ঐতিহ্যের ঢাকের কাঠি, এরপর যাবে কার হাতে

বদলে যাওয়া সময়ে পেশা ছেড়েছেন অনেক ঢাকি; অনেকে নিজে বাজালেও সন্তানদের অন্য পেশায় দেখতে চান।

মেহেরুন নাহার মেঘলাসৌরভ হোসেন সিয়ামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2022, 04:08 AM
Updated : 24 Oct 2022, 04:08 AM

ছোটবেলায় বাবার কাছে ঢাক বাজানোর কায়দা শিখেছিলেন ষাটোর্ধ্ব সুশীল দাস, এরপর দীর্ঘ পাঁচ দশকে দেশ এবং দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর দিল্লিতেও বাজিয়েছেন; শেষ বয়সে এসে জীবন তাকে জীবনের নতুন মানে শেখাচ্ছে।

একদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় গেছে বেড়ে, অন্যদিকে সামাজিক অনুষ্ঠানের চেহারাও পাল্টে যাচ্ছে। এ পেশায় তার সংসার আর চলছে না।

নারায়ণগঞ্জের সুশীল দাস এখন বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে রিকশা চালাচ্ছেন। ঢাকের প্রতি তার সন্তানদের আগ্রহ নেই, সেজন্য তার আক্ষেপও নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের তিনি অন্য পেশায় স্বাবলম্বী করতে চান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সুশীল বলেন, “ঢাকির চাহিদা এখনও আছে, পূজা-পার্বণের সবকিছুতেই ঢাকিদের ডাক পড়ে। তবে এই দুর্মূল্যের বাজারে ঢাক বাজিয়ে টিকে থাকা কঠিন।

“ঢাকে যখন কাঠির বাড়ি পড়ে, আর বাদ্য বাজে, তখন অন্যরকম ভালো লাগে। তবে আমার দুই ছেলে লেখাপড়া করতেছে। একজন এএসসি দিছে, আরেকজন এইটে পড়ে। তারা এইদিকে মনোযোগ দেয় না। ঢাক বাজাতে পরিশ্রমও তো বেশি।”

সুশীল দাসের পৈত্রিক বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকেই ঢাক বাজানোর পেশায় আছেন।

“তখন ঘরে ঘরে ঢাকি ছিল। নিত্যদিন পূজা, গান, বিয়ার অনুষ্ঠানে গিয়া বইসা ঢাক বাজানো শুনতাম, নিজেও বাজাইতাম। নারায়ণগঞ্জেও অনেক বছর ঢাক বাজাইছি। এখন তো তেমন কাজ পাওয়া যায় না। আবার শরীরেও কুলায় না।”

ঢাকের প্রতি এখনও দুর্বলতা আছে সুশীলের। তবে নিয়মিত আর ডাক পান না, সংসার চালাতে নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালান। কিন্তু অনুষ্ঠানে ডাক পেলে সব ভুলে ছুটে যান।

পদবিতে দাস ব্যবহার করলেও ঢাকিরা ঋষি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। নারায়ণগঞ্জ শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকার যেখানে তাদের বাস, সেটি ঋষিপাড়া নামেই পরিচিত।

সরু গলি দিয়ে ঢুকলেই পাঁচ শতাধিক আধাপাকা ঘর। একটার সঙ্গে আরেকটা লাগালাগি। ঋষিপাড়ায় অন্তত ২০ জন এখনও ঢাক বাজানোর পেশার সঙ্গে যুক্ত।

শহরের দেওভোগ ও বন্দর উপজেলার ত্রিবেণী এলাকার ঋষিপাড়াতেও কয়েকজন ঢাকি আছেন। দেশজুড়েই আছে ঋষি সম্প্রদায়ের বসত।

অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত এই ঋষিরা কোথাও মণিদাস, কোথাও আবার রবিদাস হিসেবে পরিচিত। তবে কোথাও কোথাও মুসলিমদের মধ্যে বাদ্যকর শ্রেণির লোকেরা ঢাক বাজান, হিন্দুদের মধ্যেও রয়েছেন মালাকাররা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাসকারীরা পদবিতে ঋষি শব্দটিই ব্যবহার করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের খুব কাছে তিতাস নদীর পূর্বপাড়ে কাশীনগর ও সীতানগর ঋষিদের গ্রাম। সীতানগর গ্রামের কুঞ্জবিহারী ঋষি জানালেন, তাদের গ্রামে এখনও ঢাক-ঢোল বাদকদের অন্তত সাতটি দল রয়েছে।

