সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন আরও ২৫ বছর

জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য নির্বাচনের বিধান আরও ২৫ বছর বহাল রাখার প্রস্তাব সম্বলিত সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2018, 12:57 PM
Updated : 8 July 2018, 01:00 PM

রোববার বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল-২০১৮’ বিবেচনার জন্য গ্রহণ করার প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ প্রস্তাব করেন।

বিকাল ৩টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করে স্পিকার বিল পাসের প্রক্রিয়ায় যান।

সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এসময় উপস্থিত ছিলেন।

স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রথমে বিলটির ওপর জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব এবং সাধারণ নীতির ওপর আলোচনা শুরু করেন।

বিলের ওপর জনমত যাইয়ের প্রস্তাব দেন জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিন, ফখরুল ইমাম,  রওশন আরা মান্নান, নূরুল ইসলাম মিলন, কাজী ফিরোজ রশীদ, নূর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, আব্দুল মুনিম চৌধুরী ও স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী।

সংবিধান বিলটি বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী, জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিন, ফখরুল ইমাম, রওশন  আরা মান্নান, নূরুল ইসলাম মিলন  কাজী ফিরোজ রশীদ, আব্দুল মুনিম চৌধুরী। জাতীয় পার্টির  নূরুল ইসলাম ওমর দুটি প্রস্তাব দিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেন।  

পরে এসব প্রস্তাব স্পিকার ভোটে দিলে না নাকচ হয়ে যায়।

এরপর স্পিকার সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় যান। সংশোধনী প্রস্তাব দেন- জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম ও স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী। সেগুলোও কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।

সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির নিয়ম অনুযায়ী, কণ্ঠভোটের পাশাপশি বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন বিল পাস হয়।

প্রথমে স্পিকার বিলের দফাগুলো কণ্ঠভোটে দেন। কণ্ঠভোটে পাস হওয়ার পর সেগুলো বিভক্তি ভোটে দেওয়া হয়। পরে ৫টি লবিতে গিয়ে সংসদ সদস্যরা ভোট দেন। বিলের দফার পক্ষে ভোট পড়ে ২৯৫। বিপক্ষে কোন ভোট পড়েনি।

এর আগে স্পিকার লবি খালি করার নির্দেশ দেন। এসময় দুই মিনিট ঘণ্টা বাজানো। কেউ বাইরে থাকলে তারা যাতে অধিবেশন কক্ষে ঢুকতে পারেন, সেজন্য বেল বাজানো হয়। নিয়মানুযায়ী বেল বন্ধ হওয়ার পর কোনো সংসদ সদস্য সংসদ কক্ষে ঢুকতে পারবেন না।

আইনমন্ত্রী বিলটি পাস করার প্রস্তাব করলে প্রথমে স্পিকার তা কণ্ঠভোটে দেন। সংবিধান সংশোধনের বিল কণ্ঠভোটের দেওয়ার পর বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে পাস করানোর বিধান রয়েছে।

বিলটির পক্ষে ভোট পড়ে ২৯৮টি। বিপক্ষে কোন ভোট পড়েনি।

সরাসরি ভোটের জন্য ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে ১৯৭৩ সালে ১৫টি ছিল সংরক্ষিত নারী আসন। পরে তা বাড়িয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সংসদে ৩০টি করা হয়।

আইনের মেয়াদ না থাকায় চতুর্থ সংসদে ছিল না সংরক্ষিত নারী আসন। একই কারণে অষ্টম সংসদের শুরুতেও ছিলনা নারীদের সংরক্ষিত আসন। তবে ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী এনে আসন বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়।

নবম সংসদেও ছিল ৪৫ আসন। এ সংসদেই ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে আরও ৫ আসন বাড়িয়ে সংরক্ষিত আসন করা হয় ৫০টিতে। তবে ওই সময় মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। সেই হিসেবে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যের মেয়াদ আছে ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত।

ফলে মেয়াদ শেষের আগেই গত ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সংবিধানে সপ্তদশ সংশোধনী আনতে একটি বিল সংসদে তোলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে এটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ৬ জুন সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করা হয়।

বিধান অনুযায়ী ৩৫০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ জন এবং সংসদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে ৫০ জন সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

সংবিধানের ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, “সংবিধান (চতুর্দশ সংশোধন) আইন, ২০০৪ প্রবর্তনকালে বিদ্যমান সংসদের অব্যবহিত পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে শুরু করিয়া দশ বৎসর কাল অতিবাহিত হইবার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভাঙ্গিয়া না যাওয়া পর্যন্ত পঞ্চাশটি আসন কেবল মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে …।”

বাংলাদেশের সংবিধান ২০০৪ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে সংরক্ষিত নারী সদস্যের ৪৫টি আসন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়।

তখন এর মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয় পরবর্তী সংসদের অর্থাৎ, নবম সংসদের প্রথম বৈঠক থেকে দশ বছর।

সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যসহ দশম সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্য ২৭৫, ওয়ার্কার্স পার্টি ৭, জাসদ ৬, তরিকত ফেডারেশন ২, জাতীয় পার্টি ৪০, জেপি ২, বিএনএফ ১ ও স্বতন্ত্র ১৬ জন।

বিল পাসের প্রক্রিয়ায় আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, “৬০ বা ৭০ এর দশকে এই বিধানের যৌক্তিকতা ছিল। তখন নারীরা বঞ্চিত ছিলেন। এখন সেই অবস্থা নেই। এখন প্রয়োজনে নারীদের জন্য আলাদা ১০০টি আসন করে সেখানে সরাসরি নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে।”

তিনি বলেন, “এখন যেভাবে নারীদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তাতে সংবিধানের ২৮(৪) ও ৬৬ (১) দফার লঙ্ঘন হবে। কারণ এখানে সব নারী সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পাবেন না। শুধু দলীয় নারীরা সুযোগ পাবেন। অরাজনৈতিক নারীরা প্রার্থী হতে পারবেন না। এতে সংবিধানের ২৮ (৪) ধারা লঙ্ঘন হবে।”

তার বক্তব্যের বিরোধিতায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “৬৫ ধারার উপধারা তিন অনুযায়ী নারীদের ৩০০ আসনে নির্বাচন করতে কোনো বাধা নেই। সবাই প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবেন। কাউকে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। এই ৫০টি আসন সংরক্ষিত থাকবে।”

জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, নূর ই হাসনা লিলি চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম ওমর সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ ২৫ বছর না করে ১০ বছর করার প্রস্তাব দেন।

সংরক্ষিত আসনের নূর ই হাসনা লিলি চৌধুরী বলেন, “নারীরা যোগ্য হলেও অনেক সময় মনোনয়ন দিতে চায় না দলগুলো। মনে করে নারীদের অর্থ-বিত্ত নেই। টাকার বিনিময়ে রসগোল্লা খেয়ে ভোট দেয়। পরে রসগোল্লার দাম তুলে নেয়।”

সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের উপজেলা-জেলা পরিষদ থেকে কোথাও কোনো দাম নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।