গাছ ভেঙে পড়ে এবং দেয়াল ধসে চার জেলায় অন্তত সাতজনের মৃত্যুর খবর এসেছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
Published : 24 Oct 2022, 12:54 AM
ভোলার কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করার পর পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে এসেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং
মোংলা, পায়রা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে
ঝড়ের মধ্যে চার জেলায় অন্তত ৭ জনের মৃত্যু
ভারি বর্ষণ ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলে ক্ষয়ক্ষতি, গাছ ভেঙে যান চলাচল বিঘ্নিত, বহু জেলা বিদ্যুৎহীন
সারাদেশে লঞ্চসহ সকল ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ
আন্দামান সাগর ও সংলগ্ন দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় বৃহস্পতিবার যে লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছিল,ধাপে ধাপে শক্তি বাড়িয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপের রূপ পাওয়ার পর রোববার তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পাওয়ার পর এ ঘূর্ণিবায়ুর চক্রের নাম দেওয়া হয়েছে সিত্রাং।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দপ্তরের নির্ধারিত তালিকা থেকে ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলের ঝড়ের নাম দেওয়া হয়। সিত্রাং নামটি নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ডের প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে। এর অর্থ পাতা।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রোববার সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭১০ কিলোমিটার কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ছিল ৬২ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
ঘূর্ণিঝড়ের বর্ধিতাংশের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত মানে হল, বন্দর ঘূর্ণিঝড়-কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১-৬১ কিলোমিটার। তবে ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার মত বিপজ্জনক সময় এখনও আসেনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকলীয় এলাকার ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ এবং উপকূলীয় জেলার নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘূর্ণিঝড়টি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে মঙ্গলবার ভোর নাগাদ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।”
প্রায় একই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছে ভারতীয় আবহাওয়া অফিস।
সেখানে বলা হয়, ঘূর্ণিবায়ুর চক্রটি বাঁক নিয়ে উত্তর উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং শক্তি বাড়িয়ে সোমবার প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিতে পারে।
বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকলে সেই প্রবল ঘূর্ণিঝড় মঙ্গলবার ভোরের দিকে বরিশাল বিভাগের তিনকোনা দ্বীপ ও চট্টগ্রাম বিভাগের সন্দ্বীপের কাছ দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে ভারতীয় আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরফিুজ্জামান ভুইয়া জানান, আবহাওয়া সংস্থাগুলোর সবশেষ তথ্যানুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ অক্টোবর ভোরে বাংলাদেশের বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এর প্রভাবে ২৪-২৬ অক্টোবর উপকূলীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণা পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হবে।
এর ফলে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের অনেক স্থানে আকস্মিক বন্যা এবং পূর্বাঞ্চল. উত্তর পূর্বাঞ্চলের মুহুরী, মুন, খোয়াই, সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীরর পানি বাড়তে পারে এবং সময় বিশেষে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুল রহমান রোববার দুপুরে সরকারের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির বিভিন্ন তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমরা ধারণা করছি, গত তিন বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে ব্যাপক বিস্তৃত এলাকায় আঘাত হানবে। উপকূলীয় ১৯টি জেলাকে আমরা ঘূর্ণিঝড় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করছি। সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে আগাম প্রস্তুতির জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে।”
গত তিন বছরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ফনী, বুলবুল, আম্পান, ইয়াস, গুলাব, জোয়াদ ও সবশেষ আসানি ভারত বা বাংলাদেশ উপকূলে এসেছে।
Cyclonic Storm #Sitrang over central Bay of Bengal very likely to move North-Northeastward & concentrate into a #SevereCyclonicStorm by tomorrow, #24th October pic.twitter.com/DO4O2tkMMR
— Meteorological Centre, Bhubaneswar (@mcbbsr) October 23, 2022
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশের পায়রা উপকূলের ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসায় সংকেত বাড়িয়েছে আবহাওয়া অফিস।
মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারী সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হঁশিয়ারী সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদীবন্দরসমূহকে ৩ নম্বর নৌ-বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বিরূপ আবহাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সোমবার সকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদীবন্দরে ৩ নম্বর নৌ-বিপদ সংকেত জারি করেছে।
