পাত্র ঠিক করলেন মেয়ে; দিলেন মায়ের বিয়ে

“কে কী ভাবলো, কে কী বললো, তা নিয়ে আমাদের কিচ্ছু আসে-যায় না। আমরা শুধু চাই, আমাদের মা ভালো থাকুক,” বলেছেন মেয়ে।

মেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2022, 02:36 PM
Updated : 5 Oct 2022, 02:36 PM

বাবা হয়েছেন গত, নিজেও ব্যস্ত নিজেদের সংসারে, মা হয়ে পড়েছেন একা; সেই মায়ের একাকীত্ব ঘোচাতে উদ্যোগী হলেন মেয়ে, পাত্র খুঁজে বের করলেন, দিলেন মায়ের বিয়ে।

‘আজ আমাদের মায়ের বিয়ে’- গত শুক্রবার জান্নাতুল ফেরদৌস লিজার এমন পোস্ট ফেইসবুকে হয় ভাইরাল। সঙ্গে বিয়ের কিছু ছবিও দেন তিনি। অনেকে সেই পোস্ট শেয়ার করেন, প্রশংসা করেন এই উদ্যোগের।

লিজা ও তার স্বামী মাহমুদ রনির উদ্যোগে সেদিন বিয়ে হয় ৫৩ বছর বয়সী নাদিরা বেগমের। লিজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সঙ্গীহারা বেঁচে থাকা যে কঠিন, সেই উপলব্ধি থেকে আত্মীয়-স্বজনের কটূ কথা এড়িয়ে মায়ের বিয়ের উদ্যোগ নেন তিনি।

পাঁচ বছর আগে মারা যান লিজা ও মারিয়াম জ্বীমের বাবা রুহুল আমিন। তারপর দুই মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েন নাদিরা।

ব্যবসায় লোকসান চরম আর্থিক সঙ্কট এবং আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধার করা টাকা শোধ করতে না পেরে নানান অপমানের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের অগাস্টে ঢাকার মিরপুরে নিজের সেলাইয়ের কারখানায় গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেন রুহুল আমিন।

লিজা বলেন, “মিরপুরে বাসার নিচেই ছিল আমাদের নিজেদের সেলাইয়ের কারখানা। মা মেয়েদের পোশাক সেলাই করতেন, আব্বু কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৬ সালে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাবা সেলাইয়ের ব্যবসাটি বড় করা চেষ্টা করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসায় ক্ষতি হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় কারখানা। আমরা পড়ে যাই আর্থিক সঙ্কটে।”

সেসময় লিজা ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী, তার ছোটবোন মারিয়াম পড়তেন অষ্টম শ্রেণিতে।

লিজা বলেন, “তখন আমার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার পথে। ওদিকে ঋণ সুদে-আসলে বেড়েই যাচ্ছিল। একপর্যায়ে আত্মীয়-স্বজনরা টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করে। এক আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার পর বাবাকে ঘর থেকে বেরও করে দেওয়া হয়। অপমান সহ্য করতে না পেরে আব্বু বাসায় এসে কারখানার ভেতরেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।”

বাবার মৃত্যুর পর চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয় লিজাদের। গুটিকয়েক আত্মীয়ের কাছ থেকে সহযোগিতা পেলেও বেশিরভাগই তাদের নিয়ে নানা কটূ কথা বলছিল। এমনকি রুহুল আমিনের মৃত্যুর জন্য স্ত্রী নাদিরাকে দায়ী করে আসছিল বলে জানান মেয়ে লিজা।

এরপর বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হয় মা নাদিরা বেগম এবং তার দুই মেয়ের। ফি দিতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায় লিজার পড়ালেখা।

সংসারের খরচ জোগাতে আর ছোটবোনের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে সাতটি টিউশনি আর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি শুরু করেন লিজা।

গত বছর সেপ্টেম্বরে মাহমুদ রনির সঙ্গে বিয়ে হয় লিজার। বিয়ের পর মা ও বোনকে নিজের কাছেই রেখেছিলেন তিনি। এরপরও নানা কটূ কথা শুনতে হত নাদিরাকে।

লিজা বলেন, “মা অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন। আমি আমার মায়ের জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না। বরং আমার বিয়ের পর মাকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনেরা আরও আজেবাজে কথা বলতে থাকে। একদিকে নিঃসঙ্গতা অন্যদিকে সামাজিক চাপে দিন দিন কোনঠাসা হয়ে পড়ছিলেন। মা মুখ ফুটে কিছু না বললেও বুঝতে পারছিলাম। তাই আমি, আমার স্বামী ও বোন মিলে মায়ের বিয়ের জন্য উদ্যোগ নিই।”

শুরুতে নাদিরা বিয়েতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে মেয়েজামাইও তাকে বোঝান।

“আমার মায়ের বিয়ের ব্যাপারে আমার স্বামী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করেছে। মায়ের বিয়েতে সে-ই ছিল উকিল বাবা,” বলেন লিজা।  

শাশুড়ির বিয়ের প্রসঙ্গে রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবেশটাই এমন হয়ে উঠেছিল যে আমাদের খুব নিকটাত্মীয়রা মাকে নিয়ে নানান কথা শুরু করছিল। আবারও বাবার মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে এনে তার দিকে আঙুল তোলা হচ্ছিল।

“আমি আর লিজা কিছু দিনের মধ্যেই উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে যাব। জ্বিমেরও একসময় নতুন সংসার হবে। যেহেতু আমার শাশুড়ির বাবার বাড়ির পক্ষেরও কোনো অভিভাবক নেই, আমরা চলে গেলে তার পাশে থাকার মতো কেউ নেই। তাই আমরা সবাই মিলে ভেবেচিন্তে মায়ের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বার্ধক্যে গিয়ে একজন সঙ্গীর দরকার হয়, আমরা শুধু মায়ের একজন সঙ্গীর ব্যবস্থা করেছি।”

নাদিরা বেগম রাজি হলে একটি ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে ৬০ বছর বয়সী হান্নান খানের সঙ্গে আলাপ হয় লিজার। হান্নান একটি পরিবহন কোম্পানির ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। তার সঙ্গে কথা বলে তাকে মায়ের সঙ্গী হিসেবে উপযুক্ত মনে করেন লিজা।

“মায়ের সাথে যার বিয়ে ঠিক করি, তিনিও একজন দুঃখী মানুষ। সাত বছর আগে হারিয়েছেন নিজের স্ত্রীকে। এর এক বছর পরেই তার নিজের সন্তানেরা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে সম্পর্ক শেষ করে দেয়। তার সাথে কথা বলে খুব ভালো লেগেছিল। মনে হচ্ছিল তিনি দুঃখী মানুষ, আমার মায়ের কষ্টটা বুঝবেন। পরে আমরা মিরপুরেই একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করি, তারা নিজেরা নিজেদের পছন্দ করেন। তারপর বিয়ে ঠিক হয়।”

মায়ের বিয়ে দেওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনদের কোন নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছিল কি না- জানতে চাইলে লিজা বলেন, “বিয়ের আগে থেকেই আত্মীয়রা নানান কথাবার্তা বলতে থাকে। এমনকি মায়ের বিয়ের পরে মায়ের দিকের আত্মীয়রা অভিযোগ করেন মায়ের বিয়ে যেহেতু দিয়েছিই, আরও একটু অবস্থাসম্পন্ন পাত্র ঠিক করলাম না কেন? কিন্তু আমরা সবসময়ই টাকা-পয়সার চেয়ে মা কোথায় মানসিকভাবে শান্তিতে থাকবে, সেটাই চিন্তা করেছি।”

ফেইসবুকে নানাজনের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া অভিভূত হয়েছেন লিজা।

“এত এত লোকের প্রশংসা পাব সেটা ভাবতেই পারিনি। বেশিরভাগ লোকই প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে আমাদের বয়সী তরুণ প্রজন্ম বিষয়টাকে অনেক ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। এটা খুবই ভালো একটা ব্যাপার।”

নেতিবাচক কিছু চোকে পড়েছে লিজার, তবে তা আমলে নিচ্ছেন না তিনি।

“কিছু কিছু গার্লস গ্রুপে আমার পোস্টটি শেয়ার করে লোকজন বলেছে, আমি দায়িত্ব এড়াতে আমার মায়ের বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি জানি, কোন পরিস্থিতিতে আমি আমার মায়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

বিয়ের প্রসঙ্গে কথা হয় নাদিরা বেগমের সাথে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতদিন অনেক মানসিক যন্ত্রণার ভেতর ছিলাম। এখন অনেকটাই সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। যে মানুষটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, এ কয়দিনে মানুষটা আমাকে খুবই যত্নে রেখেছেন। তিনি আমার অনেক খেয়াল রাখেন।”

পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী বলেন, “একা জীবন অনেক কষ্টের। এই কষ্ট থেকে দূরে রাখতে আমার মেয়ে আর মেয়ের জামাই আমার অন্য সঙ্গী ঠিক করে দিয়েছে। এখন বাকিটা জীবন সবাইকে নিয়ে আনন্দে কাটাতে চাই।”

নাদিরা বেগমের স্বামী হান্নান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রনি আর লিজা দুজনের কাছেই আমার অনেক কৃতজ্ঞতা। তাদের কারণেই আমি একজন সঙ্গী পেয়েছি। মনের মিলই অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের দুজনের মন-মানসিকতায় অনেক মিল আছে। আশা করছি যতগুলো দিন বেঁচে থাকব, একসাথে সুখে-শান্তিতে থাকব।”

লিজা বলেন, “৫ বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর মা অনেক কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন। গত বছর আমার বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এ সমাজে একজন বিধবার স্বামী ছাড়া একা বেঁচে থাকা যে কতটা কঠিন, সেটা মাকে দেখে বুঝতে পেরেছি।

“এ সমাজে বিধবা হওয়া, একজন নারীর একা থাকা অনেক বড় অপরাধের চোখে দেখা হয়। আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে পর্যন্ত অপবাদ দিয়েছে লোকজন। তাই বাধ্য হয়ে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক চাপ থেকে মুক্তি দিতেই মায়ের বিয়ে দিলাম।”

“কে কী ভাবলো, কে কী বললো, তা নিয়ে আমাদের কিচ্ছু আসে-যায় না। আমরা শুধু চাই আমাদের মা ভালো থাকুক। বাকি জীবন একজন সঙ্গী নিয়ে শান্তিতে থাকুক,” বলেন লিজা।