পেশায় আইনজীবীর সহকারী কুঞ্জবিহারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের রক্তের মধ্যেই রয়েছে ঢাক-ঢোল বাদন। পেশাদার দল সাতটি হলেও পূজা-পার্বণে যখন আরও বেশি ঢাকির দরকার পড়ে তখন নতুন নতুন দল বাজাতে যায়।”

কুঞ্জবিহারীর মাধ্যমেই কথা হয় জগৎবন্ধু ঋষির সঙ্গে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে ঢাক বাজান। পূর্বপুরুষরাও একই কাজ করেছেন।

ঢাক বাজানোর কাজ না থাকলে ভাড়ায় গাড়ি চালান জগৎবন্ধু। তিনি বলেন, “সবসময় তো আর বাদ্যবাজনার কাজ থাকে না। বায়নাও আসে না। সেই সময়ে তো চলতে অইব। তাই ভাড়ায় গাড়ি চালাই।”

আগামী প্রজন্মকে এ পেশায় যুক্ত করতে চান কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের এলাকার ছেলেপেলেরা পড়ালেখাও করছে; ঢাকঢোল, হারমোনিয়ামসহ হাতের কাজ শিখছে। আমি চাই আমার পোলাপান লেখাপড়ার করনের লগে লগে গান বাজনাটাও শিখব।”

ফেনীর সোনাগাজীর ষাটোর্ধ্ব সাধন মালাকার ঢাক বাজান প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। নিজে বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রাখলেও তার ছেলের এই কাজের প্রতি আগ্রহ নেই বলে জানালেন।

“আমার কাছে অন্য ছেলেপেলেরা এসে ঢাক বাজানো শেখে। কিন্তু আমার ছেলে এই পেশায় না এসে এখন দর্জির কাজ করে।”

ঢাকিরা জানান, পূজা ও হিন্দুদের বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়াও মুসলমানদের ওরশে ব্যান্ডদলের ডাক পড়ে। ব্যান্ডদলের সঙ্গে ঢাকিও থাকেন। ঢাকিদের বেশি ডাক পড়ে অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ও ফাল্গুন মাসে। এই সময়গুলোতে হিন্দু বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি হয়।

একটি ব্যান্ড দলে ন্যূনতম পাঁচজন থাকেন। একজন ঢাক বাজান, দুজন বাঁশি, একজন করতাল ও একজন ঢোল। এক অনুষ্ঠানে ঢাক বাজালে পাঁচশ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তবে বড় কোনো পূজা মণ্ডপ বা বিয়ের বড় অনুষ্ঠানে গেলে  তবেই বেশি টাকা আয় হয়।

মা লক্ষ্মী ব্যান্ড পার্টির প্রধান বিষ্ণু চন্দ্র দাস বলেন, প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে তাদের কদর কমে গেছে।

“আগে কাজটা খুব ভালো ছিল। ওই সময় এই কাজ দিয়াই আমাদের সংসার চলত। আগে বারো মাস বয়াতি গান ছিল। এখন তো ডিজে করতেছে। সাউন্ড সিস্টেম বের হইয়া আমাগো মাইর খাওয়াইয়া দিছে।”

আবহমান কাল ধরে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই পেশা টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আশা করেন ঢাকিরা।

একটি বাজনার দলে ঢোল বাজান ত্রিশ বছর বয়সী শ্যামল চন্দ্র দাস। তার ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল চৌকির পাশে দেয়ালের তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ঢাক, ঢোল, ড্রাম, বাঁশি।

ঢোলের পাশাপাশি ঢাকও বাজাতে পারেন শ্যামল। তবে দলের প্রধান তার বাবা ঈশান দাসই ঢাক বাজানোর কাজটি করেন। তারা নিজেরাই ঢাক বানান, মেরামতও করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শ্যামল বলেন, “বাবায় ঢাক বাজায়। দাদাও বাজাইতো। তাদের কাছ থেকে এই কাজ শিখছি। ছোটবেলা বাবার সাথে গিয়া বাধ্য হইয়া বাজাইতাম। এখন রক্তে মিশে গেছে।

“ঘুমের মধ্যেও সংগীতের সাথেই থাকি। হিন্দু বিয়েতে ঢাক লাগবেই। বিয়ের বায়নাই বেশি পাই। তাছাড়া পূজা তো আছেই। এইটাই আমাদের কর্ম।”

শ্যামল বলেন, “মাঝে মাঝে অনেক ডাক পড়ে। আবার এমনও হয় দুই মাস, তিন মাস তেমন কোনো কাজ নাই। পূজার সিজন আছে এখন, বেশি কাজ। কিন্তু ভাদ্র থেকে কার্তিক মাসে তেমন কাজ থাকে না। তারপরও এই দিয়াই চলি।

