তাদের অর্থদাতা প্রবাসী এক ব্যক্তি বলে সিটিটিসি জানতে পেরেছে।
Published : 13 Aug 2023, 11:31 PM
ইমাম মেহেদীর আগে আসবেন ইমাম মাহমুদ, তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় জিহাদে দেবেন নেতৃত্ব- এমন বিশ্বাসে এক হয়েছিলেন তারা, ‘হিজরত’ করে জমি কিনে বসেছিলেন জাঁকিয়ে, এটা ছিল সেই জিহাদের ‘প্রস্তুতি পর্ব’।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে এমনটাই বলছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা।
তবে হঠাৎ করে গোচরে আসা এই ‘জঙ্গি সংগঠনের’ পেছনে কারা আছেন, তারা কাদের অনুসরণ করেন, অন্য কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে কি না, সেসব প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা।
সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় এসব বিষয় খোলাসা করতে না পারলেও তাদের এক অর্থদাতার নাম জানার কথা বলেছেন।
এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলে বসা ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া’র সঙ্গে আনসার আল ইসলামের নেতাদের যোগাযোগ ছিল। তারা পাহাড়ি সংগঠন কুকি চিন আর্মি বা বম পার্টির সঙ্গে প্রশিক্ষণের চুক্তিও করেছিল বলে সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন।
ইমাম মাহমুদ কাফেলার অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় এরকম কোনো জঙ্গি সংগঠন বা ব্যক্তি রয়েছে কি না- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, “বিষয়গুলো এখনো পুরোপুরি সামনে আসেনি। তবে জমি কিনতে যে ব্যক্তি টাকা দিয়েছিলেন, তাকে শনাক্ত করা গেছে।”
এক প্রবাসীর দেওয়া অর্থে কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের গহীনে ওই ৫০ শতাংশ জমি কেনা হয় বলে সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন।
শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত সেখানে ‘অপারেশন হিলসাইট’ অভিযান পরিচালনা করে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তাদের চারজন পুরুষ, ছয়জন নারী। কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।
২০১৬ সালের গুলশান হামলার পর টানা অভিযানে জঙ্গিদের সামর্থ্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করলেও সম্প্রতি ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া’ নামে নতুন একটি সংগঠনের নাম জানা যায় র্যাবের অভিযানের মধ্যদিয়ে। এরপরই ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র নাম জানাল সিটিটিসি।
পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, “আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, কথিত এই ইমাম মাহমুদ, ইমাম মাহাদীর অগ্রবর্তী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন। তারা বিশ্বাস করে, ইমাম মাহাদীর আবির্ভাবের আগে যে দূর্বল প্রকৃতির ব্যক্তির আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে, ইমাম মাহমুদ সেই ব্যক্তি।
“এই কথিত ইমাম মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদে (গাজওয়াতুল হিন্দ) নেতৃত্ব দেবেন। জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রথম ধাপ হল গৃহ ত্যাগ তথা হিজরত।”
যে সূত্রে সন্ধান
অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি যশোর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী লোকদের পরিবারসহ এবং একা নিখোঁজ হওয়ার তথ্যগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই সংগঠনের অস্তিত্ব পায় সিটিটিসির কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন (সিটিআই) ডিভিশন।
নিখোঁজদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেলের ডা. সোহেল তানজীম রানা, যশোরের ছেলে ঢাকার নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী, জামালপুরের এরশাদুজ্জামান শাহিনসহ আরও কয়েকজন রয়েছেন।
তাদের নিয়ে অনুসন্ধানের সূত্র ধরে গত ৭ অগাস্ট ঢাকার গাবতলী থেকে সপরিবারে গৃহত্যাগ করা আসা ছয়জন নারী ও চারজন পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সঙ্গে থাকা আটটি শিশুকে হেফাজতে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে মেহেরপুরের পাঁচটি ও এবং ঝিনাইদহের একটি পরিবার ছিল।
এরপর গত ১২ অগাস্ট মধ্যরাতে ঢাকার মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ এলাকা থেকে মো. ফরহাদ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফরহাদ এই দলের সদস্য দাবি করে আসাদুজ্জামান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে মৌলভীবাজোরের কুলাউড়ার আস্তানার কথা জানা যায়।
বনের ভেতরে টিলা কেটে বাড়ি
কুলাউড়ার ওই আস্তানা খুঁজে বের করে অভিযানের সূচনা করেছিলেন সিটিটিসির সহকারী কমিশনার শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্প সংলগ্ন ৫০ শতাংশ জমি কিনে টিলা কেটে সমান করে তারা টিন দিয়ে বেশ কয়েকটি ঘর বানিয়ে নিয়েছিল।
“তারা নিজেরাই বাঁশ কেটে, টিন দিয়ে ঘর বানিয়ে নেয়। ঘরগুলো যে খুব অপটু হাতে তৈরি, তা বোঝা যায়। এসব ঘরে কোনো খাট বা চৌকি ছিল না। মাটিতেই তারা মাদুর বা পাটি বিছিয়ে থাকত।”
শফিকুল বলেন, “এটি এত ভেতরে যে স্থানীয় লোকজনের সহায়তা ছাড়া সেটি খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে উঠেছিল। সেখানে জঙ্গিরা বেশ জাঁকিয়ে বসারই পরিকল্পনা করছিল। তাদের দলে মিস্ত্রি, রাঁধুনি, ডাক্তার সবই ছিল।”
স্থানীয় দোকান থেকেই তারা মাসের বাজার করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, “যেদিন বাজারে যেত, তারা এক সঙ্গে কয়েক হাজার টাকার বাজার করত। ওই আস্তানায় কখনও ৩০-৪০ জন পর্যন্ত জমায়েত হতেন।
“শুক্রবার রাতেও তাদের যে পরিমাণ রান্না হয়েছিল, তাতে ২৫-৩০ জন খেতে পারার কথা। তা থেকে ধারণা করা যায়, বেশ কয়েকজন বাইরে গিয়েছিলেন, রাতে আর ফেরেননি।”
সিরাজগঞ্জের ডা.তানজিম সোহেল রানার স্ত্রী ধরা পড়েলেও তিনি ধরা পড়েননি। যশোরের সেই কলেজছাত্রও সেখানেই ছিলেন বলে সিটিটিসি কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, তিনিও ধরা পড়েননি।
এভাবে আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার এড়িয়ে গেছেন বলে মনে করেন সহকারী কমিশনার শফিকুল।
সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, ৫০টি ডেটোনেটর, রামদাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র, কমান্ডো রুট, পাঞ্চিং ব্যাগ ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ সামগ্রী, উগ্রবাদী বই, নগদ অর্থ এবং স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারের কথা জানান হয়েছে।
আটকরা হলেন, সাতক্ষীরা সদরের দক্ষিণ নলতা গ্রামের শরীফুল ইসলাম (৪০), কিশোরগঞ্জের ইটনার কানলা এলাকার হাফিজ উল্লাহ (২৫), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার রসুলপুর গ্রামের খায়রুল ইসলাম (২২), সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থানার মাইজবাড়ী গ্রামের রাফিউল ইসলাম (২২), পাবনার আটঘরিয়া থানার শ্রীপুর গ্রামের শাপলা বেগম (২২), নাটোর সদরের চাঁদপুর গ্রামের মাইশা ইসলাম হাফসা (২০), বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার নিজবলাই গ্রামের মোছা. সানজিদা খাতুন (১৮), সাতক্ষীরার তালা থানার দক্ষিণ নলতা গ্রামের আমিনা বেগম (৪০) এবং তার মেয়ে মোছা. হাবিবা বিনতে শফিকুল (২০)।
কুলাউড়ায় ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান, আটক ১০
‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ ৯ সদস্য রিমান্ডে, কারাগারে ২
সিরাজগঞ্জের নিখোঁজ চিকিৎসকের স্ত্রী আটক কুলাউড়ার ‘জঙ্গি আস্তানা’ থেকে
জঙ্গি আস্তানা: গরু বেচে পরিবারসহ বাড়ি ছাড়েন সাতক্ষীরার শরিফুল
‘বানাইতে চাইলাম ডাক্তার, ছেলে হইল জঙ্গি’ আফসোস কৃষক বাবার
বগুড়ার পলাতক আসামি সুমনের স্ত্রী আটক কুলাউড়ার ‘জঙ্গি আস্তানায়’