দেশে মুক্ত সাংবাদিকতা বিরাজ করছে; এর ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে যথেচ্ছ সমালোচনার পরিবর্তে সবকিছু ভালোভাবে জেনে সমালোচনা করার পরামর্শ দিলেন তিনি।
Published : 08 Oct 2023, 08:22 PM
বিচার বিভাগ ও বিচারালয়কে রাজনীতিকরণ না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার প্রত্যয় পুর্নব্যক্ত করেছেন।
রোববার আপিল বিভাগে নিজ এজলাসে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় আয়োজিত সংর্বধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমি চাইব বিচার বিভাগ ও বিচারালয়ে যেন কোনোভাবেই রাজনীতিকরণ না হয়। বিচারক ও আইনজীবীদের সম্মিলিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই কেবল সুবিচারের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তবেই বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে।”
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। ওই সময় সুপ্রিম কোর্টে অবকাশ চলছিল। রোববার অবকাশ শেষে খুলেছে আদালত। এদিন ছিল প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার প্রথম কার্যদিবস। রীতি অনুযায়ী বিচারকক্ষে প্রধান বিচারপতিকে সংবর্ধনা জানানো হয়।
সংবিধান বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “একটি কথা একটু অপ্রিয় হলেও বলতে চাই, কোনো বিষয়ে ভালোভাবে না জেনে বা যথেচ্ছভাবে বিচারক ও আদালত সম্পর্কে কটু মন্তব্য মোটেই সভ্যতার ইঙ্গিত বহন করে না।
“সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব হাবিবুর রহমানের ভাষায় আমিও উচ্চারণ করতে চাই-কোনো বিচারকই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সভ্য জগতে সভ্য সমালোচনার একটা অবকাশ রয়েছে। বিচারকের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার বাক স্বাধীনতার একটা অংশ বলে আমি মনে করি। আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানে এই বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।”
দেশে যে মুক্ত সাংবাদিকতা বিরাজ করছে এবং এর ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য যথেচ্ছ সমালোচনার পরিবর্তে সবকিছু ভালোভাবে জেনে সমালোচনা করার পরামর্শ দেন তিনি।
“তবে কেউ যদি স্বাধীনতার অপব্যবহার করে-তা সংবাদমাধ্যমই হোক, আইনজীবীই হোক বা যে কেউ হোক তাকে শায়েস্তা করার জন্য আদালতের হাত যথেষ্টই লম্বা,” বলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম আইন পেশার সবচেয়ে বড় মূলধন উল্লেখ করে নবীন আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “অর্থ উপার্জনের প্রতি মোহ অনেক সময় তরুণ আইনজীবীদের বিভ্রান্ত ও অনৈতিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। নতুন আইনজীবীদেরকে অর্থকড়ির এই সহজ মোহ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে হবে। তাদের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে সততার সঙ্গে লিগ্যাল প্র্যাকটিসে লেগে থাকলে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিতভাবে আসবে। এই পেশায় শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই।”
অধস্তন আদালতের বিচারকদের সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অসহায় মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ যাতে নিশ্চিত হয় তা লক্ষ্য রেখে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তিনি। অধস্তন আদালতকে বিচার বিভাগের ‘প্রেস্টিজ পয়েন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
“দায়িত্ব পালনের প্রকৃতি ও বিশালতায় আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও বিচারক হিসেবে আমাদের কারও মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সকলেই বিচারক।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “সম্মিলিতভাবে বিচারক হিসেবে আমাদের সকলের সুনাম সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে অধস্তন আদালতের ওপর; কেননা প্রাত্যহিক কাজে সবচেয়ে প্রান্তিক জায়গা থেকে একজন বিচারপ্রার্থী শুরুতেই যে আদালতের দারস্থ হন - সেটি হল জেলা পর্যায়ের কোনো আদালত। তাই জেলা পর্যায়ের আদালতসমূহে আমার যে সহকর্মী বিচারকবৃন্দ কর্মরত আছেন তাদেরকে বলব, তারা যেন কখনই সময়ের অপচয় না করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে কাজ করেন।”
আইনজীবী, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিচারপ্রার্থী মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “বিচারকের চরিত্রের সঙ্গে অহেতুক তাড়াহুড়া, হঠাৎ ধৈর্য হারানো, আইনজীবীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, আদেশ ও রায় লেখার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি আচরণ কখনই যায় না। তাই সচেতনভাবে এসব পরিহার করে চলতে হবে।”
অধস্তন আদালতের বিচারকদের সুবিধাগুলো বিবেচনায় নিয়ে তাদের দায়িত্বপালনে সহায়তা করতে আইনজীবী ও অন্যান্যদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
“একটি দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা দেশ ও জাতির জন্য গর্বের,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমার দায়িত্ব পালনকালে সতীর্থ বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ এবং আপনারা বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দের সুচিন্তিত পথ ধরে একটি দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।”
বিচার আদালতের সাক্ষী ও ভিকটিমদের সুরক্ষার জন্য দেশে এখনও কোনো আইন প্রণীত হয়নি জানিয়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, স্থানীয় প্রভাব ও ভীতিতে আক্রান্ত সাক্ষীরা সমন জারির পরও আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসে না। এলেও ভয়ে সাক্ষীরা আদালতে সত্য গোপন করেন। ফলে মামলার বিচার প্রলম্বিত হয়। অনেক সময় সাক্ষীর হাজিরা নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কলম কার্যকরভাবে সচল হয় না। বছরের পর বছর প্রলম্বিত হয় বিচার। সাক্ষীরা হয়ে পড়েন অনাগ্রহী। এসব অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। এজন্য সবার সক্রিয় ভূমিকা অনিবার্য।
যে সমাজে আইনের শাসন যতটা দৃঢ় সেই সমাজ ও রাষ্ট্র তত বেশি সভ্য ও মানবিক; এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের গুণগত মান উন্নয়নে বিচার বিভাগের অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিচারকের কর্তব্য ও আচরণ সম্পর্কে স্বীকৃত সার্বজনীন ধারণা সব সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে অভিন্ন ও ধ্রুব হিসেবে বিরাজমান বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আদালতের সংবাদ পরিবেশনে সতর্কতার পরামর্শ
সংবাদকর্মীদের প্রতি আদালত ও বিচারক সম্পর্কিত সংবাদ পরিবেশনে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “বিচারকগণ সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে কোনো বক্তব্য প্রদান করতে পারেন না। তাই সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আদালত বা বিচারক সম্পর্কিত কোনো সংবাদ পরিবেশনে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবেন।”
প্রয়োজনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার নিকট থেকে বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের আহ্বান জানান তিনি।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সংবাদপত্র দেশের সমাজ ব্যবস্থার প্রতিবিম্ব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার যেসব সাংবাদিক এই অঙ্গনে কাজ করেন তাদের বস্তুনিষ্ঠ রিপোটিংয়ের মাধ্যমে দেশের সাধারণ নাগরিকরা বিচারাঙ্গন সম্বন্ধে ধারণা পেয়ে থাকেন।
এসময় সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য নতুন কার্যালয় বরাদ্দের আশ্বাস দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনাদের বসার জন্য আমার পূর্বসূরী একজন প্রধান বিচারপতি বার ভবনে একটি কক্ষ বরাদ্দ দিয়েছেন। সেখানে স্থানের কিছুটা অপ্রতুলতা আছে বলে শুনেছি। আপনাদের জন্য আরও একটু বেশি জায়গার ব্যবস্থা করা যায় কি না বিষয়টি আমি সক্রিয় বিবেচনায় রাখব।”