ফ্রান্সের তুলুজ শহরের অভিবাসী ক্যাম্পে ‘ভালোই’ কাটছে ফয়জুল্লাহ ও ইয়াসিনের। তবে যে পথে তারা এ পর্যন্ত এসেছেন, তা যেন গল্পকেও হার মানায়।
Published : 11 Oct 2023, 01:46 AM
ফ্রান্সের দক্ষিণের শহর তুলুজের প্রায় মাঝখানে ক্যাপিটল ভবনের (ক্যাপিটল ডি তুলুজ) সামনের চত্বরে ভিড় করে বড় স্ক্রিনে রাগবি ম্যাচ দেখছিলেন অনেক মানুষ। কী খেলা চলছে উঁকি ঝুঁকি মেরে সেটা বোঝার চেষ্টা করতেই ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন প্রশ্ন করলেন- 'বাঙালি নাকি''।
এগিয়ে এলেন দুজন, জিজ্ঞেস করলেন বাড়ি কোথায়। শুরু হল মোহাম্মদ ইয়াসিন ও মো. ফয়জুল্লাহর সঙ্গে আলাপ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফয়জুল্লাহ ও কুমিল্লার ইয়াসিন কয়েক মাস ধরে ফ্রান্স সরকারের আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। বিভিন্ন পথে আসা অনিয়মিত অভিবাসীদের এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে জায়গা দেওয়া হয়। তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা এবং ফরাসি ভাষা শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে ফ্রান্স সরকার।
তুলুজ শহরে কয়েক মাস ধরে ভালোই সময় কাটছে ফয়জুল্লাহ ও ইয়াসিনের। তবে যে পথে তারা এ পর্যন্ত এসেছেন, তা যেন গল্পকেও হার মানায়।
ফয়জুল্লাহ জানালেন, ঢাকা থেকে তিনি লেবাননে পৌঁছান ২০১৯ সালের শুরুতে। সেখানে আড়াই বছর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন।
কোভিড মহামারীর মধ্যে কাজ কমে যায়, লেবানিজ মুদ্রার মানও পড়ে যায়। ফলে আয় রোজগার কমে যায় ফয়জুল্লাহর। তার মালিকও তাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে চাইছিলেন।
ওই অবস্থায় ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টায় ২০২১ সালে তিনি দালালের শরণাপন্ন হন। দালাল তাকে তুরস্ক হয়ে গ্রিস বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে যাওয়ার পথ বাতলে দেন।
সে অনুযায়ী এক রাতে আফগান দালাল তাকেসহ কয়েকজনকে সিরিয়া বর্ডারে নিয়ে যান। প্রায় সাত দিন অপেক্ষার পর তারা সিরিয়ার ভিতরে ঢুকতে পারেন।
সিরিয়া যাওয়ার পর একটি ঘরে ফয়জুল্লাহসহ প্রায় ৩৫ জন বাঙালিকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দেয় দালালরা। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কায় প্রায় দেড় মাস তারা ওই ঘরেই বন্দি ছিলেন।
সেখানে তাদের দুই বেলা একটি করে স্যান্ডুইচ খেতে দেওয়া হত। অনেক অনুরোধের পর কয়েক দিন তাদের ভাতও দিয়েছে দালালরা, তবে কোনো তরকারি, এমনকি লবণও দেওয়া হত না। শুধু ভাত খেয়েই খুশি থাকতে হয়েছে তাদের।
ফয়জুল্লাহ বললেন, দালালদের কথার একটু বাইরে গেলেই শুরু হত মারধর, নামাজের মধ্যেও তারা এসে কয়েকদিন পিটিয়ে গেছে।
দেড় মাস পরে তাদের নিয়ে তুরস্ক সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দালালরা। বাঙালি ছাড়াও ইথিওপিয়া এবং অন্যান্য দেশের কয়েকজন ছিলেন ওই দলে। সে যাত্রায় কয়েকদিন টানা হাঁটতে হয়েছিল তাদের।
বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠী পথে মাইনে পেতে রাখতে পারে বলে দালালরা আগেই সাবধান করে দিয়েছিল। হাঁটার পথে হঠাৎ মাইনের উপর পা পড়ে মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান ইথিওপিয়ার এক তরুণী। তাকে রেখে যাবেন কিনা দলের লোকেরা যখন সেই দ্বিধায় ছিলেন, তখন দালালরা এসে বলে, এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সহযাত্রী তরুণীকে সেখানে ফেলে রেখেই শোক আর আতঙ্ক নিয়ে আবার যাত্রা করেন তারা।
