“আমি বিশ্বাস করি, এই অগাস্ট থেকে নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ বিষয়ে এর বেশি বলতে চাই না,” বললেন কানাডায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার।
Published : 13 Aug 2023, 09:59 PM
কানাডা মৃত্যুদণ্ডবিরোধী হলেও আইনের একটি বিশেষ ধারা অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর খুনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবিএমএইচ নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন দেশটিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার খলিলুর রহমান।
চলতি অগাস্ট মাসেই সে প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেছেন, “খুনিকে ফেরানোর পথ আছে এবং পথ তৈরি করতে হবে। জাতির পিতাকে হত্যার ৪৮টি অগাস্ট পার হয়েছে, তবে এই অগাস্ট ভিন্ন রকম।”
এই কূটনীতিবিদ আক্ষেপ করে বলেছেন, ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কানাডাই নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু সে সময় ক্ষমতায় থেকে প্রথমে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ বিষয়ে আগ্রহী হয়নি।
এত বছর দেরি হলেও এই অগাস্টেই ‘সুখবর’ আসতে পারে জানিয়ে খলিলুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউটে’ বলেন, “আমি মনে করি এবং বিশ্বাস করি, এই অগাস্ট থেকে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে, ইনশাআল্লাহ। এ বিষয়ে এর বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে এটা হচ্ছে সেই অগাস্ট, যখন প্রক্রিয়াটা শুরু হবে।”
দুই দফায় ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকি পাঁচ খুনি এখনও অধরা। তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী।
এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ বারবার দাবি জানালেও তাদের ফেরত পাঠানো হয়নি।
বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পায়নি সরকার। মোসলেম উদ্দিন ভারতে আছেন বলে গত বছর পত্রিকায় খবর এলেও তার ‘সত্যতা নিশ্চিত’ হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকীর দুদিন আগে কানাডা থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউটে’ যোগ দিয়ে নূর চৌধুরীকে ফেরানোর প্রক্রিয়া এবং তার অবস্থানের বিষয়ে কথা বলেন হাই কমিশনার খলিলুর রহমান।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই সর্বশেষ পর্বটি।
হাই কমিশনার বলেন, “আমাদের সঙ্গে কানাডার বহিঃসমর্পণ চুক্তি নাই। যদি এই চুক্তি থেকেও থাকে, কানাডার অধিকার ও স্বাধীনতা সনদ সামনে চলে আসবে। এ কারণে আমরা কেবল তার ফেরত পাঠানোর বিষয় বলতে পারি। একটা পথ হবে এবং আমরা সেই পথ তৈরির কাজ করছি।”
২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও পরে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চার বছরে কানাডা সরকারই বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত দিতে চেয়েছিল বলে জানান খলিলুর রহমান।
তিনি বলেন, “কিন্তু সে সময় (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়) ফেরানো হয়নি। প্রধান ষড়যন্ত্রকারী (বঙ্গবন্ধু হত্যার) খন্দকার মুশতাক আহমেদের দত্তক ছেলে ছিল এখানকার হাই কমিশনার। আবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা তাকে ফেরত নিতে ইচ্ছুক ছিল না।
“এমন অবস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বলবৎ ছিল। ২০০৭-০৮ সালে আমাদের সরকার কোনো কারণে ফেরত নিতে ইচ্ছুক ছিল না।”
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাওয়ার প্রচেষ্টা চলার কথা জানিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, “এরপর খুনি তাদের উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন এবং এখানে অন্যান্য আইনি জটিলতাও রয়েছে।
“কানাডা সরকার এমন সিদ্ধান্তে আসে যে, তাকে এমন দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে। কারণ, কানাডার অধিকার ও স্বাধীনতা সনদ সাধারণত এই ধরনের বিষয়ে অনুমোদন দেয় না।”
তবে ওই সনদের ভেতরেই এই জঘন্য খুনিকে ফেরত পাঠানোর সুযোগ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এক সময় তাকে কানাডার ইমিগ্রেশন বোর্ড মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। এ ধরনের জঘন্য অপরাধীকে যেখানে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে এমন দেশে প্রত্যাবাসন করা যায়।
“সেই বিবেচনায়, কানাডার অধিকার ও স্বাধীনতা সনদ লঙ্ঘন না করেই এই খুনিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যায় এবং ফেরত পাঠানো উচিত।”
কানাডীয় আইনে খুনিকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রীর ’বিশেষ ক্ষমতা’ থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তবে এই বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োগ অত সহজ বিষয় নয়।”
খুনিকে ফেরানো বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “হাই কমিশনার হিসাবে খুনিকে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রায়ের মুখোমুখি করার নিয়ে আমি কাজ করছি। মত ভিন্নতার পরও দুদেশের সরকার এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যে রয়েছে।”
কানাডায় বর্তমানে কাউকে ফাঁসি দেওয়া হয় না, বরং আমৃত্যু কারাবাসে রাখা হয় জানিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “তবে, তারা ইতোপূর্বে খুনি বা হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এমন দেশে ফেরত পাঠিয়েছে, যেখানে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে। তারা ১৯৯১ সালে একজনকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠিয়েছিল। আমি আপনাকে কেবল এটুকু বলতে পারি।”
নূর চৌধুরীর বর্তমান কর্মকাণ্ডের বিষয়ে এক প্রশ্নে হাই কমিশনার বলেন, “আগে তিনি এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। এখন বাসার মধ্যেই থাকেন, তাকে অনেক বছর ধরে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। দলমত নির্বিশেষে তাকে সবাই ঘৃণা করে।”
নির্বাচন নিয়ে কানাডার অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যদের সঙ্গে একযোগে কাজ করার কারণে ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনার যৌথ বিবৃতিতে কানাডাও ছিল বলে মন্তব্য করেন খলিলুর রহমান।
কানাডার গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনের বাইরে অন্যান্য বিষয়ে বেশি আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকা থেকে কানাডার হাই কমিশনার বিভিন্ন বার্তা পাঠান, তা ঠিক। তবে আমরা আমাদের দিক থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করি, কী ঘটছে, কেন ঘটছে এবং আমাদের সরকার কী করছে?”
