একাত্তরে শহীদদের স্মরণ আর বিজয়ের আনন্দ উদযাপনে লাল-সবুজে সেজেছে পুরো দেশ; উদযাপনে নেওয়া হয়েছে বিস্তৃত কর্মসূচি।
Published : 15 Dec 2023, 11:29 PM
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের স্রোতধারা পেরিয়ে স্বাধীন দেশের পতাকা সগৌরবে উড়িয়ে বিজয় উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণ এল আবার।
দুই যুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল যে বাংলাদেশ, তার ৫২তম বার্ষিকী পালন হচ্ছে শনিবার।
গত ৫২ বছরে নানা অর্জনের সঙ্গে রয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘মুক্তি’ না মেলার হতাশা; সকল কাঁটা ধন্য করেই বাঙালি জাতি এগিয়ে চলেছে সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যাশায়।
একাত্তরে শহীদদের স্মরণ আর বিজয়ের আনন্দ উদযাপনে লাল-সবুজে সেজেছে পুরো দেশ; উদযাপনে নেওয়া হয়েছে বিস্তৃত কর্মসূচি।
এবার এমন এক সময়ে বিজয় দিবস এসেছে, যখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ; নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধীদের বর্জনের মুখে সমমনাদের নিয়ে ভোটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
ভোটের আগে আসা বিজয় দিবসের বাণীতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, “লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।”
দেশবাসীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া বাণীতে তিনি বলেন, “তাই আসুন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরো বেশি অবদান রাখি, দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আরো এগিয়ে নিয়ে যাই, গড়ে তুলি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ এবং প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’- মহান বিজয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।”
শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা হল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন।
“এই অর্জনকে অর্থবহ করতে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবাইকে জানতে ও জানাতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমরা পৌঁছে দেব- বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।”
১৯৪৭ সালের অগাস্টে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর বাঙালির নতুন সংগ্রামের সূচনা হয় পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল, দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।
বিজয়ের পর ৫২ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যায়িত করে যারা অপমান করেছিল, সেই তাদের কণ্ঠেই এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা। দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে।
বিদেশিদের ‘ষড়যন্ত্র’ মোকাবেলা করে নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি পদ্মা সেতুর চালু করেছে বাংলাদেশ। যোগাযোগ খাতের অগ্রযাত্রায় ঢাকায় মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, পদ্মাসেতু রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগসহ বিভিন্ন প্রকল্প চালু হয়েছে।
কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল মনে করেন, বিজয় দিবসে আসলে বাঙালির অর্জনের পাশাপাশি ত্যাগের উদযাপনই হয়।
একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধটা একইসঙ্গে আমাদের একটা ত্যাগের, দুঃখের কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বীরত্বের কাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু অর্জনের কাহিনী।
“পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় অর্জন আর কখনো হয় নাই। এত বড় বীরত্বও আর কোথাও দেখা যায় নাই। সবচেয়ে বড় কথা এত বড় দুঃখও কিন্তু আর হয় নাই।”
করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই ভূ-রাজনৈতিক সংকটের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি দেখা দেওয়ার কথা বিজয় দিবসের বাণীতে তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন।
তবে এই সংকট মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এ সংকট মোকাবিলায় সরকার সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ, বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্রদানসহ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমি আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আমরা এ সংকটও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো- ইনশাল্লাহ।
“এজন্য সকলের সহযোগিতার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতভিন্নতা যাতে উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত না করে সেদিকে সকলকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।”
দেশের অগ্রগতিতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, “স্বাধীনতার পর বিগত ৫২ বছরে আমাদের যা কিছু অর্জন তা জাতির পিতা এবং আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে।
“আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে, ইনশাল্লাহ।”
স্মরণে-উদযাপনে
জাতীয় পর্যায়ে শনিবার ভোরে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তববক অর্পণ করবেন।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
বাংলাদেশে অবস্থনরত বিদেশি কূটনীতিকরা, মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণকারী আমন্ত্রিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রদ্ধা জানানোর পর স্মৃতিসৌধ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন স্মৃতিসৌধে।
এদিন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে।
দেশের সকল শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহে বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং সিনেমা হলে বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হবে।
বিজয় দিবসে শনিবার সকাল সাড়ে ৬টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা, সকাল ৮টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা, সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে আওয়ামী লীগের পক্ষে।
পরদিন রোববার বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা হবে। সেখানে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।