গুম-খুনের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন সংস্থা চায় জাতিসংঘ

আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে যাতে একটি সংস্থা গঠন করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে প্রস্তুত বলে জানান মিশেল ব্যাশেলে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2022, 06:02 PM
Updated : 17 August 2022, 06:13 PM

স্বাধীন ও বিশেষায়িত নতুন একটি সংস্থার মাধ্যমে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাশেলে।

বুধবার বাংলাদেশ সফরের শেষ দিনে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তিনি এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

এসময় বাংলাদেশে ‘ভীতিকর’ গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘অব্যাহতভাবে’ অভিযোগ উঠেছে বলে জানান জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান।

তিনি বলেন, “তদন্তে অগ্রগতির অভাব ও অন্যান্য আইনি বাধার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের হতাশার কথা বিবেচনায় নিয়ে আমি সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি একটি স্বাধীন ও বিশেষায়িত ব্যবস্থাপনা গঠনের জন্য।

“যা গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে ভিকটিম, পরিবার ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে।”

আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এই সংস্থা যাতে গঠন করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় প্রস্তুত আছে বলে জানান ব্যাশেলে।

চারদিনের সফরে রোববার ঢাকায় আসার পর সরকারের মন্ত্রীদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক করেন তিনি।

তার এই সফরের মধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার কার্যালয়ের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান ররি মুনগোবেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল।

বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন ব্যাশেলে। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করেন।

সফরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গেও বুধবার বৈঠক করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান।

সোমবার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে গুম নিয়ে কাজ করা ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলিও উপস্থিত ছিলেন।

হাই কমিশনারের সফরে বিভিন্ন বৈঠকে মানবাধিকার পরিস্থিতির পাশাপাশি গুম-বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়টি উঠে আসে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রীরা।

সংবাদ সম্মেলনে মিশেল ব্যাশেলের বক্তব্যের বড় অংশজুড়েও ছিল এসব বিষয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের কেন্দ্রও ছিল গুম এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের অবস্থান ঘিরে।

স্বাধীন সংস্থা গঠনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘের গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে সরকারের গুরুত্ব দেওয়ার অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে।

মিশেল ব্যাশেলে বলেন, জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটিসহ সংস্থার বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে গত কয়েক বছর উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।

“এসব অভিযোগের অনেকগুলোই বর্তায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বিরুদ্ধে এবং এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাবের অভিযোগ নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।

“সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে এসব গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছি এবং এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছি।”

জাতিসংঘের প্রায় সব মৌলিক চুক্তির অংশীদার হলেও বাংলাদেশ ‘গুম থেকে রক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশন’ স্বাক্ষর করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা অনুমোদনের জন্য আমি সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি।”

এসব বিষয়ের সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনা পাঠানোর বিষয়টিও টেনে আনেন ব্যাশেলে।

তিনি বলেন, “জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সবচেয়ে বেশি সৈন্য পাঠানো দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উচিত নিজেদের বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে দেখভালের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।”

রোববার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, দেশে এখন আর গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় না।

গুমের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওইদিন বলেন, “আমাদের দেশে যেটা হয়, সেটাই আমরা বলেছি। আমরা তাদেরকে বলেছি, এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস, আমাদের দেশে শব্দ নাই।

“তবে, কিছু কিছু লোক বলেছে, ৭৬ জন লোক নাকি গত ১০ বছরে নিখোঁজ হয়ে গেছে। তারা বলেছে যে, সরকারই নাকি নিখোঁজ করেছে। ৭৬ জনের ১০ জনকে আবার দেখা গেল, পাওয়া গেছে, ঘোরাঘুরি করেছে। আর বাকিগুলো এখনও আমরা ঠিক জানি না। এটা আমরা তাদেরকে জানিয়েছি।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য নিয়ে এক প্রশ্নে মিশেল ব্যাশেলে বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে আমি বৈঠক করেছি, তারা আমাদেরকে তাদের একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।

“বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের ঘটনা সেখানে তারাও উল্লেখ করেছে। সুতরাং কেবল নাগরিক সমাজের মাধ্যমে তথ্য আসছে না, জতিসংঘের চুক্তির আওতায় বিভিন্ন সংস্থাও রয়েছে।

“এমনকি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও তাদের প্রতিবেদনে কিছু ঘটনার কথা স্বীকার করেছে। হয়ত সব ঘটনা নয়, এটা কেবল ২০২১ সালের প্রতিবেদন। তারাও বলেছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে।”

সংবাদ সম্মেলনে চিলির সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, “সরকার তাদেরটা বলবে। সরকারের হয়ে কথা বলার আমি কেউ না। তবে আমি বলছি, স্বীকার করার গুরুত্বের কথা।

“এটাকে তুলে ধরা, তদন্ত করা এবং আমি তাদের সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছি।”

জাতীয় নির্বাচন

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মতপ্রকাশ এবং বিরোধীদের জমায়েত হওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন মিশেল ব্যাশেলে।

তিনি বলেন, “নির্বাচনকালীন পর্বে বাংলাদেশে নাগরিক ও রাজনৈতিক আলোচনার জায়গা তৈরির গুরুত্বপূর্ণ সময় হয়ে উঠবে। যার মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী দল ও সাংবাদিকদের মতপ্রকাশ, সংঘবদ্ধ হওয়া এবং জমায়েতের স্বাধীনতা।

“বিক্ষোভ দমনে যাতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথ প্রশিক্ষিত করাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।”

সংলাপের মাধ্যমে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দেন চিলির সরকারপ্রধান থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার হয়ে ওঠা মিশেল ব্যাশেলে।

তিনি বলেন, “সামাজিক অস্থিতিশীলতা সংঘটিত ও ছড়িয়ে পড়ার মতো ক্ষোভ সামাল দিতে রাজনৈতিক দল ও বিস্তৃত নাগরিক সমাজের আরও সংলাপের জায়গা তৈরি করা দরকার। দরকার নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের, বিশেষ করে তরুণদের কথা শোনা।”

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে বলে উল্লেখ করেন মিশেল ব্যাশেলে।

তিনি বলেন, “এনজিওদের অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণের আইন ও নীতি এবং বড় পরিসরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রণ তাদের কার্যক্রমকে কঠিন করে তুলছে; অনেক ক্ষেত্রে বিপদজ্জনকও করে তুলছে।

“বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের নতুন ধাপে যাচ্ছে, তখন গণতান্ত্রিক ও নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের জায়গার পাশাপাশি কার্যকর ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ এবং জবাবদিহিতা জরুরি।”

স্বাধীন মতপ্রকাশে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা পর্যালোচনার সরকারকে আগেই জানানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সরকারের উত্তর ও পর্যালোচনার কাজকে ত্বরান্বিত করার রূপরেখা জানার অপেক্ষায় আছি।”

খসড়া তথ্য সুরক্ষা আইন এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নীতি নিয়ে নাগরিক সমাজ এবং জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়েছে বলেও জানান মিশেল ব্যাশেলে।

আরও খবর

Also Read: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জাতিসংঘকে জানাল সরকার

Also Read: জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সাক্ষাৎ