ঢাকায় পারদ উঠেছে আরও, এমন তাপদাহ ‘আরও কয়েক দিন’

রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় থার্মোমিটারের পারদ উঠেছে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2023, 12:05 PM
Updated : 16 April 2023, 12:05 PM

দেশজুড়ে টানা দুই সপ্তাহ ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে; বৈশাখের শুরুতে বৃষ্টিহীন এই সময়ে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে ঢাকায়।

রোববার যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আগেরদিন শনিবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুননেসা বলেন, রোববার ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যত্র বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ।

“আরও দুই-তিন দিন এমন তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।”

এপ্রিলের দুই সপ্তাহ ধরে দেশের কোথাও হালকা বৃষ্টিও নেই। ঢাকায় সবশেষ ১ ও ২ এপ্রিল ১ মিলিমিটারের মত বৃষ্টি হয়েছিল। ২ ও ৪ এপ্রিল ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় হালকা বৃষ্টি ছিল। আর ৪ এপ্রিল সিলেটে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়।

“বৃষ্টিপাত না থাকায় তাপমাত্রা বেড়েই চলছিল। এখন দুয়েকদিন তাপমাত্রা প্রায় অপরিবরর্তিত থাকতে পারে। এসময়ে অহসহনীয় গরমের মধ্যেই যেতে হবে। সপ্তাহের শেষে ঝড়বৃষ্টির আভাস রয়েছে।”

থার্মোমিটারের পারদ যদি ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে, আবহাওয়াবিদরা তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলেন। উষ্ণতা বেড়ে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে বলা হয় মাঝারি তাপপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়।

ঢাকায় ছয় দশকের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা

রোববার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; যা ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

এর আগে ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোর ও চূয়াডাঙ্গায় ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগেরদিন শনিবার চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। তার আগে ১৯৯৫ সালে এবং ২০০২ সালে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে রেকর্ড ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়।

বৃষ্টি কবে

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানান, আগামী তিন দিন পর হালকা ঝড় বৃষ্টির আভাস রয়েছে। ২০ এপ্রিল রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ ছাড়া দেশের অন্যত্র হালকা বৃষ্টি হতে পারে।

“তাপমাত্রা বাড়ায় বেশ গরম অনুভব হলেও বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় ততটা অস্বস্তিকর হয়নি। আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে পারে। এসময় বাতাসে জলীয় বাষ্পও ধীরে ধীরে বাড়বে।

“দুদিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতা বাড়তে থাকবে। তাতে শরীরে ঘাম হবে। তাপমাত্রা কমলেও গরমের অস্বস্তি বাড়বে বেশি। ১৯-২০ এপ্রিলের দিকে হালকা বৃষ্টির আভাস রয়েছে। আগামী সপ্তাহে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়তে পারে।”

চলতি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, তাপপ্রবাহের পাশাপাশি মাসের শেষার্ধে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণের ফলে স্বল্পমেয়াদী আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

যে কারণে যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, কুষ্টিয়ায় এত তাপপ্রবাহ

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, এপ্রিল-মে মাসে সাধারণত এ ধরনের তাপমাত্রা থাকেই; কখনও কখনও আরও বেশি থাকে। তবে তীব্রতা কম বেশি থাকতে পারে।

“এপ্রিল মাসে যে ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে গেল, তাতে আগামী মে মাসে এটা আরও বেশি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০০২ সালের ২৩ মে সাতক্ষীরায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩.৪ ডিগ্রিতে সেলসিয়াস উঠেছিল।

টানা দুই সপ্তাহ ধরে দেশজুড়ে তাপপ্রবাহের বিষয়ে তিনি জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১৪ ও ২০১৯ সালেও একটানা তাপপ্রবাহ থাকার প্রবণতা দেখা গেছে।

“মাঝে মাঝে এ রকম হয়। এসব এলাকায় (সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী অঞ্চল) সবেচেয়ে বেশি হিট ওয়েভ গেছে এ সময়। ১৯৭৯ সালে এমন সময়ে খরাও গেছে, বর্ষা আসতে বিলম্ব ঘটেছে। জুনের প্রথম সপ্তাহে মুনসুন আসার কথা থাকলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেছে– এ ধরনের ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটে।”

সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, “চুয়াডাঙ্গার নিচেই সাতক্ষীরা। দুই দশক আগেও সাতক্ষীরায় রেকর্ড তাপমাত্রা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আশপাশের এলাকায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে, কিন্তু ৪৩- এ ওঠেনি। যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা, খুলনারও কিছু অংশ-এসব এলাকা তাপপ্রবাহ থাকছে। কিন্তু এসব জায়গার পাশাপাশি শৈত্যপ্রবাহের সময় শ্রীমঙ্গলও যুক্ত হয়।

শনিবার চুয়াডাঙ্গায় ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যশোর ৪০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, খুলনায় ৩৯.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাজশাহীতে ৩৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঈশ্বরদীতে ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মোংলায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কুমারখালীতে ৪০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ফরিদপুর ৪১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) সাবেক চেয়ারম্যান সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, “তার মানে আসল জায়গাটা হচ্ছে- সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী অঞ্চলই আমাদের হিটওয়েভ ও কোল্ডওয়েভের জায়গা। তাপপ্রবাহপ্রবণ এসব এলাকা দিয়ে শৈত্যপ্রবাহও একইভাবে প্রবেশ করে। উত্তর পশ্চিম দিকে থেকে গরমকালে যেটা হিটওয়েভ নিয়ে আসে, সেখান দিয়েই শীতকালে কোল্ডওয়েভ নিয়ে আসে।”

তিনি বলেন, “বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে- বিহার, ওয়েস্টবেঙ্গল, বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন ওড়িষার কিছু এলাকা কমপ্লিটটি ফাঁকা। মেঘ নেই, সুর্যের আলো পড়ার পর স্বাভাকিভাবে হিট এনার্জি বেশি হয়ে যাচ্ছে এ ফাঁকা জায়গায়।

“এরপর পশ্চিম দিকে থেকে বা উত্তর পশ্চিম দিক থেকে যে মেঘগুলো আসে ঝাড়খণ্ড, ওয়েস্টার্ন বিহার, ওড়িষা থেকে এসে ভ্যানিশ হয়ে যায়। ওয়েস্টবেঙ্গল, বিহার ও বাংলাদেশ এর উষ্ণমণ্ডলীয় উচ্চ চাপবলয় সক্রিয় থাকে। বঙ্গোপসাগর থেকে ময়েশ্চার আসতে পারে না। বৃষ্টি হওয়ার জন্য যে লো প্রেসার দরকার হয়; বিহার ও ওয়েস্টবেঙ্গল এলাকায় সেটা তৈরি হচ্ছে না।”

সাবেক এ আবহাওয়াবিদের ধারণা- আরও দু-চার দিন তাপপ্রবাহ চলতে পারে। এরপর একবার বজ্রঝড় ও বৃষ্টির প্রবণতা শুরু হলে তা কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে।

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও তাপপ্রবাহের দিক বিস্তৃত হওয়ায় ঢাকার মানুষকেও দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সমরেন্দ্র কর্মকার।

তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক দশকে ৩৯.৫ পর্যন্ত ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল। কিন্তু এখন হিটওয়েভের এক্সেটশন পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে অগ্রসরমান হচ্ছে। আকাশে মেঘ না থাকলে সূর্যের রশ্মিটা পড়ে, কংক্রিটের শহর হিট অ্যাবজর্ভ করে সহজে।… আরবানাইজেশনের কারণে তাপপ্রবাহ বাড়ছে।”

পুরনো খবর:

Also Read: তাপমাত্রা গড়ের চেয়ে ৭ ডিগ্রি বেশি, গরম বাড়বে আরও

Also Read: মৌসুমের উষ্ণতম দিন পার, বৈশাখের প্রথম দিনও হবে তপ্ত

Also Read: তাপদাহে পুড়ছে দেশ, ঢাকায় পারদ উঠেছে ৪০.২ ডিগ্রিতে