বইমেলায় একুশে ফেব্রুয়ারির ভিড়, সঙ্গে সাধুসঙ্গ

দেশের বাইরে থেকে এসেছেন অনেকে; আবার ঢাকায় বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদেরও দেখা গেছে মেলায় ঘুরে বেড়াতে।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2024, 04:53 PM
Updated : 21 Feb 2024, 04:53 PM

একুশে ফেব্রুয়ারির দিন বইমেলায় বেশি লোকসমাগম হবে, সেটা প্রত্যাশিতই। তবে জনতার উপচেপড়া ভিড় প্রত্যাশার মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ায় মেলা দর্শনে যোগ হয়েছে কিছুটা ভোগান্তিও।

বুধবার টিএসসিতে সড়ক দখল করে বসা হকারদের কারণে মেলায় প্রবেশে দর্শনার্থীদের ঝামেলা হয়েছে অনেক বেশি। তারপরও মানুষ মিলেছে প্রাণের মেলায়। মঞ্চে সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং খোলা চত্বরে সাধুসঙ্গ মেলায় যুক্ত করেছে ভিন্ন আমেজ।

দেশের বাইরে থেকেও এসেছিলেন অনেকে। আবার ঢাকায় বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদেরও দেখা গেছে মেলায় ঘুরে বেড়াতে। মেলা প্রাঙ্গণের মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক আয়োজন সাজিয়েছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। মেলার মূল মঞ্চেও ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বুধবার ছিল বইমেলার একবিংশতম দিন। মেলা শুরু হয় সকাল ৮টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।

সকালের প্রথম প্রহরে কেউ কেউ এসেছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে, পরে তাদের অনেকে বইমেলায় ঘুরে বেড়ান।

সকাল ৮টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। স্বরচিত কবিতাপাঠে প্রায় ১৩৫জন কবি কবিতা পাঠ করেন। সভাপতিত্ব করেন কবি শামীম আজাদ।

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসা শিক্ষার্থীদেরও মেলা প্রাঙ্গণে দেখা যায়। স্কুলের পোশাকে মেলায় ঘুরছিলেন মাইলস্টোন স্কুলের দুই শিক্ষার্থী। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে মেলায় এসেছিলেন তারা।

বিকেলের দিকে গবেষক সাইমন জাকারিয়ার সঙ্গে দেখা যায় ফ্রান্সের এক নারীকে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে লালন সাধিকা হিসেবে ইতোমধ্যে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি। নাম দেবোরাহ জান্নাত।

কথা বলে জানা যায়, জান্নাত মূলত ভাবনগর সাধুসঙ্গে অংশ নিতেই এদিন এসেছিলেন। বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স মিলিয়েই তিনি এখন বসবাস করেন। বাংলা ভাষায় কথা বলাও শিখে গেছেন। বিকাল ৪টায় মেলা প্রাঙ্গণের উন্মক্ত জায়গায় হয় সাধুসঙ্গের ৪৯১তম আসর। এই আসরে লালনের গান করেন জান্নাত।

সাইমন জাকারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা নিয়মিত সাধুসঙ্গ করি। বইমেলার মধ্যেই জায়গাটি হওয়ায় এবার অন্যরকম আমেজ ছিল সাধুসঙ্গে। আমাদের সাধুসঙ্গে অংশ নিতেই দেবোরাহ জান্নাত এসেছিল। এর আগে গত শুক্রবার বইমেলার মূল মঞ্চের সাংস্কৃতিক আয়োজনেও সে গান করেছে।"

সাধুসঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পাবনার ফকির আবুল হাশেম, বরিশালের শাহ আলম দেওয়ান, মানিকগঞ্জের অন্তর সরকার, জামালপুরের হেলাল উদ্দিন, সিরাজগঞ্জের গুঞ্জের আলী জীবন, সাধিকা সৃজনী তানিয়া, শিলা মল্লিক।

বইমেলায় বেড়াতে এবার পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসেছেন মোহাম্মদ তাহির। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে পড়তে গিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রেমে পড়েন তিনি।

মোহাম্মদ তাহির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ঢাকায় আসার পর একাধিক দিন বইমেলায় এসেছি। ঢাকায় আমার অনেক বন্ধু আছে। তাদের সঙ্গে ঘুরছি, আড্ডা দিচ্ছি। ভালো লাগছে।"

