“প্রতীকগুলোর মাধ্যমে প্রার্থীরা সমাজে এক ধরনের বুলিংয়ের শিকার হবেন; বিশেষ করে নারীরা।…জনগণের কাছে আকর্ষণীয় হবে, এমন প্রতীক ঠিক করতে পারত। এটাকে নান্দনিক করার সুযোগ ছিল”, বলেন সাদেকা হালিম।
Published : 25 Dec 2023, 12:32 AM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে রয়েছেন ৩৮২ জন, যাদের বেশিরভাগেরই প্রতীক ঈগল ও ট্রাক।
নির্বাচন কমিশন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ২৫টি প্রতীক রাখলেও ৭৩ শতাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী এ দুটি প্রতীক বেছে নিয়েছেন।
তারা বলছেন, ব্যালট পেপারে যাতে স্পষ্ট ফুটে ওঠে এবং প্রতীকের মাধ্যমে ভোটারদের মননে প্রার্থীর ‘শক্তি-সামর্থ্য’ আর শ্রেষ্ঠত্বের বার্তা যায়, সেসব চিন্তা থেকেই তারা এসব প্রতীক বেছে নিয়েছেন।
ঢাকা জেলার ২০ আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন ঢাকা-১৪ আসনে। এই প্রার্থীরা প্রতীক নিয়েছেন ঈগল, ট্রাক, দালান, রকেট ও কেটলি। ঢাকার বাইরে ২৮০ আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচজন স্বতন্ত্র প্রাথী লড়ছেন নীলফামারী-৩ আসনে। তারা বেছে নিয়েছেন ঈগল, ট্রাক, কেটলি, কাঁচি আর মোড়া প্রতীক।
সব মিলিয়ে ২৫টি প্রতীক বরাদ্দ থাকলেও বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা পছন্দ করেছেন ১৯টি প্রতীক। বাকিগুলো ‘মানসম্মত’ আর ‘স্পষ্ট না হওয়ায়’ কয়েকটি প্রতীকেই স্থির থাকতে হয়েছে বলে ভাষ্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের।
নির্বাচনে এবার অংশ নিয়েছে ২৭টি দল। ভোটে ১ হাজার ৫১৩ জন প্রার্থী পেয়েছেন দলীয় প্রতীক, স্বতন্ত্ররা নিয়েছেন ইসির নির্ধারিত প্রতীক।
এই প্রতীকগুলো হল- ঈগল, ট্রাক, কলার ছড়ি, খাট, ঘণ্টা, তবলা, তরমুজ, দালান, ফুলকপি, বাঁশি, বেঞ্চ, বেলুন, মাথাল, রকেট, স্যুটকেস, কেটলি, আলমিরা, থালা, ঢেঁকি, চার্জার লাইট, মোড়া, কাঁচি, ফ্রিজ, সোফা, দোলনা।
কোনো নির্বাচনি এলাকায় বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে এবং একজনের সঙ্গে অন্যজনের পছন্দের প্রতীক মিলে গেলে কে কোন প্রতীক পাবেন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় লটারির মাধ্যমে।
এবার ৩০০ আসনের মধ্যে ৭৫টিতে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। বাকিগুলোর মধ্যে কিছু আসনে একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও তাদের প্রতীক পছন্দের তালিকা ঘুরেফিরে কয়েকটিই ছিল।
প্রতীক | প্রার্থী | প্রতীক | প্রার্থী |
ঈগল | ১৫৫ | দোলনা | ৩ |
ট্রাক | ১২৬ | মাথাল | ৩ |
কাঁচি | ৩১ | তবলা | ২ |
কেটলি | ২৭ | সোফা | ২ |
ফুলকপি | ৭ | বেঞ্চ | ২ |
মোড়া | ৫ | দালান | ১ |
কলার ছড়ি | ৫ | আলমিরা | ১ |
ঢেঁকি | ৪ | ফ্রিজ | ১ |
তরমুজ | ৩ | বেলুন | ১ |
রকেট | ৩ |
ইসির নির্ধারিত খাট, ঘণ্টা, বাঁশি, স্যুটকেস, থালা ও চার্জার লাইট প্রতীক নেননি কেউ।
ঢাকা-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা সজল পেয়েছেন ট্রাক প্রতীক। এ প্রতীক পছন্দের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রতীকটা চলমান। এটি আমাদের উপকারে আসে তাই নিয়েছি। ভোটে জয়ী হয়ে আমিও এরকম (ট্রাকের মত) বোঝা নিয়ে চলার জন্য প্রস্তুত।
“এরকম (ট্রাকের মত) গতিশীল হয়ে আমার নির্বাচনি এলাকার জন্য কাজ করতে চাই।”
রংপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রান্সজেন্ডার আনোয়ারা ইসলাম রানীর প্রতীক ঈগল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখানকার সব থেকে স্পষ্ট প্রতীক এটা; বাকিগুলো ব্যালট পেপারে দেখা যাবে না অতটা। আর দুর্নীতি, অনিয়ম সব ঈগলের চোখে যেন ধরা পড়ে, তাই নিয়েছি।”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়াদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই ঈগল ও ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তার নির্বাচনি প্রতীক ঈগল।