সেখান থেকে তারা পৌঁছান তুরস্ক সীমান্তে। ৮ মাস সীমান্তে থেকে তুরস্কে ঢোকার চেষ্টা করে যান ফয়জুল্লাহ ও তার সহযাত্রীরা। ৮ মাস পর দালালরা কাঁটাতার কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু পুলিশের কড়া পাহারার কারণে টানা পাঁচ দিন চেষ্টা করেও তারা কেটে ফেলা কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ঢুকতে পারেননি।
ষষ্ঠ দিনে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি শুরু করে, কাঁটাতারের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে কোনো রকমে প্রাণে বাঁচেন ফয়জুল্লাহ ও তার সঙ্গীরা। তবে তার পায়ের একটি আঙ্গুল ভেঙে যায়।
কয়েকদিন পর এক বৃষ্টির রাতে পাহাড় ডিঙিয়ে তারা তুরস্কে ঢুকতে পারেন। সেখানে তারা লুকিয়ে পড়েন পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতরে। কিন্তু পুলিশ টের পেয়ে গুলি শুরু করে। জঙ্গলের মধ্যে পুলিশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে চলে যায়। পড়ে দালালরা তাদের নিয়ে যায় 'সেইফ রুমে'।
সেখান থেকে একটি ছোট গাড়িতে ১৮ জনকে তুলে ১২ ঘণ্টায় ইস্তাম্বুলের কাছাকাছি নিয়ে যায় দালালরা।
ফয়জুল্লাহ বলেন, “যেই গাড়িতে পাঁচজন বহা যায়, সেই জায়গায় ১৮ জন বসাইছে। আমার উপরে বসছে তিনজন। শ্বাস ফেলানোর মত অবস্থা ছিল না।”
তুরস্কে প্রায় ৭ মাস ছিলেন ফয়জুল্লাহ। সেখানে তেমন কাজ নেই, ছোটখাটো কাজ করে কোনো রকমে খেয়েপরে বেঁচে থেকেছেন।
এরপরে গ্রিসে যাওয়ার জন্য আবার আরেক দালালের শরণাপন্ন হন ফয়জুল্লাহ। পরপর দুই রাত গ্রিসে ‘গেম দেওয়ার’ (নিরাপত্তারক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পার হওয়াকে মানব পাচারকারীরা বলে গেইম দেওয়া) চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
তৃতীয় রাতে গ্রিসে ঢুকেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান ফয়জুল্লাহ। গ্রিসের পুলিশ তাকে মারধর করে কাপড়চোপড় সব রেখে দিয়ে একরকম অর্ধনগ্ন অবস্থায় আবার তুরস্কে ফেরত পাঠায়।
পরদিন সকালে ইস্তাম্বুল পৌঁছান এই বাংলাদেশি । কাপড় চোপড় কেনার জন্য সন্ধ্যায় ইস্তাম্বুলের বাজারে গেলে তুরস্কের পুলিশ থেকে আটক করে। ১৮দিন কারাগারে রাখার পর আবারো তাকে সিরিয়া সীমান্তের কাছে এনে ছেড়ে দেয় তুরস্কের পুলিশ।
এরপর অনেক কষ্ট করে আবারো ইস্তাম্বুলে পৌঁছান ফয়জুল্লাহ। আরেক দালালের সঙ্গে আবারও গ্রিসের পথে রওনা করেন। এবার তুরস্ক থেকে বুলগেরিয়া হয়ে ১৮ দিন হেঁটে গ্রিসে পৌঁছান তারা।
ফয়জুল্লাহ বলেন, ওই দলে তারা ২৬ জন ছিলেন। দশ দিন হাঁটার পর সবার পায়ে ফোসকা পড়ে যায়। এরমধ্যে একটু বয়স্ক একজন বাংলাদেশি আর হাঁটতে পারছিলেন না। পরে দালালেরা তাকে রেখেই দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়।
“ওই লোকরে আমি কইলাম, বাঁইচা থাকলে ইস্তাম্বুল যায়েন, ওইখান থেকে যেমনেই হোক দেশে যাইতে পারবেন,” বলেন ফয়জুল্লাহ।
১৮ দিন হাঁটার পর গ্রিসে ঢুকতে পারে ওই দলটি। এরপর আবার ছোট গাড়িতে দম বন্ধ করা কয়েক ঘণ্টার যাত্রা। দালালরা এথেন্সের পাশে একটি ছোট শহরে তাদের নিয়ে রাখে। সেখানে প্রায় এক বছর থাকেন ফয়জুল্লাহ, কাজ করতেন স্ট্রবেরি ও জয়তুনের বাগানে, মোটামুটি আয়ও হচ্ছিল।
এক বছরে কিছু আয় রোজগার করে ইউরোপের অন্য দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ফয়জুল্লাহ। গন্তব্য ইতালি, আবারো ধরলেন আফগান দালাল। ব্রিজ থেকে দুদিন হেঁটে এলেন আলবেনিয়া সীমান্তে, সেখানে তিন দিন।