বিআইডব্লিউটিএ এর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোবারক হোসেন মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ৩ নম্বর নৌ-বিপদ সংকেত থাকলে কোনো লঞ্চ চলবে না। তাই দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, ঢাকায় এখন ২ নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারি সংকেত রয়েছে। এই সংকেতে ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘের কোনো লঞ্চ চলাচল করবে না।
ঢাকা সদরঘাটে কর্মরত বিআইডব্লিউটিএ এর পরিবহন পরিদর্শক পিএম সিদ্দিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকালে সদরঘাট থেকে তিনটি লঞ্চ চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, আর বরিশালের মুলাদীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় দুটি লঞ্চ। তবে ভোলা, পটুয়াখালী বা ঝালকাঠির পথে কোনো লঞ্চ ছাড়েনি।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৯০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ- দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
ঘৃর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে সে সময় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান বলেন, “এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে মঙ্গলবার সকাল ভোররাত বা সকাল নাগাদ নাগাদ খেপুপাড়ার নিকট দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।”
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের বড় এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকলীয় এলাকার ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা/ঝড়ো বাতাস বয়ে যেতে পারে, সেইসাথে ভারি (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারি ৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে।
অমাবশ্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৮ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে হালকা-মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে পটুয়াখালীর উপকূল জুড়ে।
সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিস ৭৯.৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে; কলাপাড়ায় সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় রেকর্ড হয়েছে ১১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।
জেলায় ৭০৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ও ২৬টি মুজিব কিল্লাও প্রস্তুত রেখেছে প্রশাসন।
প্রতিটি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম, পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, শুকনা খাবার এবং নগদ অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ধেয়ে আসার খবরে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দমকা হাওয়ায় সোমবার সকালে পিরোজপুরের ইন্দুরকানী, ভাণ্ডারিয়া ও মঠবাড়িয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় কিছু গাছ উপড়ে পড়েছে। তবে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিত্রাং মোকাবেলায় জেলায় ২৬০টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া ১৭৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় দেওয়া যাবে ১ লাখ ২৮ হাজার ২৫০ জনকে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ২৫০ মেট্রিকটন চাল এবং নগদ ১ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
চিকিৎসার প্রয়োজনে মোট ৬৩টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং স্যালাইনসহ বিভিন্ন ওষুধের পর্যাপ্ত যোগানও রাখা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা, বড়মাছুয়া এবং ইন্দুরকানী উপজেলার টগরাফেরিঘাট এলাকার প্রায় ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত।
মঠবাড়িযার খেতাছিড়া, কঁচুবাড়িয়া ও বড়মাছুয়া ভাঙন এলাকায় কিছু গাইড ওয়াল দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৮৩০ কিলোমিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে।
ঝড়ের প্রভাবে বাগেরহাটের নদ-নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বেড়িবাঁধ উপচে বা ভেঙে নদী তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ২২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে শরণখোলা উপজেলার ৬৫ কিলোমিটার বাঁধ সুরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু মোরেলগঞ্জ ও রামপাল উপজেলার দেড়শ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।
কোন অংশে বাঁধ ভেঙে গেলে তা মেরামতের জন্য ১৫ হাজার জিও ব্যাগ ও ৫ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ প্রস্তুত রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী তিন থেকে সাত ফুট পর্যন্ত জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, ফলে এসব এলাকা প্লাবিত হবে।
মোংলা বন্দরের দেশি-বিদেশি জাহাজ ও ছোটবড় নৌযানগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
জেলার ৩৪৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে দুই লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে শুকনা খাবার।
দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য নগদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও প্রায় ৩০০ মেট্রিকটন চাল মজুদ রেখেছে জেলা প্রশাসন।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এখনও কয়েকশ কিলোমিটার দূরে থাকলেও এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে চলছে তুমুল বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়া। দেশের উপকূলীয় সব জেলাতেই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে।
