করা ডা. শিহাব সারার অভি ৩৭তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ পেয়ে বর্তমানে একটি জেলায় সহকারী কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, তার কখনই চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। পরিবারের চাপে মেডিকেল কলেজে পড়েছেন। পরে সুযোগ পাওয়ায় পেশা পরিবর্তন করেছেন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ডিগ্রিধারী একজন বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশে কর্মরত। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এমবিবিএস পাসের পরও সরকারি চাকুরি পাওয়ার অনিশ্চয়তা, চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় লাগার কারণে পেশায় পরিবর্তন করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, “বছরে ১০ হাজার চিকিৎসক ফিল্ডে আসছে কিন্তু একটা বিসিএসে চিকিৎসক নিয়োগ হচ্ছে ৫ বা ৬ হাজার। আবার দু-তিন বছর নিয়োগ বন্ধ থাকে। হেলথ ক্যাডারে চাকরির জন্য যে কম্পিটিশন একই কম্পিটিশন করে কেউ অন্য ক্যাডারে চলে যেতে পারে।

“বাংলাদেশে ডাক্তার হিসেবে খুব বেশি সম্মান পেতে হলে শুধু এমবিবিএস হলে হবে না, স্পেশালিস্ট হতে হবে। কিন্তু ওই জার্নিটাও সহজ না। আমাদের ব্যাচের ১৮০ জনের মধ্যে মাত্র দুই-তিনজন স্পেশালিস্ট হতে পেরেছে।“তার ভাষ্য, “মূল বিষয়টা হল যখন কেউ দেখছে যে পাস করার পরও তাকে আরও ৫-৬ বছর পড়াশোনা করতে হবে এরপর তিনি প্রমোশন পাবেন। তখন তার মনে হতেই পারে আমি আর পড়াশোনা করব না। একবারে পড়ালেখা করে বিসিএস দিয়ে অন্য সার্ভিসে চলে যাব।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাস্থ্য ক্যাডারের ২৩ জন কর্মকর্তা আছেন যারা গ্রেড-১ পাওয়ার যোগ্য হয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের দুই মহাপরিচালক শুধু গ্রেড-১ পান।

তার মতে এটি বৈষম্য। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তা বলেন, বাকিরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি পাবেন না।

“এই পদে থেকেই তারা অবসরে যাবেন। আমার এক বন্ধু স্বাস্থ্য ক্যাডার থেকে এডমিনে চলে গেছেন। তিনি অনেক আগেই যুগ্মসচিব হয়ে গেছেন। আর আমাদের পোস্ট আটকে আছে। এভাবেই চিকিৎসকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পেশা পরিবর্তনের এটাও একটা কারণ।”

স্বাচিপের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পেশা হিসেবে চিকিৎসকরা অবহেলিত, গুটিকয়েক ছাড়া বাকিরা ভালো অবস্থায় নেই। চিকিৎসকরা যে মেধা, যোগ্যতা দিয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছেন কিন্তু সরকারি অন্য ক্যাডারদের তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছেন। বৈষম্যের কারণেই চিকিৎসকরা সুযোগ পেলে পেশা পরিবর্তন করছেন।

“তারা যখন দেখছে পুলিশে, প্রশাসনে, ট্যাক্স ক্যাডারে গেলে হেলথের চেয়ে তাড়াতাড়ি পদোন্নতি হবে তখন তারা চলে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের জন্য গ্রেড ওয়ানের কয়টা পোস্ট আছে? তাদের মেধার মূল্যায়ন সরকারিভাবে কী করা হচ্ছে?”

তার মতে,”শুধু প্রাইভেট প্র্যাকটিস, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করবেন, কিন্তু যারা মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করে দিচ্ছেন তাদের মূল্যায়নটা কোথায়? এসব বহুবিধ কারণে চিকিৎসকরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।”

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সবাই সুন্দর নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা চায়। এ কারণে পেশা পরিবর্তন করছে। তবে সংখ্যাটা খুব বেশি না।

“চিকিৎসকরা কি রাজনীতি করেন না? মন্ত্রী হন না? পেশার পরিবর্তন মানুষ করেই, লক্ষ্য হচ্ছে তার জীবনমান উন্নত করা। সেবা করাটা মুখ্য না। সেবা দেওয়াটা যার কাছে মুখ্য, সে তো পেশা ছেড়ে যায় না। যে যাচ্ছে সে মনে করছে আমি চিকিৎসা দিয়ে টাকা কামিয়ে যে জীবনযাপন করব, তার চেয়ে অন্য পেশা আমার চেয়ে সহজ।”

তার চাওয়া দেশে এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠুক যেখানে জনগণের প্রত্যাশা এবং চিকিৎসক তার মনের মতো করে চিকিৎসা দিতে পারবেন।

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, পেশা পরিবর্তন বাংলাদেশে অন্য খাতেও আছে। কিন্তু বিষয়টি যখন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতির, তখন এটা গুরুত্ব বহন করে।

“কে কোথায় পড়বে, কোন পেশা বেছে নেবে সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নীতিমালার আওতায় তাদের নিরুৎসাহিত করা উচিত। তারা যখন মেডিকেলে পড়ছে তখন তাদের ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং করা দরকার।”

আরও পড়ুন:

Also Read: এমবিবিএস পাস করে চলে যাচ্ছে অন্য ক্যাডারে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আক্ষেপ

Also Read: চিকিৎসায় পড়ে অন্য চাকরির প্রবণতায় হতাশ প্রধানমন্ত্রী