ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? জার্সি-পতাকায় রমরমা

কাতারের স্টেডিয়ামে বাঁশি বাজার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ঢাকায় জার্সি আর পতাকার বিক্রি তত বাড়ছে; বিশ্বকাপ বাজারে এবার নতুন সংযোজন পতাকার রঙে লুঙ্গি!

মেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2022, 06:14 AM
Updated : 18 Nov 2022, 06:14 AM

ক্রেতাদের দরকষাকষি আর নানান প্রশ্নে নাকাল দশা ইমরান হাসান জয়ের, মাথার উপর ফ্যান ঘুরলেও দরদর করে ঘামছিলেন; চার বছর পরপর ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে তার এমন ব্যস্ততা আসে, তবে এবারের চাপটা যেন একটু বেশি।

খানিকটা ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, “এবারের বাজার অনেক ভালো। কাস্টমারের চাহিদা এত বেশি যে, প্রোডাকশন করে কুলাতে পারছি না।”

গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের জয় স্পোর্টসের এই দোকানির ব্যস্ততা এখন ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসর ঘিরে; আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পাশাপাশি বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের জার্সি বিক্রি করতে গিয়ে ক্রেতাদের চাপে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা তার।

বিশ্বকাপের সময় ঘনিয়ে আসায় গুলিস্তানের দোকানি জয়ের মত ঢাকার নিউ মার্কেট, মৌচাক মার্কেট, মহাখালী ও ফার্মগেইটের অনেক দোকানিরই ব্যস্ততা চলছে। ক্রেতাদের আনাগোনায় এসব মার্কেটে জার্সির দোকানগুলোর সামনে পা ফেলার ফুরসৎ নেই। বিশ্বকাপ উত্তেজনার আঁচ লেগেছে পতাকার দোকানেও। শেষ মুহূর্তের ব্যাপক চাহিদায় বেড়ে গেছে দামও।

গুলিস্তানের পাইকারি বাজার এবং আশপাশের খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, শেষ সময়ে এসে পাইকারিতে আর জার্সি ছাড়ছেন না অনেক দোকানি। বেশি দামের আশায় খুচরা বিক্রির দিকেই ঝোঁক তাদের।

বিক্রেতারা জানালেন, আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদা জার্সি আর পতাকার কাটতিই বেশি। তবে ব্রাজিলের হলুদ রঙা জার্সিও বিক্রিতে পিছিয়ে নেই। চাহিদা আছে জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল ফুটবল দলের জার্সিরও।

গুলিস্তানের চাঁদপুর খেলাঘর দোকানে জার্সি কিনছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরুল ফারহান ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আরাফাত ইয়াসিন। তাদের একজন কিনেছেন ব্রাজিলের জার্সি; অন্যজন আর্জেন্টিনার জার্সি পরে দেখছিলেন ঠিকঠাক লেগেছে কিনা।

আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে জড়িয়ে ইমরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “ছোটবেলা থেকেই আর্জেন্টিনা ফুটবল টিমকে সমর্থন করে আসছি, এবারের টিমটা একদম দুর্দান্ত; বিশ্বকাপটা আর্জেন্টিনার ঘরেই যাবে জানি।”

তার কথা শেষ না হতেই বাধ সাধেন বন্ধু আরাফাত। খুনসুঁটি করে বলেন, “আর্জেন্টিনা তো আরজিতেনা! ব্রাজিল এইবার চুপচাপ আছে, কারণ আমরা জানি ওস্তাদের মাইর…।”

চাঁদপুর খেলাঘরের ম্যানেজার সোহাগ গাজী বললেন, ক্রেতাদের এমন খুনসুঁটি তার ভালোই লাগছে, কারণ বিক্রিও হচ্ছে ভালো।

“এই যে সবাই এসে পছন্দের দল নিয়ে মিষ্টি তর্কে জড়ায়, এটা ভালো। চার বছর পর একেকটা বিশ্বকাপ আসে, এই সময়টায় আমাদের ব্যবসা যেমন ভালো হয়, ক্রেতারাও বেশ আনন্দ করেন।”

গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের আরেক ব্যবসায়ী এসবি স্পোর্টসের শাহজাহান ভূঁইয়া জানান, তার দোকানের আগের সব পণ্য বিক্রি হয়ে গেছে। এখন নতুন জার্সি আনা হয়েছে। জার্সির সাথে সাথে বিক্রি হচ্ছে ক্যাপ।

“আমার এখানে মোটামুটি সব দেশের জার্সিই আছে। তবে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জার্সি বেশি বিক্রি হয়। পাশাপাশি জার্মানিরও অনেকে সাপোর্টার আছে। বাকিগুলোর বিক্রি কম, দোকানে আনাও হচ্ছে কম।”

গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের বাইরে রাস্তার পাশে ফুটপাতের দোকানগুলোতে ভিড় চোখে পড়ার মত। মানের দিকে খানিকটা পিছিয়ে থাকলেও জার্সির দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় ক্রেতারা ভিড় করছেন এসব দোকানে।

বিক্রি কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে ফুটপাতে জার্সির পসরা সাজানো দুলাল মিয়া বলেন, “সবাই তো আর দামি জার্সি কিনতে পারে না। কিন্তু ফুটবল খেলা তো সবাই দেখবে, পাগলামি সবার মধ্যেই থাকবে। এখান থেকে যারা জার্সি কিনতেছে, সবার মুখে ওই একই হাসি।”

এবারের বিশ্বকাপ এসেছে শীতের শুরুতে। তাই হাফ হাতা জার্সির চেয়ে ফুল হাতা বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন মৌচাক মার্কেটের এবিসি ফ্যাশন স্টোরের বিক্রেতা আশরাফ হোসেন।

দ্বিগুণের বেশি দাম

বিক্রেতারা বললেন, তাদের জার্সির দাম ঠিক হয় মান অনুযায়ী, দেশের ভিত্তিতে নয়। একই কাপড়ের ব্রাজিলের জার্সির যা দাম, আর্জেন্টিনার জার্সিরও একই।

গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের জয় স্পোর্টসের দোকানি ইমরান হাসান জয় জানান, তার দোকানের বেশিরভাগ জার্সিই ‘প্লেয়ার অ্যাডিশনের’। দাম সাড়ে ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে।

ক্রেতারা বলছেন, রমরমা ব্যবসার মধ্যে শেষ সময়ের বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে জার্সির দাম বেড়েছে অনেক। ভালো মানের জার্সি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়, যেটা এক সপ্তাহ আগেও ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় মিলছিল।

‘ফ্যান অ্যাডিশনের’ জার্সি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে, সাত দিন আগেও যেটা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

থাই কাপড়ের জার্সিগুলো বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৭০০ টাকায়, যেটা সপ্তাহখানেক আগে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় পাওয়া যেত। এছাড়া সাধারণ জার্সি ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আগে সেগুলো বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে।

ফার্মগেইটের রাস্তার ধারে অনেক দোকানেই বিভিন্ন বয়সীদের জন্য জার্সির দাম হাঁকা হচ্ছে ১০০-১৫০ থেকে শুরু করে ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত

পতাকার দামও চড়া

ঢাকায় জার্সির পাশাপাশি দাম বেড়েছে পতাকার। বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পতাকার চাহিদা এখন বেশি।

বিভিন্ন মার্কেটের পাশাপাশি ঢাকার সড়কগুলোতে বাঁশ বা লাঠির সঙ্গে বিভিন্ন দেশের পতাকা নিয়ে ছুঁটতে দেখা যাচ্ছে মৌসুমি বিক্রেতাদের। তেমনই একজন মাদারীপুরের আজিজুল ইসলাম।

এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেই তিনি ঢাকায় এসেছেন ফেরি করে পতাকা বিক্রি করতে। লম্বা বাঁশের সঙ্গে বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, পর্তুগাল ও স্পেনের পতাকা ঝুলিয়ে গুলিস্তান এলাকায় বিক্রি করছিলেন।

পতাকা বিক্রির বাইরে আর কী করেন? আজিজুল বলেন, “এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। এখন হাতে তেমন কাজ নাই, তাই ঢাকায় আসছি। পাশাপাশি ফুটবলের সিজনটা কাজে লাগায়ে পতাকা বিক্রি করতেছি।”