অস্বাভাবিক জোয়ারে নোয়াখালীর উপকূলীয় তিন উপজেলা হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জে অন্তত ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আসতে শুরু করেছে মানুষ।
হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিনাজ উদ্দিন জানান, দ্বীপের বান্ধাখালী, মোল্লা গ্রাম, মুন্সি গ্রাম ও মদিনা গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম হোসেন জানান, সেখানে ২৪২টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং ৩ হাজার ৫৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
নোয়াখালী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, হাতিয়া, সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহিৃত করে ৩ লাখ লোকের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৪০১টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূলের দিকে এগিয়ে আসায় চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি থেকে পণ্যবাহী ১৮টি জাহাজ বহির্নোঙরে সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর এই বন্দরে ৬ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বললেও সমুদ্র বন্দরের নিজস্ব সর্তকর্তা অ্যালার্ট-৩ জারি করা করা হয়েছে।
বিকেল ৫টা পর্যন্ত বন্দর থেকে পণ্য খালাস অব্যাহত থাকবে, এরপর পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বন্দরের যন্ত্রপাতি সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
সোমবার পর্যন্ত বন্দরের জেটিতে প্রায় ৩৫ হাজারের মত কন্টেইনার আছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার তাসনিম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিকাল ৩টা থেকেই তারা এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করছেন। মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত বিমানবন্দরে কোনো উড়োজাহাজ ওঠানামা করবে না।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরও সোমবার সন্ধ্যা থেকে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (অপারেশন ও প্ল্যানিং) এয়ার কমডোর সাদিকুর রহমান চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বিমানবন্দরগুলোতে আপৎকালীন প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আবহাওয়ার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে।”
বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সকাল থেকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট কমিয়েছে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো। তবে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম দুপুর পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই চলছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করায় সারাদেশে লঞ্চসহ সকল ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম সোমবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উপকূলীয় জেলাগুলোর নদীবন্দরে তিন নম্বর নৌ বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আর অন্যান্য জেলার নদীবন্দরগুলোতে দেখানো হচ্ছে দুই নম্বর সংকেত।
“সকালে চাঁদপুর রুটে কিছু লঞ্চ চলাচল করলেও দুপুর থেকে সারাদেশে লঞ্চসহ সকল নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে পরবর্তীতে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে।”
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মঙ্গলবার যেসব পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, তা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে স্থগিত করা হয়েছে।
সোমবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরুরি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার ছাড়া অন্যান্য দিনের পরীক্ষার সূচি অপরিবর্তিত রয়েছে।স্থগিত সব পরীক্ষার নতুন সূচি শিগগিরই জানিয়ে দেওয়া হবে
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মোংলা বন্দরে অবস্থানরত দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহনের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। বন্দরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করা হয়েছে।
মোংলা বন্দর সচিব কালাচাঁদ সিংহ বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বন্দর জটিতে থাকা সকল জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বহির্নোঙরে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবেলায় উপকূলীয় জেলাগুলোর ৭ হাজার ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ২৫ লাখ মানুষ ঠাঁই নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান।
সিত্রাংয়ের যে বিস্তার, তাতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ জেলায় এ ঝড় তাণ্ডব চালাতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
এই জেলাগুলো হল– বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনী। এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দ্বীপ অঞ্চল মহেশখালী, হাতিয়া, সন্দ্বীপ এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে বরগুনা সদর, পাথরঘাটা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব বেশি পড়বে বলে মনে করছেন এনামুর রহমান।
দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোয় ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের পূর্বাভাস বলছে, বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের চোখ বা কেন্দ্রভাগ পটুয়াখালীর রাঙাবালি বা চর মন্তাজ এলাকায় উপকূল স্পর্শ করবে। তখন বাতাসের গতিবেগ থাকবে সর্বোচ্চ ৫০ নট বা ঘণ্টায় ৯৩ কিলোমিটারের মত।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় সার্বিক পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও তদারকিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার কার্যালয়ে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে।
