ভেজা চট পেঁচিয়ে রাখা সিলিন্ডার দেখে কৌতূহলীদের ভিড়, তখনই আগুন

একটা ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। বাসার মালিক সেটি বাইরে রেখে গেলে সেটি ঘিরে কিছু উৎসুক লোকজন দাঁড়িয়েছিল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2024, 04:48 PM
Updated : 13 March 2024, 04:48 PM

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাসের আগুনে এত বেশি মানুষের দগ্ধ হওয়ার পেছনে কৌতূহলী হয়ে ভিড় জমানোর তথ্য মিলেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা জানান, যে বাসায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে গ্যাস বের হতে থাকা গরম সিলিন্ডার ভেজা চট দিয়ে মুড়িয়ে বাইরে রেখে যান পরিবারের কেউ একজন। স্থানীয়দের অনেকে কী হচ্ছে সেটা দেখতে কৌতূহলী হয়ে এসেছিলেন।

ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছিল। পোশাক কারখানা থেকে বাসায় ফিরছিলেন অনেক পোশাক কর্মী। তাদের পাশাপাশি ঘটনা দেখতে ভিড় জমিয়েছিল আশপাশের শিশুরাও। এ সময়েই আগুন ধরে যায়।

বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক তেলিরচালা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে প্রায় সবাইকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে।

শুরুতে বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও পরে ফায়ার সার্ভিস ও বার্ন ইনস্টিটিউটের এক চিকিৎসক জানান, একটা ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। বাসার মালিক সেটি বাইরে রেখে গেলে সেটি ঘিরে কিছু উৎসুক লোকজন দাঁড়িয়েছিল। এ সময়েই পাশের আরেকটি বাসায় চুলা ধরাতে গেলে পুরো রাস্তায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতেই তারা সবাই দগ্ধ হয়।

ওই ঘটনায় পোশাক কারখানার শ্রমিক মো. তারেকের কোমরের নিচ থেকে দুই পা পুড়ে গেছে।

তারেক বলছেন, কারখানা থেকে ফিরে হইচই ফোনে বাইরে গিয়ে দেখেন গলির মধ্যে একটি সিলিন্ডারে ভেজা চট পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে সশব্দে গ্যাস বেরোচ্ছে। সেটি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তখন সিলিন্ডারে ঘিরে বেশ কয়েকজনকে দেখতে পান তিনি।

ফেরার জন্য কয়েক কদম গিয়েছেন, সে সময় আগুন ধরে যায়। এ সময় আশপাশে যারা ছিলেন তারা মারাত্মকভাবে ঝলসে গেছেন।

এলাকাটি পোশাক কর্মীসহ নিম্ন আয়ের মানুষের বাস। অনেকটা বস্তির আদলে গায়ে গা লাগিয়ে টিনশেড ঘর বলে জানাচ্ছেন তারেক। এই ঘরগুলোতে ভাড়া থাকেন তারা।

পোড়া রোগী আসার খবর শুনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বার্ন ইনস্টিটিউটে ছুটে আসেন। তিনি রোগী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। বলেন, “গাজীপুর থেকে নারী ও শিশু সহ মোট ৩০ জন দগ্ধ এই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ দগ্ধও আছে। এদের কাউকেই আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না।”

ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাসের অধীনেই গাজীপুরের দগ্ধ রোগীরা ভর্তি হয়েছেন। এই চিকিৎসক বলছেন, মোট ৩২ জন রোগী পেয়েছেন তারা।

“এদের প্রায় সবারই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, সেই হিসেবে এদের সবাইকেই সংকটাপন্ন বলা যায়। তার ওপরে এদের ১৫ জনের শরীর পুড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এদের মধ্যে সাতটি শিশু রয়েছে। দুটি শিশুর শরীর পুড়েছে ৯০ শতাংশের মত। এদের জীবন চরম সংকটে রয়েছে।”

তিন বছরের ছোট্ট শিশু রাহিমার দুই হাত-পা সহ শরীরের অনেকটা অংশ ঝলসে গেছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে মাঝে মাঝে চোখ মেলে কেঁদে উঠছিল শিশুটি। পাশে থাকা অস্থির মা শিশুটির গালে মুখে কপালে চুমু দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

দগ্ধ পোশাক শ্রমিক রফিকুল ইসলাম বলেন, “তেলিরচালা এলাকায় একটি বাসায় গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে শো শো শব্দে গ্যাস বের হচ্ছিল। এরপর বাড়ির লোকজন সেই সিলিন্ডারটি গলির মধ্যে ফেলে যায়।

“ইফতারের আগে ওই গলিতে যখন অনেক লোকজন চলাচল করছিল ঠিক সেই সময় আগুন লাগে। সেই আগুনে গলিতে অবস্থানকারী ও চলাচলরত লোকজন দগ্ধ হয়।”

নিজে তখন ওই গলির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন বলে জানান রফিকুল।

চিকিৎসাধীন আরিফুল ইসলাম বলেন, “ওই গলি দিয়ে যাতায়াত করা প্রায় সবাই কম-বেশি দগ্ধ হয়।”

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, “তেলিরচালা এলাকায় শফিক খান তার বাসার জন্য একটি গ্যাস সিলিন্ডার আনেন। পরে সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে লাগানোর সময় গ্যাস বের হতে থাকে। তখন তিনি সিলিন্ডারটি বাইরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেন।

“এ সময় ওই স্থানে একটি মাটির চুলার আগুন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাসে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। তখন রাস্তায় থাকা প্রায় অনেকে দগ্ধ হয়।”

ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

হাসপাতালে যে ৩২ জনকে ভর্তি করা হয়েছে তারা হলেন- আজিজুল (২৪), তারেক রহমান (১৮), মশিউর আলী (২২), তায়েবা (৩), মোসাম্মৎ নার্গিস (২৫), রমিসা (৩৬), সুমন (২৫), কবীর (৩০), তাওহিদ (৭), রাব্বী (১৩), মো. সোলায়মান (৬), সাদিয়া খাতুন (১৮), শিল্পী (৪৫), মহিদুল (২৫), শারমিন (১১), মো. নাঈম (১৩), মুন্নাফ (১৮), মো. আরিফ (৪০), মনসুর আলী (৩০), রত্না বেগম (৪০), সুফিয়া (৯), জহুরুল ইসলাম (৩২), নাদেন (২২), ইয়াসিন আরাফাত (২১), রহিমা (৩), লালন (২৪), কমলা খাতুন (৮০), সুলাইমান মোল্লা (৪৫) নিলয় (৩), নীরব (৭), কুদ্দুস (৪৫), মোতালেব (৪৮)।  

বার্ন ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এস এম আইয়ুব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, "আমাদের এখানে ভর্তি ৩২ জনের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই পনের জনের শতকরা ৫০-৯০ ভাগ পুড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।"