আজিজুলের মত অনেকেই ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ে পতাকা বিক্রির মৌসুমি পেশায় নেমেছেন, কিংবা অন্য কাজের পাশাপাশি এ কাজ করছেন।

গুলিস্তান এলাকায় ক্রেতারা জানান, পাঁচ ফুট আকারের পতাকা সপ্তাহখানেক আগে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ১৮০ থেকে ২০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে।

গুলিস্তানে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে প্রায় ২২ বছর ধরে পতাকা বিক্রি করছেন কামাল হোসেন মোল্লা। অনেকে তাকে ‘পতাকা কামাল’ নামেই চেনে। তার কাছ থেকে পাইকারি দামে পতাকা কিনে ঢাকাসহ সারাদেশে ফেরি করেন অনেক পতাকা বিক্রেতা।

বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে আর্জেন্টিনার পতাকা বেশি বিক্রির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আর্জেন্টিনার ফ্যানই বাংলাদেশে বেশি। তবে আমার কাছে ৩২টা দেশের পতাকাই আছে।”

দামের প্রসঙ্গ তুললে ব্যবসায়ী কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কাছে দেড় ফুট থেকে শুরু করে ২০ ফুট সাইজের পতাকা আছে। সাইজ অনুযায়ী সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই হাজার টাকা দামের পতাকাও আছে।”

অন্য দেশের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকাও বিক্রি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা সচেতন, তারা অন্য দেশের পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকাও কিনছেন। যার যার পছন্দের দল সাপোর্ট করলেও বাংলাদেশ তো আমাদের নিজেদের দেশ, তাই অনেকেই পতাকা উড়ানোর সময় বাংলাদেশের পতাকাই উপরে রাখেন।”

অনলাইনেও বিক্রেতারা ‘কৌশলী’

বিশ্বকাপের বাজার, অনেক অনলাইন শপের পণ্যতালিকাতেও যোগ হয়েছে জার্সি। বিশ্বকাপের উত্তেজনাকে পুঁজি করে অনলাইনে সরব তারা; দিচ্ছেন দ্রুত সময়ে ডেলিভারির নিশ্চয়তা আর মূল্য ছাড়।

ব্যতিক্রমী ধারণা নিয়ে ‘মিয়াহ’ নামের একটি অনলাইন শপ বের করেছে ‘আমানত শাহ লুঙ্গি’ ব্র্যান্ডের ‘ফিফা বিশ্বকাপ ফ্যান সংস্করণ’। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, জার্মানি, আর ফ্রান্সের পতাকার আদলে বানানো হয়েছে এসব লুঙ্গি।

বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক সাড়া পাওয়ার কথা জানালেন এই শপের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট এক্সিকিউটিভ নাহিদ আরেফিন রেজা।

পতাকার ডিজাইনে লুঙ্গি বিক্রির এই ধারণা কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সবসময়ই ইনোভেটিভ কিছু করার চেষ্টা করি। চার বছর পর পর একটা ফুটবল বিশ্বকাপ আসে। ফুটবলপ্রেমীদের কথা মাথায় রেখে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

অনলাইনে ওই বিজ্ঞাপন প্রচারের দুদিনের মাথায় সাড়ে ৪ লাখ লুঙ্গির অর্ডার পাওয়ার কথা জানান নাহিদ।

“আমরা ভাবতেই পারিনি আমাদের এই প্রোডাক্ট এত মানুষের পছন্দ হবে। আমাদের পেইজের ইনবক্স একদম পূর্ণ। আমাদের প্রথম দফার প্রোডাকশন ইতোমধ্যে শেষ হয়ে দ্বিতীয় দফায় বানানো শুরু করেছি। লুঙ্গিগুলো খুব আরামদায়ক লিনেন কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।”

‘মিয়াহ’র ফেইসবুক পেইজসহ যে কোনো লুঙ্গির দোকানে আমানত শাহ লুঙ্গি ব্র্যান্ডের এই লুঙ্গিগুলো ৩৭০ টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে।

লুঙ্গি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের পতাকার আদলে স্কার্ফ, কুশন আর বালিশের কাভার বানিয়ে বিক্রি করছে বিভিন্ন অনলাইন শপ।