মনিটরিং সেলের হটলাইন নম্বরগুলো হল- 1769010986, 02-55029550 ও 02-58153022। ফ্যাক্স নম্বর 02-9102469
প্রয়োজনে সেলের হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
সোমবার বেলা ১২টায় এ ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৪০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ- দক্ষিণপশ্চিমে ঘূর্ণিঝড়টি অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে সে সময় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সানাউল হক মণ্ডল সোমবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, এ ঝড়ের ব্যাস ৪০০-৫০০ কিলোমিটার। ফলে উপকূলীয় অধিকাংশ জেলা এর প্রভাবের আওতায় থাকবে।
ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মাঝামাঝি এলাকায় উপকূল অতিক্রম করেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং।
মোংলা ও পায়রার পাশাপাশি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকেও ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। তবে কক্সবাজারের জন্য আগের মতই ৬ নম্বর বিপদ সংকেত বহাল রয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্ধ্যায় উপকূল স্পর্শ করে সিত্রাং অতিক্রম শুরু করছে। এখন জলোচ্ছ্বাস ও ভারি বর্ষণ হবে। এটা মাঝারি ঘূর্ণিঝড় ধরনের; বাতাসের গতিবেগ রয়েছে ৬২-৮৮ কিলোমিটার।”
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রবন্দর থেকে ২৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ২৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
এ ঝড়ের ব্যাস ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ফলে এর বর্ধিতাংশ ইতোমধ্যে স্থলভাগে তাণ্ডব চালাতে শুরু করেছে। পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালীসহ উপকলীয় জেলাগুলোতে প্রবল ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি চলছে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানাচ্ছেন।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের পূর্বাভাস বলছে, বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের চোখ বা কেন্দ্রভাগ পটুয়াখালীর রাঙাবালি বা চর মন্তাজ এলাকায় উপকূল স্পর্শ করবে। তখন বাতাসের গতিবেগ থাকবে সর্বোচ্চ ৫০ নট বা ঘণ্টায় ৯৩ কিলোমিটারের মত।
সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার ভোরের মধ্যে ভোলার পাশ দিয়ে এ ঝড় পুরোপুরি উপকূলে উঠে আসবে বলে ধারণা করছে আবহাওয়া অফিস।
চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। তবে কক্সবাজারের জন্য আগের মতই ৬ নম্বর বিপদ সংকেত বহাল রয়েছে।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চীদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় রয়েছে। এসব এলাকায় ভারি বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
আর কক্সবাজার জেলা ও তার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় রয়েছে। এসব এলাকায় ভারি বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
এছাড়া সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফরিদপুর, ঢাকা, মাদারীপুর, গোলাপলগঞ্জ, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদীবন্দরে ৩ নম্বর নৌ-বিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, অমাবশ্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৮ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার সন্ধ্যায় উপকূল অতিক্রম করার আগ পর্যন্ত উপকূলীয় ১৫ জেলায় দুই লাখ ১৯ হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে অর্ধলক্ষাধিক গবাদি পশুকেও নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান এর আগে জানিয়েছিলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপকূলীয় জেলাগুলোর ৭ হাজার ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ২৫ লাখ মানুষ ঠাঁই নিতে পারবে।
চর ফ্যাশনের ইউএনও আল নোমান জানান, সন্ধ্যা থেকেই ঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে ভারি বর্ষণ চলছে।
“স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১২০০ লোক উঠেছে। তাদের রাতে খিঁচিুড়ি খেতে দেওয়া হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।”
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার রাত ৯টায় ভোলার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে বলে জানিয়েছেে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের বুলেটিনে জানানো হয়েছে, এটির পুরোপুরি উপকূল অতিক্রম করতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগবে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটারে বাড়ছে।
ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ভোলার দৌলতখান ও চরফ্যাশনে এবং নড়াইলের লোহাগড়ায় গাছ ভেঙে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় দেয়াল ধসে মারা গেছেন এক রিকশাচালক।
ভোলার দৌলতখানে বিবি খাদিজা (৮০) নামে এক বৃদ্ধা মারা যান। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তার ঘরের উপর গাছ ভেঙে পড়লে তিনি চাপা পড়েন। চরফ্যাশনের ইউএনও আল নোমান জানান, সেখানে আলম স্বর্ণকার নামে এক ব্যক্তি ভেঙে পড়া গাছের ডালের সঙ্গে আঘাত পেয়ে নিহত হন। তিনি উপজেলার এওয়াজপুর এলাকার বাসিন্দা।
আলমসহ তিনজন মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। পথে একটি গাছের ডাল ভেঙে পড়ে তাদের উপর।
