ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাই কোর্টে এর আগে রিট আবেদন করেছিলেন স্বজনরা, তবে আইনি সুযোগ না থাকায় আদালত তাতে সাড়া দেয়নি।
Published : 23 May 2023, 12:45 PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড আসামি, তার বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচাতে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছে তার পরিবার।
জাহাঙ্গীরের ভাই হাফেজ মো. সোহরাব হোসেন সোমবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে প্রধান বিচারপতির কাছে এ আবেদন পাঠান।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারকে আবেদনের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর স্থগিত রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে সেখানে।
আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এন গোস্বামী ওই চিঠি দেওয়ার বিষয়টি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি বরাবরে লেখা ওই আবেদনে বলা হয়েছে, “অল্প শিক্ষিত একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার ভাই জাহাঙ্গীর আলমকে সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ ধারা লঙ্ঘন করে আটক রেখে অবৈধভাবে স্বীকারোক্তি আদায়ের মাধ্যমে তার প্রতি অবিচার কিংবা সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে কি না সেটি খতিয়ে দেখার জন্য এবং আমার ভাইকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষার জন্য আপনার কাছে একটি মানবিক আবেদন জানাচ্ছি।”
আবেদনে জাহাঙ্গীরের ভাই বলেন, “আমার জানা মতে আমাদের নিয়োজিত আইনজীবীরা নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের (হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ) কোথাও সংবিধানের ৩৩ (২) নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের প্রশ্নটি যথাযথভাবে উত্থাপন করতে সক্ষম হননি বিধায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে এবং বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে আপনি আমার অসহায় ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি পর্যালোচনাপূর্বক পুনর্বিবেচনা করতে আপনার কাছে সবিনয় নিবেদন করছি এবং আমার এ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আমার ভাই জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর স্থগিত রাখতে যথাবিহিত আদেশ প্রদান করতে আপনার প্রতি কাতর মিনতি জানাচ্ছি।”
অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ে তার সহকর্মী, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। দুই আসামি ওই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করলেও আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।
অধ্যাপক তাহের হত্যা: ফাঁসি আটকাতে হাই কোর্টে গেলেও সাড়া মেলেনি
রিভিউ খারিজ: অধ্যাপক তাহেরের দুই খুনিকে যেতে হবে ফাঁসিকাষ্ঠে
অধ্যাপক তাহের হত্যা: ২ আসামির মৃত্যুদণ্ড আপিলেও বহাল
রিভিউ আবেদন খারিজের সেই রায় ৩ মে প্রকাশিত হলে এ মামলার সকল বিচারিক কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে। নিয়ম অনুযায়ী, রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে আসামির দণ্ড কার্যকরে আর কোনো আইনি বাধা থাকে না।
তবে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারেন। সেই আবেদনও খারিজ হয়ে গেলে কারা কর্তৃপক্ষ কারাবিধি অনুযায়ী দণ্ড কার্যকরের পদক্ষেপ নিতে পারে।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভেজ হাশেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংবিধান অনুযায়ী, এখন কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ আছে। এ পর্যায়ে এসে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা অর্থহীন।”
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ নিখোঁজ হন। দুইদিন পর শিক্ষক কোয়ার্টারের বাসার বাইরে ম্যানহোলে তার লাশ পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় পর ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার হত্যা থানায় মামলা দায়ের করেন।
তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ছয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তাতে অধ্যাপক তাহেরের সহকর্মী মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীরেরে ভাই আবদুস সালাম, তাদের (জাহাঙ্গীর ও আবদুস সালাম) বাবা আজিমুদ্দীন মুন্সী এবং সালামের আত্মীয় নাজমুলকে আসামি করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর, নাজমুল ও সালাম আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মহিউদ্দিন ও সালেহী তাদের কম্পিউটার, টাকা-পয়সা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাহের আহমেদকে হত্যা করার কাজে লাগান। তবে মিয়া মহিউদ্দিন আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।
পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, তখনকার সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মহিউদ্দিন পদোন্নতি পেতে বিভাগে আবেদন করেছিলেন। পদোন্নতির ওই কমিটিতে ড. তাহেরও ছিলেন। তিনি মহিউদ্দিনের কয়েকটি প্রতারণা প্রাথমিকভাবে ধরে ফেলেন। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে পরে এই সব প্রতারণা প্রমাণিত হয়।
সেই অসন্তোষ থেকে মিয়া মহিউদ্দিন এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তাহেরকে বাসায় হত্যা করে লাশ ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রাখা হয়।
৩৯ জনের সাক্ষ্য ও জেরার পর ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর, সালাম ও নাজমুলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এছাড়া সালেহী ও আজিমুদ্দিনকে খালাস দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল হাই কোর্ট মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের ফাঁসির রায় বহাল রাখে এবং সালাম ও নাজমুলের দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগের দেওয়া রায়েও সেই সাজা বহাল থাকে। দুই ফাঁসির আসামি রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ৮ বিচারকের আপিল বিভাগ এ বছর ২ মার্চ তা খারিজ করে দেয়।
এরপরও দুজনের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন স্বজনরা। তবে এ পর্যায়ে এ ধরনের আবেদন শোনার আইনি সুযোগ না থাকায় হাই কোর্ট তাতে সাড়া দেয়নি।