কানাডা থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক আসার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে হাই কমিশনার বলেন, “আমরা হয়ত দেখতে পাব, কানাডার বিভিন্ন অঙ্গন থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে যাবে। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনার কোনো বিষয় এখন পর্যন্ত নাই, বিশেষ করে অটোয়ায়।”
‘কিছু বাংলাদেশির উপদ্রবে আমি হতাশ’
কানাডায় সোয়া লাখের মত প্রবাসী থাকলেও ‘গোটা দশেক বাংলাদেশি’ সামাজিক মাধ্যমে দেশ নিয়ে ‘অপপ্রচারে’ জড়িত বলে মন্তব্য করেন খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, “এগুলো সমস্যা নয়, তবে উপদ্রব। কিছু লোকের কার্যক্রমে আমি হতাশ।”
তিনি বলেন, “আমি এটা তাদেরকে সবসময় বলে থাকি, আপনি যদি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সত্যিকার অর্থে আগ্রহী হন, বাংলাদেশে যান এবং যেটা বলতে চান বলুন, যেটা করতে চান করুন, যেভাবে বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা করে থাকে। দয়া করে এগুলো এখানে করবেন না এবং বাংলাদেশের বদনাম করবেন না।”
শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারত থেকে কানাডায় আসা অনেক মন্ত্রী-এমপি হলেও বাংলাদেশি কমিউনিটির কেউ নেই জানিয়ে আক্ষেপ করেন হাই কমিশনার।
তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কা থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-এমপি রয়েছে, পাকিস্তান থেকে ৬ জন ফেডারেল এমপি রয়েছে এবং ভারতের ১৯ ফেডারেল এমপি ও চারজন মন্ত্রী রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একজনও নাই। কারণ হচ্ছে, আমাদের লোকজন মূলধারার রাজনীতিতে সেভাবে জড়িত হয় না।”
আইটি ও ব্যবসায় শিক্ষায় সুযোগ ‘বেশি’
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিদের জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে কানাডা। এ বিষয়ে এক প্রশ্নে হাই কমিশনার বলেন, কানাডায় পড়াশোনা ও চাকরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আইটি ও ব্যবসায় শিক্ষায় বেশি সুযোগ নিতে পারে।
“স্নাতকের পর তিন বছর কাজের অনুমতি পাওয়া এবং এরপর বসবাসের অনুমতি মেলার কারণে বাংলাদেশিরা কানাডায় যেতে আগ্রহী।”
করোনাভাইরাস মহামারীর পর সরকার শিক্ষার্থীদেরকে পূর্ণকালীন কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে, এটা কেবল ক্যাম্পাস নয়, বাইরেও। এটা আরও বেশি শিক্ষার্থীদেরকে আগ্রহী করছে বলে মত দেন তিনি।
বাণিজ্য ও যোগাযোগ
করোনাভাইরাস মহামারীতে বিরতির পর কানাডায় বাংলাদেশের রপ্তানি যে কোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে জানিয়ে হাই কমিশনার বলেন, এখন বাংলাদেশ কানাডায় ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।
“দুদেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এটার ক্রেডিট হাই কমিশনার হিসাবে কিছু নিতে পারি। এবং বাণিজ্য আরও বাড়ছে।”
এখন মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি হলেও চামড়া, পাট, ফার্নিচার ও প্লাস্টিকেরও সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান খলিলুর রহমান।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কানাডায় শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল রাখার জন্য দেনদরবার চালানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “২০২৬ সালের পর আমরা কানাডার বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাতে পারি। ভালো খবর হচ্ছে, কানাডা তাদের আইন ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করেছে। আমরা আরও তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাব, আরও বেশি পাওয়ার জন্য দেনদরবার করছি।”
ঢাকা থেকে টরন্টোতে সরাসরি ফ্লাইট চালুর মাধ্যমে যোগাযোগ ও ব্যবসায় প্রসারের সুযোগ তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের আগ্রহ বেশি, টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। ফ্লাইটের সংখ্যা এখন দুটো থেকে বাড়বে।
“আসা-যাওয়া, মানুষ-মানুষে যোগাযোগ বেড়েছে। পাশাপাশি রপ্তানির প্রসারও। সুতরাং আমরা বাণিজ্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে সঠিক পথেই রয়েছি।”