সুযোগ-সুবিধা একই থাকলেও সংসদ নেতা সময়ে সময়ে সংরক্ষিত আসনের এমপিদের উন্নয়নের লক্ষ্যে এলাকা বা জেলার দায়িত্ব ভাগ করে দেন।
Published : 08 Mar 2024, 01:32 PM
প্রতি পাঁচ বছর পর সংসদ নির্বাচন শেষে আইনসভার সংরক্ষিত আসনে নারী এমপি নির্বাচনে প্রার্থী এবং বিভিন্ন দলের দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ে। গেল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
কিন্তু মাঝেমধ্যে সংসদ অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়া, বিভিন্ন কমিটিতে এসব নারী সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি ছাড়া তাদের খুব একটা তৎপরতা চোখে পড়ে না।
যদিও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরাসরি ৩০০ আসনে নির্বাচিত সদস্যের মতোই সংরক্ষিত ৫০ আসনের সংসদ সদস্যদের ভূমিকা সমান।
কিন্তু সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসা ৩০০ সংসদ সদস্যের সংসদীয় এলাকা নির্ধারিত থাকলেও সংরক্ষিত আসনের এমপিদের এলাকাভিত্তিক কার্যপরিধি বা দায়িত্বের বিষয়ে সংবিধানে আলাদাভাবে কিছু নেই। সংরক্ষিত আসন থাকবে শুধু এটা বলা রয়েছে।
সুযোগ-সুবিধা একই থাকলেও সংসদ নেতা সময়ে সময়ে সংরক্ষিত আসনের এমপিদের উন্নয়নের লক্ষ্যে এলাকা বা জেলার দায়িত্ব ভাগ করে দেন।
এমন অবস্থায় নারী সংসদ সদস্যদের সব স্তরে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর তাগিদ এসেছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন এখন ৫০টি। এসব আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বহাল রেখে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয় ২০১৮ সালে।
দ্বাদশ সংসদে নির্বাচিত ৫০ জন্য সংসদ সদস্য হিসেবে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন।
৩ মার্চ সংরক্ষিত মহিলা আসনের নব-নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ওরিয়েন্টেশন কর্মসূচি উদ্বোধনকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, জাতীয় সংসদে অনির্বাচিত কেউ আসতে পারে না, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদ দ্বারা নির্বাচিত।
তিনি বলেন, সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। এর আলোকেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। জাতীয় সংসদের সকল কর্মকাণ্ড কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। তাই মহিলা সংসদ সদস্যদের কার্যপ্রণালী বিধি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দৌহিত্রী আরমা দত্ত এবার দ্বিতীয় দফায় সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হয়েছেন। কুমিল্লা জেলার উন্নয়নে তিনি কাজ করবেন বলে জানান।
আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের গুরুত্ব অনেক। এটা তো একটি নতুন বলয়। সংসদের নিয়মকানুন ও দায়িত্বের জায়গাটায় যদি আমাদের ওরিয়েন্টেশন দিত, তাহলে নারীদের জন্য আরও ভালো হতো।
“সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের পলিসি লেভেলে ও স্ট্যান্ডিং কমিটিতে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে তাদের। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে তাদের অভিজ্ঞতা অনেক। সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাও রয়েছে।”
দ্বাদশ সংসদের এ সদস্য জানান, সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধির বিষয়ে এই নারী সংসদ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
তৃতীয়বার সংসদ সদস্য হয়ে ওয়াসিকা আয়শা খান এবার অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পেয়েছেন।
সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যের পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনে জিতে আসা সংসদ সদস্যদের বিষয়ে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই বলে মনে করেন তিনি।
ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, “আদর্শ সমুন্নত রেখে জননেত্রী শেখ হাসিনার রূপান্তরকারী নেতৃত্ব সামনে রেখে সর্বোচ্চ মনোযোগ সহকারে কাজ করলে কোনো সীমাবদ্ধতা নাই।”
জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নুরুন নাহার বেগম বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। নারীরা যেন ভূমিকাটা পালন করতে পারে, সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।”
সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা একই থাকলেও উন্নয়ন বরাদ্দে যেন বৈষম্য না হয় সে বিষয়ে জোর দেন সংশ্লিষ্টরা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীরা নানাক্ষেত্রে বাধা সম্মুখীন হয় উল্লেখ করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়া জাতীয় পার্টির এই ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, “নারীরা কাজ করতে গেলে অনেক বাধাবিঘ্ন আসে। অনেকে কাজ করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হন, নানান কথা শোনেন। এই জায়গাটায় পরিবর্তন আসা দরকার। এর মধ্য দিয়েও নারীরা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কাজ করার।”
সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি বিশেষজ্ঞ ও সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখার সাবেক যুগ্মসচিব এ কে মোহাম্মদ হোসেন জানান, আইন প্রণেতা হিসেবে ‘ফাংশন ও পাওয়ার’ ৩৫০ সংসদ সদস্যের সমান। ৩০০ সংসদ সদস্য সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত আর সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যরা।
তিনি বলেন, “আসনওয়ারি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও সংসদে সবাই পুরো দেশের জন্য কাজ করছে। আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার মধ্যে রাখবে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে আইন-বিধি অনুযায়ী তাদের ভূমিকা রয়েছে।”
>> সরাসরি ভোটের জন্য ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে ১৯৭৩ সালে ১৫টি ছিল সংরক্ষিত নারী আসন। পরে তা বাড়িয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সংসদে ৩০টি করা হয়।
>> আইনের মেয়াদ না থাকায় চতুর্থ সংসদে ছিল না সংরক্ষিত নারী আসন। একই কারণে অষ্টম সংসদের শুরুতেও ছিল না নারীদের সংরক্ষিত আসন। তবে ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী এনে আসন বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়।
>> নবম সংসদেও ছিল ৪৫ আসন। এ সংসদেই ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে আরও ৫ আসন বাড়িয়ে সংরক্ষিত আসন করা হয় ৫০টিতে।
নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ালে রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু সহায়ক
নির্বাচক বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, “সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যদের যে ভূমিকা থাকা দরকার সংসদে, সেভাবে আমরা দেখতে পাই না। নারীরা সংসদে সেভাবে বিষয়গুলো উত্থাপন করতে পারেন না বা করেন না। সংসদে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। এক্ষেত্রে আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার।”
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের বেশ কিছু ভূমিকা রয়েছে, তবে সেটা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তিনি।
ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নারীর নেতৃত্বে দেশ চললেও নারীরা রাজনীতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন বলেও মত এ নির্বাচন বিশ্লেষকের।
তিনি বলেন, প্রতিটি দলেরই দায়িত্ব আছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মূল কমিটিগুলোতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে শক্ত নির্দেশনা দেওয়ার।
“কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ২০ শতাংশের বেশি নারী নেই বলে মনে করি, অনেকের আরও কম রয়েছে। এজন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর একটি রোডম্যাপ তৈরি করা দরকার।”
আব্দুল আলীম বলেন, “নির্বাচন কমিশন প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে একটি বাৎসরিক রোডম্যাপ তৈরি করতে বলতে পারে। প্রতি বছরের শেষ নাগাদ তারা কত শতাংশ করতে পারল সেটি তারা টার্গেট সেট করবেন, যেটা ইসিতে জমা দিলে ইসি সেটা মনিটরিং করতে পারবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি নারীবান্ধব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো একটি রাজনৈতিক দলের এমন কোনো নির্দেশনা নাই যে, নারী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, বা তাদের সেইফটি বা সিকিউরিটি নিয়ে কোনো পলিসি বা নির্দেশনা নাই। এগুলো করা দরকার। যেন নারীরা নিরাপদবোধ করে ও বিনা বাধায় কথা বলতে পারে।”
সম্প্রতি প্যারিসে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি আয়োজিত উইমেন স্পিকার্স সামিটের এক গোলটেবিল বৈঠকে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে আসে।
ওই বক্তব্যে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোতে শতকরা তেত্রিশ ভাগ নারী থাকার স্থলে বর্তমানে আছে শতকতা ২২ থেকে ২৪ ভাগ। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও বেশি সংখ্যায় নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে। এ বিষয়ে উপযুক্ত আইন ও নীতি গ্রহণ করা আবশ্যক।”
আরও পড়ুন