বৃষ্টিতে ভিজে তৃতীয় দিনের মাথায় আলবেনিয়ায় ঢুকতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ফয়জুল্লাহ। পুলিশ তাদের সীমান্তের এপারে ফেরত পাঠায়।
আরো দুদিন পর আলবেনিয়ার ভেতরে ঢুকতে পারেন তারা। এরপর আরো দুদিন হেঁটে পাশের দেশ মন্টিনিগ্রোতে ঢোকেন। সেখান থেকে পৌঁছান বসনিয়া সীমান্তে। বসনিয়া থেকে ৮০০ ইউরো দিয়ে ফয়জুল্লাহ দালাল ধরেন ইতালি যাওয়ার জন্য।
দালালরা তাকে দুদিন বসনিয়ায় রেখে একদিন পর ক্রোয়েশিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানেও পুলিশের হাতে আটক হন ফয়জুল্লাহ। আঙ্গুলের ছাপ রেখে, ছবি তুলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। সেখান থেকে তিনি দালালের সঙ্গে পাশের দেশ স্লোভেনিয়ায় যান।
ফয়জুল্লাহর ভাষ্য, স্লোভেনিয়ার পুলিশ ‘ভালো’, তাদের কিছুই বলেনি। পুলিশ তাদের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে বাসে ইতালিতে আসেন ফয়জুল্লাহ।
ইতালিতে ঢোকার পরপরই সেখানকার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তারাও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে ছেড়ে দেয়।
সেখান থেকে ১৮০ ইউরো দিয়ে দালাল ধরে সুইজারল্যান্ড হয়ে জার্মানিতে যান ফয়জুল্লাহ। কিন্তু সেখানে আইন-কানুনের কড়াকড়ি দেখে চলে যান ফ্রান্সের প্যারিসে।
প্যারিস থেকে সেখানকার কর্তৃপক্ষ ফয়জুল্লাহকে তুলুজ শহরের অভিবাসী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। তিন মাস ধরে সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি।
খাবারের জন্য প্রতি মাসে ১২০ ইউরো ভাতা দেয় ফ্রান্স সরকার। সরকারি একটি ছোট ফ্লাটে তারা চারজন থাকছেন এখন। তাদের বিনা খরচে ফরাসি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে দেশটির সরকার।
ফয়জুল্লাহর ভাষ্য, ফ্রান্সের সরকার ‘ভালো’, ভাষা শেখা হয়ে গেলে এখানে কাজকর্ম পাওয়া যায়। হোটেল-রেস্তোরাঁ, খাবার ডেলিভারি, গাড়ি চালানোসহ বিভিন্ন রকমের কাজ আছে ফ্রান্সের শহরগুলোতে। তুলুজ শহরেই তিনি থেকে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ইয়াসিন অবশ্য ততটা স্বস্তিতে নেই। বহু কষ্ট করে ফ্রান্সে পৌঁছাতে পারলেও কিডনি রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে।
কুমিল্লার দাউদকান্দির মোহাম্মদ ইয়াসিন ২০১৬ সালে ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে পাকিস্তান, সেখান থেকে বাসে করে ইরানে যান। তারপর কয়েকদিন হেঁটে, কিছুটা পথ ট্যাক্সিতে করে পৌঁছান তুরস্ক।
সেখানে প্রায় দুই বছর পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ভালোই ছিলেন। দুই বছর আগে সেখান থেকে দালাল ধরে গ্রিসে যান। পাঁচ বছর কাজ করেন গ্রিসের এক পোশাক কারখানায়। সেখানেও আয় রোজগার ভালোই হচ্ছিল, তবে কিডনি রোগ ধরা পড়লে পরিস্থিতি বদলে যায়।
অসুস্থ শরীরে কঠোর পরিশ্রমের কাজ, তার ওপর আবার চিকিৎসার খরচ। আরো ভালো জীবনের আশায় চলতি বছরের ২৩ মে ফ্রান্সে আসেন ইয়াসিন। এখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় অভিবাসী ক্যাম্পে রয়েছেন।
ফ্রান্সের সরকার তার চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিন তার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। সেজন্য গাড়িতে করে হাসপাতালে যাতায়াতের ব্যবস্থাও ফরাসি সরকার করে দিয়েছে।
ইয়াসিনের আশা, ফ্রান্সের ভাষা শিখে কাজ করতে পারলে টাকা জমাবেন। সেই টাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে পারলে হয়ত আবার ফিরে পাবেন সুস্থ জীবন।