ঢাকার গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া ১৮২ কোটি টাকা: যাত্রী কল্যাণ সমিতি

ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের পাশাপাশি হেনস্তা, অপমান ও হত্যার ঘটনায় গণপরিবহন ব্যবহারে যাত্রীদের মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়েছে বলে দাবি করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2022, 05:49 PM
Updated : 13 Sept 2022, 05:49 PM

নগরীর গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, যাত্রীদের কাছ থেকে দিনে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে।

সংগঠনটি বলছে, এসবের প্রতিবাদ করায় তর্কের জেরে গত এক বছরে ২৫টি যাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। বাস থেকে ফেলে ১৪ যাত্রীকে হত্যা করা হয়। এছাড়া গুরুতর আহত হন ১০ যাত্রী।

মঙ্গলবার ‘যাত্রী অধিকার দিবসের’ আলোচনায় বক্তারা দাবি করেন, এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা এবং দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি সামাজিক অপরাধ বাড়ছে।

রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই’ শীর্ষক এ আলোচনাসভা হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “গত এক বছরে দুইবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয় গণপরিবহনের ভাড়া।

“এতে অস্থির হয়ে ওঠে গণপরিবহন খাত। বর্তমানে নগরীর কোনো পরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর নেই। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে।”

ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের পাশাপাশি হেনস্তা, অপমান ও হত্যার ঘটনায় গণপরিবহন ব্যবহারে যাত্রীদের মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

এ ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকায়, বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতির করা গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।

গত ২০ অগাস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই দলটি রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনে ভাড়া আদায়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলে জানানো হয়।

এতে দেখা যায়, কোনো কোনো পরিবহনে দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গত এক বছরে দুই দফা জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর গণপরিবহনে অস্বাভাবিক হারে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য শুরু হয়। নানাভাবে চেষ্টা করেও তা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিভিন্ন যানবাহনের চালক, চালকের সহকারী ও ভাড়া আদায়কারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালিকের দৈনিক জমা, জ্বালানির উচ্চ মূল্য, সড়কের চাঁদাবাজি, গাড়ির মেরামত খরচ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এমন নৈরাজ্য চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।

জাইকার সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ কোটি যাত্রায় বিভিন্ন পরিবহনে যাতায়াত করেন যাত্রীরা।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাজধানীতে যাত্রী সাধারণের যাতায়াতের ক্ষেত্রে প্রতিদিন গড়ে ১৮২ কোটি ৪২ লক্ষ টাকার বেশি অতিরিক্ত আদায় করছে বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনগুলো।

রাজধানীর ৫ হাজার বাস-মিনিবাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ লাখ বার যাত্রায় যাত্রীদের যাতায়াত হয়।

লক্কড়-ঝক্কড় এসব সিটি সার্ভিসের শতভাগ বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব বাস-মিনিবাসে যাতায়াতে যাত্রীপ্রতি মাথাপিছু গড়ে ১৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, এতে ৫০ লাখ বার যাত্রায় দৈনিক গড়ে সাড়ে ৮ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা।

এছাড়া রাজধানীতে ১৫ হাজার বৈধ অটোরিকশার পাশাপাশি ঢাকা ও আশেপাশের জেলায় আরও ১৫ হাজার নিবন্ধিত অটোরিক্শা অবৈধভাবে চলাচল করে।

মোট ৩০ হাজার অটোরিকশার দৈনিক গড়ে ১২ বার করে যাত্রা হিসাব করে ৩ লাখ ৬০ হাজার বার যাত্রা করে যাত্রী বহন করে।

এসব অটোরিক্শায় প্রতি যাত্রায় গড়ে ১৪৫ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় হয়। এতে দৈনিক ৩ লাখ ৬০ হাজার যাত্রায় যাত্রীকে অটোরিকশা খাতে বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা।

হিউম্যান হলারের ভাড়া নির্ধারণে আইন থাকলেও সরকার ভাড়া নির্ধারণ না করায় এখানে বরাবরই দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়ায় যাতায়াত করতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে।

১২ হাজার বৈধ হিউম্যান হলারের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ, লক্কড়-ঝক্কড়, স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি আরও প্রায় ১৮ হাজার হিউম্যান হলারসহ রাজধানীতে মোট ৪০ হাজার হিউম্যান হলার রয়েছে।

এসব যান দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ বার যাত্রী বহন করে। প্রতি যাত্রায় প্রতিটি যাত্রী গড়ে ৮ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হন। এতে হিউম্যান হলারের যাত্রীদের ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে।

৫ লাখ রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, ট্যাক্সিক্যাবে দৈনিক গড়ে ২ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার বার যাত্রা করে যাত্রী বহন করছে।

এসব যানবাহনে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

ভাড়া নিয়ে এমন নৈরাজ্য ঠেকাতে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

>> পরিবহন খাত আমুল সংস্কার করতে হবে। চাঁদাবাজি, অনৈতিক লেনদেন ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে। নগদ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।

>> ভাড়া নির্ধারণে মালিক সমিতির একচ্ছত্র আধিপত্য বন্ধে অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ, বুয়েটের কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ লোকজন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে বাসভাড়া নির্ধারণ কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে।

>> ব্যয় বিশ্লেষণের নামে মালিক সমিতির প্রেসক্রিপশনকে সঠিক ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না। ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির তালিকা মাঠ পর্যায়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও ক্যাবের প্রতিনিধি নিয়ে যাচাই বাচাই করে চূড়ান্ত করে ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

>> বাস ভাড়ার তালিকা সংস্কার করতে হবে। যাত্রীদের সবাই যাতে বুঝতে পারে, ভাড়ার তালিকা এমন বড় হরফে ডিজিটাল ব্যানারে বাসের ভেতরে সাঁটানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

>> পজ মেশিনের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টিকেট প্রদান করে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে।

>> ওয়েবিলের নামে ইচ্ছেমত ভাড়া আদায়, সিটিং সার্ভিস, গেইটলক সার্ভিস বন্ধ করতে হবে।

>> গণপরিবহনের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দে বসার উপযোগী আসন রাখতে হবে।

>> গণপরিবহনের বাহ্যিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। সার্বক্ষণিক পাখা চালু রাখতে হবে।

>> গণপরিবহনে যাত্রী সেবা প্রদান, যাত্রী সেবার মানোন্নয়নসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সিদ্ধাস্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যাত্রী প্রতিনিধির মতামত নিতে হবে।

>> অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে জরিমানার ক্ষেত্রে একক মালিকানার বাসে ২০ হাজার টাকা, কোম্পানির ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন, সাংবাদিক মাসুদ কামাল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য, অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের চেয়ারম্যান রফিকুল হোসেন কাজল, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন।