“আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, কেউ যদি ওই গাড়ি আর মানুষকে আগুনে পোড়াতে চেষ্টা করে, ওই হাত ওই আগুনে পুড়িয়ে দেবেন,” বলেন শেখ হাসিনা।
Published : 13 Nov 2023, 06:13 PM
নির্বাচন রুখতে বিএনপি ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দলটির ‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে’ জনগণকে সতর্ক থেকে অতীতের মত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার বিকেলে খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভাগীয় মহাসমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে বর্ণনা করেন ‘নেতৃত্বহীন দল’ হিসেবে।
তিনি বলেন, "নির্বাচনের সময়ে একটা বিষয় নজরে রাখতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জানে, ২০০৮ সালেই ৩০টি সিট পেয়েছে। তারা জানে যে, তাদের নেতা নেই। মুণ্ডুহীন একটা দল। একটা পলাতক আসামি (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান), একটা কারাগারের আসামি (বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া)। সেই দল এই দেশের নির্বাচন হতে দিতে চায় না। একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়।
“আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, কেউ যদি ওই গাড়ি আর মানুষকে আগুনে পোড়াতে চেষ্টা করে, ওই হাত ওই আগুনে পুড়িয়ে দেবেন। উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে দেবেন। যেন আর কেউ সাহস না পায় মানুষকে এভাবে ক্ষতি করতে।”
জনগণের জানমাল রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশে থেকে সহযোগিতা করতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, "আমি দেখেছি সেই পোড়া মানুষগুলোর দুরাবস্থা। চোখে পানি রাখা যায় না। ওদের (বিএনপি) মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ নেই। কীভাবে পুলিশকে হত্যা করেছে, সাংবাদিকদের পিটিয়েছে। ওই ধরনের ঘটনা যাতে আর ঘটাতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি এলাকায় আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা, আপনারা মানুষের নিরাপত্তা দেবেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে আপনারা নিরাপত্তা দেবেন।”
পাঁচ বছর পর খুলনা সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন দলীয় জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখনও সারা দেশে বিএনপির ডাকে অবরোধ চলছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি আবারও একই দাবিতে ফিরে গেছে। সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ২৮ অগাস্টের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচি চালিয়ে আসছে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো।
এই অবরোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই যানবাহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে, তাতে ফিরে এসেছে ২০১৩ ও ২০১৫ সালের পেট্রোল বোমার আতঙ্ক। সে সময় বিএনপি-জামায়াতের টানা হরতাল-অবরোধে ব্যাপক নাশকতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়, পোড়ানো হয় শত শত যানবাহন।
নৌকা দেবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’
২০৪১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই দেশ ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’র রূপ পাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, "নৌকা স্বাধীনতা দিয়েছে, নৌকা উন্নয়ন দিয়েছে। নৌকায় ভোট দিয়েছেন বলেই উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এই নৌকাই দেবে ’৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট জনগোষ্ঠী হবে, স্মার্ট সরকার হবে, স্মার্ট অর্থনীতি হবে, স্মার্ট সমাজ হবে। বাংলাদেশ আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন, উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হবে, জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করে আমরা তৈরি করব। নৌকায় ভোট দিয়ে আবারো সেবা করার সুযোগ দেবেন।”
প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত জনতার কাছে ভোট চাইলে তারা দুই হাত তুলে নৌকায় পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান।
‘বিএনপি মানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’
বিএনপি ‘সন্ত্রাসী দল এবং তাদের কোনো মনুষ্যত্ব নেই’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "বিএনপির কাজ হল আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারা। ২৮ অক্টোবর কীভাবে পুলিশকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। ৪৫ জন পুলিশকে আহত করেছে। সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করেছে, তাদের পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। রাজারবাগে হাসপাতালে হামলা করেছে অ্যাম্বুলেন্স পুড়িয়ে দিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে রোগীদের ওপর হামলা করেছে।
“এদের মধ্যে এতোটুকু মনুষ্যত্ব নেই। অন্তঃসত্ত্বাসহ অ্যাম্বুলেন্সে পুড়িয়ে দিয়েছে। যা তারা শুরু করেছিলো অতীতে। নির্বাচন বন্ধ করতে তখন হাজার হাজার স্কুল পুড়িয়েছিল, সরকারি-বেসরকারি অফিস পুড়িয়েছিল, কিন্তু নির্বাচন বন্ধ করতে পারেনি। জনগণ বাধা দিয়েছে। তারা সফল হয়নি।”
শেখ হাসিনা বলেন, "ওই সন্ত্রাসী দল বিএনপি-জামায়াত জোট, তারা মানুষের জন্য কাজ করে না। একজন এতিমের টাকা আত্মসাৎ করেছ কারাগারে। আর একজন মুচলেকা দিয়ে রাজনীতি করবে না বলে লন্ডনে বসে দুর্নীতির টাকা দিয়ে চলছে। তার এখানে আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে।"
ফিলিস্তিনে ‘বর্বর’ ইসরায়েল যেভাবে হাসপাতালে হামলা করেছে, বিএনপিও ‘একই কায়দায়’ হাসপাতালে হামলা করেছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
তিনি বলেন, "বিএনপিরা ইসরায়েলের কাছ থেকে মনে হয় শিক্ষা নিয়েছি। তাহলে এরা কারা? এরা কি বাংলাদেশ চায়? নাকি ধ্বংস চায়? ওরা বাংলাদেশের ধ্বংস চায়।"
নির্বাচনের আগে বিএনপি বিভিন্ন ওয়াদা দিলেও তা ‘পূরণ করে না’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “ওদের চরিত্র বদলাবে না।… এই খুলনা থেকে খালেদা জিয়া বলেছিল, ক্ষমতায় গেলে শিল্প কারখানা চালু করবে। উল্টো সব বন্ধ করেছিল। এটাই হচ্ছে তাদের চরিত্র।”
পোশাক শ্রমিকদের কাছে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন
বক্তব্যের এক পর্যায়ে বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত পোশাক কর্মীদের কাছে প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া কোন সরকার তাদের বেতন বাড়িয়েছে?
“জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া কেউ তাদের বেতন বাড়ায়নি। বিএনপিন সময়ে যে বেতন ছিল ৮০০ টাকা, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তা ১৬০০ টাকা করেছিল। এরপর কয়েক দফায় তা বাড়িয়ে ৩ হাজার ২০০ টাকা, ৫ হাজার ৩০০ টাকা, ৮ হাজার ২০০০ টাকা, সর্বশেষ ১২ হাজার ৫০০ টাকা করেছে। কোন সরকার এভাবে কাজ করেছে? যদিও বেসরকারি খাত, এরপরও মালিকদের বুঝিয়ে তা করেছি।"
শেখ হাসিনা বলেন, "সরকারি কর্মচারীদের বেতন মাত্র ৫ ভাগ বাড়িয়েছি। আর গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন ৫৬ ভাগ বাড়িয়েছি। তাহলে তাদের আপত্তি কোথায়?"
আন্দোলনকারীদের কারা উসকানি দিচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করা উচিত বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
দ্রব্যমূল্যে উর্ধ্বগতিতে মানুষ যাতে কষ্ট না পায়, সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মাধ্যমে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, "কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, দশ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেই টাকা দেওয়া হচ্ছে। দুই কোটি ৬২ লাখ কৃষক উপকার পাচ্ছে। তারা অল্প টাকায় সার কিনতে পারছে, কৃষি উপকরণ কিনতে পারছে।"
‘বাংলার মানুষ আমার পরিবার’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে মা-বাবা হারিয়ে বাংলার মানুষকে নিজের পরিবার মনে করে তাদের ভাগ্যন্নয়নেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
"বারবার আপনাদের সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। আমার চাওয়ার কিছু নাই। মা বাবা সব হারিয়েছি। তবুও আমি ফিরে এসেছি। যে মানুষগুলোর জন্য, মানুষের ভাগ্য গড়ার জন্য আমার বাবা সারাজীবন কষ্ট করেছেন, আমি তাদের ভাগ্য গড়তে চাই। ক্ষুধা দারিদ্র দূর করে উন্নত জীবন দিতে চাই। দেশের মানুষ ভালো থাকলে এটাই আমার পাওয়া।"
তিনি বলেন, "বাংলার মানুষকে আপন করে নিয়েছি। বাংলার মানুষের কাছে আমি পেয়েছি বাবা-মা-ভাইয়ের হারানো স্নেহ। বাংলাদেশের মানুষকে আমি পরিবার হিসেবে আপন করে নিয়েছি। তাই তাদের কল্যাণের জন্যই আমি কাজ করে যাচ্ছি।”
বারবার ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচতি করায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, "এজন্যই বদলে যাওয়া বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। মাথা উঁচু করে চলতে পারে। আজকের বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশ।"
স্বাস্থ্য সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ১৯৯৬ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক করে দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "এতে মা ও শিশুরাই বেশি লাভবান হচ্ছে। ২০০১ সালে এসে খালেদা জিয়া তা বন্ধ করেছিল। সে বলেছিল, যারা কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা নেবে তারা নৌকায় ভোট দেবে। আমার প্রশ্ন, যারা সেবা নিতে যায়, তারা কি আওয়ামী লীগ-বিএনপি চিন্তা করে? তাহলে বোঝেন, তারা কতটা হীনমন্যতায় ভোগে।"
খুলনার জন্য ‘উপহার’
এবারের খুলনা সফরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ২৯টি উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে কিনি বলেন, “খুলনার উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছি। আজ যা উদ্বোধন করলাম তা আপনাদের জন্য উপহার।
তিনি বলেন, "পদ্মাসেতু ও মধুমতি সেতু নির্মাণের ফলে আঞ্চলিক সুবিধা খুলনাবাসী পাচ্ছে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজ হয়েছে। খুলনা মোংলা রেলপথ কাজ শুরু হয়েছে। খুলনা থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেল লাইন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে উদ্বোধন করে দিয়েছি।
“আমরা একটা এক্সপ্রেসওয়ে ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ নামে করছি, যাতে যাতায়াত সহজ হয়। নদী ভাঙন খুলনা বিভাগের জেলাগুলো ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেজন্য সময়মতো ড্রেজিং ও নদী ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।"
বিভাগীয় এই মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক।