অধ্যাপক তাহের হত্যা: ২ আসামির মৃত্যুদণ্ড আপিলেও বহাল

ষোল বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এস তাহের আহমেদকে হত্যার দায়ে তার এক সহকর্মীসহ দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং দুই জনের যাবজ্জীবন সাজার রায় সর্বোচ্চ আদালতেও বহাল রাখা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2022, 04:47 AM
Updated : 5 April 2022, 05:39 AM

খালাস চেয়ে আসামিদের করা আপিল এবং যাবজ্জীবন সাজার দুই আসামির দণ্ড বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন খারিজ করে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণঙ্গা বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেয়।

সাজা বহাল থাকায় তাহেরের সহকর্মী ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে। আর জাহাঙ্গীরের ভাই শিবিরকর্মী আবদুস সালাম এবং জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর ভাই নাজমুল আলমকে খাটতে যাবজ্জীবন সাজা। অবশ্য তারা আপিল বিভাগের রায় পর্যালোচনার আবেদন করতে পারবেন।

অধ্যাপক তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ, ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ এবং মেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, ইমরান সিদ্দিকী ও শামছুর রহমান।

রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেলে আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “পদোন্নতিতে বাধা সৃষ্টির জন্য একজন মানুষকে এভাবে হত্যা করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না, খুবই ঘৃণ্য কাজ।”

চূড়ান্ত রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “ষোলো বছর এর জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি। অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছি। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রায় কার্যকর হলে পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট হব।”

তিনি বলেন, “খুনির যে কার্যক্রম, ও যা করেছে আমাদের সাথে, তা চিন্তার বাইরে। ও সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় আমার বাড়িতে, আমার অনুপস্থিতিতে, আমার ড্রয়িং রুমে গিয়ে, আমার সোফায় বসে আমার স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। আমর বাড়ির জিনিসপত্র তারা ব্যবহার করেছে। বিনা অনুমতিতে কারো বাড়িতে প্রবেশ করা নিষেধ। সে শিক্ষা সে পায়নি। এ শিক্ষা পেতে হয় পরিবার থেকে। সবচেয়ে বড় কথা সাজা কার্যকর হোক।”

ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তাহের ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন। ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসার বাইরে ম্যানহোলে তার লাশ পাওয়া যায়।

তার ছেলেমেয়েরা তখন ঢাকার উত্তরায় একটি বাসায় থেকে লেখাপড়া করছিলেন। ঘটনার দিন তার স্ত্রীও ছেলেমেয়েদের সাথে ছিলেন, রাজশাহীর বাসায় তাহের ছিলেন একা।

ড. এস তাহের

লাশ উদ্ধারের পরদিন তার ছেলে সানজিদ আলভী মতিহার থানায় মামলা করেন। তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক আচানুল কবির ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন।

সেখানে তাহেরের এক সময়ের ছাত্র ও পরে বিভাগীয় সহকর্মী মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, তাহেরের বাসভবনের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীরের ভাই শিবিরকর্মী আবদুস সালাম, তাদের (জাহাঙ্গীর ও আবদুস সালাম) বাবা আজিমুদ্দীন এবং জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর ভাই নাজমুল আলমকে আসামি করা হয়।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর, নাজমুল ও সালাম আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মহিউদ্দিন ও সালেহী তাদের কম্পিউটার, টাকা-পয়সা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাহের আহমেদকে হত্যা করার কাজে লাগান। তবে মিয়া মহিউদ্দিন আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।

পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, তখনকার সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মহিউদ্দিন পদোন্নতি পেতে বিভাগে আবেদন করেছিলেন। পদোন্নতির ওই কমিটিতে ড. তাহেরও ছিলেন। তিনি মহিউদ্দিনের কয়েকটি প্রতারণা প্রাথমিকভাবে ধরে ফেলেন। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে পরে এই সব প্রতারণা প্রমাণিত হয়।

সেই অসন্তোষ থেকে মিয়া মহিউদ্দিন এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তাহেরকে বাসায় হত্যা করে লাশ ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রাখা হয়।

৩৯ জনের সাক্ষ্য জেরা নিয়ে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মিয়া মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর, সালাম ও নাজমুলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। বাকি দুই আসামি সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী সেই রায়ে খালাস পান।

নিয়ম অনুযায়ী এরপর মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য মামলার নথিপত্র যায় হাই কোর্টে। আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি করে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাই কোর্ট বেঞ্চ ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল রায় দেয়।

সেখানে মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সালাম ও নাজমুমের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে এরপর আপিল বিভাগে আবেদন করেন আসামিরা। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডিত দুই আসামির দণ্ড বাড়াতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

নয় বছর পর তা শুনানির জন্য ওঠে। ১৬ মার্চ দুই পক্ষের শুনানি শেষে সর্বোচ্চ আদালত মঙ্গলবার চূড়ান্ত রায় দিল।