“পরিবার, বাচ্চা নিয়া কোনোরকমে চলে যায়। চৌদ্দপুরুষের পেশা ছাড়তেও তো পারি না। তাছাড়া অন্য কিছু তো পারিও না।”

করোনাভাইরাস মহামারীর দুই বছর খারাপ সময় কেটেছে শ্যামলদের। সে কথা মনে করে বললেন, “এমনও হইছে, কোনো অনুষ্ঠানে গেছি কিন্তু পুলিশ আইসা সব বাদ্যযন্ত্র নিয়া গেছে। পরে টাকা দিয়া সেগুলো ছাড়াইয়া আনছি। খুব খারাপ সময় গেছে।”

চল্লিশ বছর যাবত রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ঢাক বাজান তপন চন্দ্র দাস। ঢাকি হিসেবে হাতেখড়ি হয় তার বাবার কাছেই। বাপ-দাদাদের পেশা নিজে ধরে রাখলেও সন্তানেরা একে প্রধান পেশা হিসেবে নিক তা চান না এই ঢাকি।

তপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দাদুর পর বাবা-কাকারা এই মন্দিরেই ঢাক বাজাতো। বাবার পিছে পিছে আমিও চলে আসতাম। লেখাপড়ায় মন ছিল না। খালি মন্দিরে এসে পড়ে থাকতাম। দেখতাম বাবারা কীভাবে বাজায়। দেখতে দেখতেই একদিন শিখে গেলাম।

“বাবা স্ট্রোকে মারা যাওয়ার পর আমি এখানেই ঢাক বাজানোর চাকরিটা পেয়ে গেলাম। তাও প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ১০ কি ১২।”

বড় ছেলের ঢাক বাজানোর ঝোঁক আছে জানিয়ে তপন বলেন, “আমার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলের খুব আগ্রহ আছে ঢাক শেখার প্রতি। ছোটটার আবার তেমন শখ নাই। আমি বড়জনরে বলছি, লেখাপড়ার ফাঁকে যদি এইখানে এসে ঢাক বাজাস, তাহলে তো ভালোই। আর যদি না করোস, তাহলে কোনো চাপ নাই। কারণ আমি বেশিদূর পড়ালেখা করি নাই- আমার সন্তানেরা যেন পড়ালেখা শিখে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে পারে সেটাই আমি চাই।

“আবার পূর্বপুরুষ থেকে এই কাজ করে আসতেছি, এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই আমি চাই ছেলে মন্দিরে আসুক, ঢাক বাজাক, কিন্তু পড়াশোনাটাও করুক।”

তবে পূজা-পার্বণের মওসুমে আগের চেয়ে ভালো উপার্জনই হয় বলে জানান তপন।

“আমার বাবা যখন এখানে কাজ করত, তখন দেখতাম আমাদের সংসারে অনেক কষ্ট ছিল। ঢাক বাজায়া বখশিস পাইতো পাঁচ ট্যাকা, দশ ট্যাকা। আমি প্রথম প্রথম ঢাক বাজানোর সময় দিনে পঞ্চাশ-ষাট টাকা কামাইতাম। কিন্তু এখন তো ঢাকিদের চাহিদা আবার বেড়ে গেছে। তবে সেটা পূজার সময়। দুর্গা পূজা থেকে শুরু করে কালীপূজা পর্যন্তই আমাদের রোজগারের ভালো সময়। বছরের নানান সময় ছোটখাটো কিছু পূজা হয়, সেখানেও ডাক পড়ে।”

অন্য সময় কীভাবে চলে জানতে চাইলে এই ঢাকি বলেন, “অন্যসময়ে সংসার চালাইতে একটু কষ্টই হয়। তবে যারা পূজার সিজনে বেশি টাকা কামাই করতে পারে আর সারাবছর সেই টাকাটা জমায়ে রাখে, তারা কিছুটা খেয়েপড়ে থাকতে পারে।

“কিন্তু সেসময় আবার অন্য কাজ কারবারও করতে হয়, নয়তো সংসার চলব কেমনে? তাই অনেকেই ঢাক বাজানোর বাইরে অন্যান্য কাজের সাথেও যুক্ত থাকে।”

চল্লিশোর্ধ্ব চন্দ্রমোহন দাস কিশোর বয়স থেকেই ঢাক বাজান। কাকার কাছ থেকে শিখেছিলেন। কাজ পেলেই ছুটে যান। অন্য সময় নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই নম্বর রেলগেইট এলাকায় ফুটপাতে বসে নতুন ও পুরাতন জুতা বিক্রি করেন।

তিনি বললেন, “জুতা বিক্রি কইরা, যা ইনকাম হয় সেইটা দিয়াই সংসার চলে। তারপরও ঢাক বাজানোর ডাক পাইলেই মন মানাইতে পারি না। ছুইটা যাই।”