পছন্দের প্রতীকের ব্যাপারে আলোচিত এই আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাখির মধ্যে একমাত্র ঈগল ঝড় তুফানের মধ্যেও নিচে নামে না; উপরে উঠে যায়। নির্ভুলভাবে নিশানা বা টার্গেট ধরতে পারে এ পাখি।”
ভোটের মাঠের লড়াইয়ে ঈগলের মতই নিশানা করে জয়ী হতে চান তিনি।
রাজশাহী-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির প্রতীক ট্রাক। ভোটের প্রচার চালানোর কৌশল হিসেবেই তিনি এই প্রতীক পছন্দ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
ট্রাক প্রতীক ভোটারদের কাছে বেশি পরিচিত হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যখন আমাকে মানুষ পচাবে যে ট্রাক খাদে পড়ে যাবে, চাকা পাংচার হয়ে যাবে; তখন তারাই আমার প্রচার করে দেবে। তাই আমার মনে হয়েছে ট্রাকটা আমার জন্য বেস্ট।”
‘বুলিংয়ের শিকারও হতে পারেন প্রার্থীরা’
পছন্দের প্রতীক নিয়ে অনেকে খুশি থাকলেও অন্য প্রতীকগুলোর ‘সমালোচনাও’ করছেন কেউ কেউ।
ঢাকা-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা সজল বলেন, “সংসদ সদস্য নির্বাচন হল জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের নির্বাচন। নির্বাচনি মান যেটা, সেই মানের সাথে প্রতীকগুলো কেমন জানি বেমানান লাগে। আরও অনেক বিষয় আছে, সে জায়গা থেকে কেন যে অন্যকিছু প্রতীক হিসেবে আসে না…।
“স্মার্ট ফোন, টিভি, স্যাটেলাইট, ফুটবল এরকম আরও বহু জিনিস আছে, সেগুলো প্রতীক হিসেবে আসতে পারত।”
ঈগল ছাড়া বাকি প্রতীকগুলোকে ‘মানসম্মত’ নয় বলে মনে করেন হবিগঞ্জ-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
তার ভাষায়, “এই প্রতীকটার মধ্যেই কেবল একটা ভালো মেসেজ আছে।”
অপরদিকে ইসি যে প্রতীকগুলো নির্ধারণ করেছে, সেগুলোর কিছু নিলে প্রার্থীরা বুলিংয়ের শিকার হতে পারেন বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকমকে তিনি বলেন, “কমিশন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য যে প্রতীকগুলো নির্ধারণ করেছে- সেগুলো প্রার্থীরা ভোটের জন্য বেছে নিলে সমাজে এক ধরনের বুলিংয়ের শিকার হবেন; বিশেষ করে নারীরা।
“এখনও আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। সবসময়ই নারীদেরকে কুৎসিত, অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের বিষয়গুলো থেকে সমাজের বেরিয়ে আসা উচিত।”
সামনের নির্বাচনগুলোতে প্রতীক নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন সাদেকা হালিম।
“তারা কোন প্রক্রিয়ায় এই প্রতীকগুলো বাছাই করেছে, জানি না। জনগণের কাছে আকর্ষণীয় হবে, এমন প্রতীক ঠিক করতে পারত। এটাকে নান্দনিক করার সুযোগ ছিল। নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়গুলোতে লক্ষ্য রাখতে হবে, এখানে রুচিবোধেরও একটা বিষয় আছে।”
তবে প্রতীকের সঙ্গে প্রার্থীর ভোট ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। ফলে কোন কোন প্রতীক নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিয়ে ভাবতে নারাজ তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কবিতা খানম বলেন, “প্রতীকগুলো নির্বাচন কমিশন বরাদ্দ করে। তাদের সম্পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছে কী ধরনের প্রতীক তারা রাখবে।
“এখন তো আর বদলানোর সুযোগ নেই, ভবিষ্যতে যারা প্রার্থী হবে তারা আবেদন করলে হয়ত বদলানো যেতে পারে।”