বাংলা ভাষা এবং এদেশের মানুষকে ভালো লাগে বলেও জানালেন তাহির।

মেলায় লোক সমাগমের মাঝে বই বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্টির কথা বললেন বিভিন্ন স্টলের বিক্রয়কর্মীরা। অন্তত দশটি প্রতিষ্ঠানের স্টলের বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে একইরকম সাড়া পাওয়া গেছে।

কলি প্রকাশনীর স্টলে অটোগ্রাফ দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন লেখক তুর্জয় শাকিল। তিনি মূলত থ্রিলার সিরিজ লেখেন। স্টলটির বিক্রয়কর্মীরা জানান, তার বই ভালো বিক্রি হচ্ছে।

তুর্জয় শাকিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ছেলেমেয়েরা আমার লেখা পড়েন, এটা ভালো লাগে। কাজের ব্যস্ততায় মেলায় আসার সুযোগ হয় কম। এসে ভালো লাগছে।"

মেলার অব্যস্থাপনাও এদিন বিরক্তির কারণ হয়েছে। লিটলম্যাগ চত্বরে দেখা যায়, দুয়েকটি স্টলে নীলক্ষেতের ফুটপাতের মত করে শিশুতোষ বই বিক্রি করছেন কেউ কেউ। এসব নিয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির কোনো তদারকি নেই বলে অভিযোগ করলেন কেউ কেউ।

মেলা পরিচালনা কমিটির জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, এদিন মেলার তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই জমা পড়েছে ২৩৪টি।

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে এদিন নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, শিশুসাহিত্যিক ওয়াসিফ এ খোদা, কথাসাহিত্যিক মাসউদ আহমাদ এবং শিশুসাহিত্যিক ইমরান পরশ।

বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চে বিকেল ৫টায় ‘প্রথম কবিতার বই: অনুভূতির দলিল’ এই প্রতিপাদ্যে গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন আশনা হাবিব ভাবনা, স্নিগ্ধা বাউল, সঞ্জয় ঘোষ, রিপন আহসান রিতু, মীর রবি, মাশরুরা লাকী ও মিনহাজুল হক। সঞ্চালনা করেন কবি ফারহান ইশরাক ও কথাসাহিত্যিক খালিদ মারুফ।

মূল মঞ্চ

বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০২৪। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) সরকার আমিন।

অমর একুশে বক্তৃতা দেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হাসান কবীর। সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) শাহাদাৎ হোসেন।

সরকার আমিন বলেন, "রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন ছিলেন সমাজ-সচেতন, শিক্ষানুরাগী ও জ্ঞানদীপ্ত একজন মানুষ। সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে তিনি নারী-পুরুষের ভেদাভেদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই সমান।"

আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, "বাঙালি জাতির কাছে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন এখন আর একটি নাম মাত্র নয়, বাঙালি জাতির পথ চলবার এক নিরন্তর অনুপ্রেরণা, এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েই সংগ্রাম করে তিনি জীবনের পথে, কর্মের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন।"

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল, আমিনুর রহমান সুলতান, হাসানাত লোকমান, বদরুল হায়দার, ফারহানা রহমান, সঞ্জীব পুরোহিত, নূর-এ-জান্নাত, শিমুল পারভীন এবং আরেফিন রব। 

আবৃত্তি পরিবেশন করেন আশরাফুল আলম, রূপা চক্রবর্তী ও আহ্কামউল্লাহ। এছাড়া ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’ এবং মানজারুল ইসলাম সুইটের পরিচালনায় ‘সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী’র পরিবেশনা। 

সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, কল্যাণী ঘোষ, শিবু রায়, মহাদেব ঘোষ, মিথুন জব্বার, বাবু জব্বার, আব্দুল হালিম খান, স্বর্ণময়ী মণ্ডল এবং জান্নাত-এ-ফেরদৌসী। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন প্রিয়ব্রত চৌধুরী (তবলা), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কী-বোর্ড), মনির হোসেন (গিটার) এবং মো. ফারুক (অক্টোপ্যাড)।

বৃহস্পতিবার যা থাকবে

বৃহস্পতিবার বইমেলার দ্বাবিংশতমদিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।  

বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হবে ‘স্মরণ: আসাদ চৌধুরী’ এবং ‘স্মরণ: জাহিদুল হক’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন যথাক্রমে মাহমুদা আকতার এবং কামরুল হাসান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন দিলারা হাফিজ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, খালেদ হোসাইন এবং মনি হায়দার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ড. মুহম্মদ সামাদ।