দুপুরে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে গাছের ডাল ভেঙে পড়লে নিহত হন মর্জিনা বেগম (৪০) নামে এক নারী। তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর আলী।
ঢাকার ঝিগাতলার মনেশ্বর রোডে চার তলা ভবনের ছাদের রেলিং ভেঙে পড়লে নিহত হন এক রিকশাচালক। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মঙ্গলবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞিপ্তিতে ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, "যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানও বন্ধ থাকবে।"
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় তিন ঘণ্টা।
রাজধানীতেও বিভিন্ন সড়কে গাছ উপড়ে পড়ে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি বিদ্যুৎ সরবরাহও বিঘ্নিত হচ্ছে। দিনভর বৃষ্টিতে বিভিন্ন সড়কে পানি জমে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে।
গণভবনের সামনে, কুর্মিটোলা, মার্কিন দূতাবাসের সামনে, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, নীলক্ষেত, হাতিরঝিল এলাকায় গাছ উপড়ে সড়কে চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। খবর পেয়ে সেসব জায়গার গাছ সরানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে গেছেন।
গাছ পড়ে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ায় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, শ্যামপুর, উত্তরখানসহ নগরীর বিভিন্ন জায়গার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বলেন, “৩৩ কেভির গ্রাহক যারা আছেন বিভিন্ন সিমেন্ট কারখানা ও স্টিল মিলস, তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে।
তিনি জানান, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, শ্যামপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় গাছ পড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৩০টি স্থানে ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ অপসারণ করার কথা জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস উপকূলীয় এলাকার সকল ফায়ার স্টেশনকে স্ট্যান্ডবাই ডিউটি দেওয়া হয়েছে। উপপরিচালক (অপারেশন্স ও মেইনটেন্যান্স) কামাল উদ্দীন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয়ভাবে খোলা হয়েছে ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মনিটরিং সেল’।
ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত সাহায্যের জন্য মনিটরিং সেলের নম্বরগুলোতে যেকোনো সময় ফোন করা যাবে। হটলাইন: ১৬১৬৩, টেলিফোন: ০২-২২৩৩৫৫৫৫৫, মোবাইল: ০১৭৩০-৩৩৬৬৯৯। এছাড়া কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষসহ সকল বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নিয়মিত ফোন নম্বরগুলোও সচল রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে মাঠের আমন ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ক হলেই কেটে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
সোমবার বিকালে মন্ত্রণালয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় জরুরি প্রস্তুতিমূলক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
>> জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দপ্তর/সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল এবং সার্বক্ষণিক কর্মস্থলে অবস্থানের নির্দেশ।
>> সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কৃষি বিভাগের অফিসে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা।
>> ঘূর্ণিঝড় পূর্ব প্রস্তুতি ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কৃষকদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া।
>> উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক মাঠে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া।
>> ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন করে জরুরি ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেওয়া।
>> ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কৃষকদের পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া যায়।
>> যেসব এলাকায় আমন ধান ৮০ শতাংশ পেকেছে সেগুলো কাটার পরামর্শ দেওয়া।
>> উপকূলীয় এলাকায় ফসল ক্ষেতে পানি ঢুকলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা।
>> জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কৃষি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক সমন্বয় করা।
>> স্লুইচ গেট অপারেশনের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি শস্য ক্ষেতে প্রবেশ রোধ ও অধিক উচ্চতায় জোয়ারের কারণে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে তা নিষ্কাশনের দ্রুত ব্যবস্থা করা।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের বেশিরভাগ অংশ উঠে এসেছে স্থলভাগে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশের সকল পুলিশ সদস্যকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
সোমবার বিকালে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এক ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে সকল রেঞ্জ ডিআইজি, মহানগর পুলিশের কমিশনার, নৌ পুলিশ প্রধান, হাইওয়ে পুলিশ প্রধান, ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধান এবং উপকূলবর্তী জেলার পুলিশ সুপারদের তিনি এই নির্দেশ দেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইজিপি দুর্যোগকালে আশ্রয়কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও স্থাপনা ছাড়াও জনগণের জানমাল রক্ষাসহ তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি বলেন, “আপনারা স্থানীয় প্রশাসন এবং অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ণ এলাকার জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করবেন।”
ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে নিজেদের জীবন, পুলিশের স্থাপনা, অস্ত্র-গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম রক্ষার ব্যাপারে নজর দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষও স্থাপন করার কথা জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, বিঘ্নিত হচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্ক।
পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওজোপাডিকোর নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার বিদ্যুৎ শতভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। ঝড়ের কারণে বিতরণ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
“সাধারণত ওজোপাডিকোর বিতরণ এলাকাগুলোতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। রাত ১০টায় আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় সর্বসাকূল্যে লোড ছিল ১৬০ মেগাওয়াট। বিতরণ লাইন বন্ধ হওয়া ছাড়াও ঝড়ের কারণে চাহিদাও কিছু কমেছে।”
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক (সিস্টেম অপারেশন) রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দেশে পল্লী বিদ্যুতের ৮০টি সমিতির মধ্যে উপকূলীয় ৩০টি সমিতিতে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কিছু এলাকায় গাছ পড়ে খুঁটি ভেঙেছে, কোথাও লাইন ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তবে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর রাত ১০টা পর্যন্ত আসেনি।
দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে কিছু এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়েছে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
ঢাকায় অবস্থানরত উপকূলীয় এলাকার কিছু বাসিন্দা জানিয়েছেন, বিকাল থেকে তাদের স্বজনদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে বৈরী আবহাওয়ায় ৬০টি অভ্যন্তরীণ এবং তিনটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিলের তথ্য পাওয়া গেছে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিমানের ১০টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট, নভোএয়ারের ২২টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এবং ইউএস-বাংলার ২৮টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
বিমানের বাতিল ১০টি ফ্লাইটের মধ্যে চারটি কক্সবাজারের এবং ছয়টি চট্টগ্রামের ফ্লাইট ছিল।
সিঙ্গাপুর থেকে আসা বিমানের বিজি-৫৮৫ ফ্লাইটটি প্রবল বাতাসে শাহজালালে নামতে না পেরে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ৭৮ জন যাত্রী নিয়ে সিলেটে নামে।
তীব্র বাতাসের কারণে সন্ধ্যায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের চেন্নাই থেকে আসা ফ্লাইটটি শাহজালালে অবতরণে ব্যর্থ হয়ে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে নামে। একইভাবে বিমানের সিঙ্গাপুর থেকে আসা একটি উড়োজাহাজ ঢাকায় নামতে না পেরে সিলেটে নামে।
এছাড়া চীনের গুয়াংজু থেকে আসা সৌদিয়া এয়ারলাইনসের একটি কার্গো উড়োজাহাজ ঢাকায় নামতে না পেরে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে নেমেছে বলে বিমানবন্দর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটগুলো মোটামুটি নির্ধারিত সময়েই নেমেছে ও উড়েছে। পাইলটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু-একটি বিকল্প এয়ারপোর্টে যায়।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে এবং দেয়াল ধসে দেশের চার জেলায় অন্তত সাতজনের মৃত্যুর খবর এসেছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বহু এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায়।
এর মধ্যে ভোলার দৌলতখান ও চরফ্যাশন এবং নড়াইলের লোহাগড়ায় গাছ ভেঙে তিনজনের মৃত্যু হয়।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঝড়ো বাতাসে ঘরের ওপর গাছ পড়ে প্রাণ যায় এক দম্পতি এবং তাদের চার বছরের শিশুর।
এছাড়া ঝড়ের সময় ঢাকার হাজারীবাগেও দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যুর খবর দিয়েছে পুলিশ।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার সন্ধ্যায় উপকূল অতিক্রম করার পর রাত ১০টা পর্যন্ত উপকূলীয় ১৫ জেলায় ৬ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে এক লাখ ১৯ হাজারের বেশি গবাদি পশুকেও নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
রাতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপকূলীয় এসব জেলায় ৬ হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছিল, যেখানে ৩৯ লাখ ৭৭ হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূলে উঠে আসার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে; পরিণত হয়েছে স্থল নিম্নচাপে।
দেশের চারটি সমুদ্রবন্দরকে বিপদ সংকেত নামিয়ে ফেলতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সোমবার মধ্যরাতের পর ঘূর্ণিঝড়টি ভোলার কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক।
তিনি বলেন, মোংলা, পায়রা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ঝড়ের আগে মোংলা, পায়রা, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত এবং কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছিল।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার বলছে, ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা সিত্রাং ঢাকা পেরিয়ে এখন সিলেট অঞ্চল অতিক্রম করছে।