মৌলভীবাজারে খাসিদের ওই গ্রামে তারা মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালেন, পান খাওয়ালেন। ভুবনভোলানো সেই হাসির নিচে তারা কতটা কষ্ট আর যন্ত্রণা চেপে আছেন, তা স্পষ্ট হল ধীরে ধীরে।
Published : 22 Dec 2022, 12:07 AM
ঝিরিপথ ধরে হাঁটার সময় খেয়ালই ছিল না- কখন মোবাইল নেটওয়ার্ক হারিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেকের পথে দু-তিনটা টিলা পেরিয়ে আসতে হল। তারপর উঁচু একটি টিলায় পৌঁছে জানা গেল, এটাই ডলুছড়া খাসিপুঞ্জি, স্থানীয়রা অবশ্য বলেন ‘ডুলুকছড়া’।
পুঞ্জির মাটির ঘরগুলো ছবির মত সুন্দর। ঘরের বারান্দায় থরে থরে সাজানো পান। এই পান তাদের জুমের ফসল। জুম থেকে তুলে এনে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
কয়েকজন এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালেন, পান খাওয়ালেন। ভুবনভোলানো সেই হাসির নিচে তারা কতটা কষ্ট আর যন্ত্রণা চেপে আছেন, তা স্পষ্ট হল ধীরে ধীরে।
পাড়ার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই দেখা হয়ে গেল এ পুঞ্জির সদ্য সাবেক মন্ত্রী লবিং সুমেরর সঙ্গে। পুঞ্জি বা গ্রাম প্রধানকে খাসিরা বলেন ‘মন্ত্রী’।
কথায় কথায় লবিং জানালেন, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নিজের তিন-চার একর জমিতে পান চাষ করছেন। গেল বছর উত্রামের (স্থানীয় ভাষায় ভাইরাসকে তারা উত্রাম বলেন) আক্রমণে বেশির ভাগ পান নষ্ট হয়ে যায়। আর এ বছর সিলেট অঞ্চলের বন্যায় কমে গেছে পানের দাম।
তবে উত্রাম কিংবা বন্যা লবিংদের কাছে ছোট সমস্যা, কারণ তাদের জীবনে আরও বড় সমস্যার কারণ ঘটাচ্ছে রাষ্ট্রের বনবিভাগের মামলা আর প্রভাবশালীদের লোভ।
অগ্রহায়ণের এক সকালে (২৩ নভেম্বর) ঢাকা থেকে একদল নাগরিক প্রতিনিধির সঙ্গে ডলুছড়া পুঞ্জিতে গিয়ে বাসিন্দাদের ছবির মত সুন্দর সেই গ্রাম দেখার সুযোগ হয়। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে মুরাইছড়া টি এস্টেট পর্যন্ত গাড়িতেই যাওয়া যায়, এরপর ঝিরিপথ।
তবে এ রোমাঞ্চকর যাত্রার আনন্দ অনুভূতি উবে গেল লবিংয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায়।
তিনি জানালেন, পুঞ্জিতে অর্ধশত খাসি পরিবারের বসবাস, যারা বংশ পরম্পরায় পানসহ বিভিন্ন বনজ-ফলজ চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। কিন্তু তাদের ভোগদখলে থাকা পানজুমের জায়গাকে ‘ঘটনাস্থল’ হিসেবে দেখিয়ে গাছ-বাঁশ কাটা কিংবা চুরির মত অভিযোগে গত এক যুগে ১৫টি মামলা দিয়েছে বন বিভাগ, আসামি করা হয়েছে পুঞ্জিবাসীদের।
৪০ বছর বয়সী লবিং কোনোরকমে টেনেটুনে ছয় সদস্যের সংসার চালান। স্ত্রীর নাম আশা খংলা। তাদের ঘরে আছে তিন ছেলে ও এক মেয়ে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৩ বছরে পুঞ্জিপ্রধান হিসেবে বন বিভাগের সাতটি মামলার খরচ চালাতে গিয়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
সেসব কথা বলতে বলতে ভারী হয়ে আসছিল লবিংয়ের কণ্ঠ। তিনি জানালেন, একেকটা মামলার নিষ্পত্তি হতে তিন থেকে চার বছর লেগে যায়। এখনও তিনটা মামলা চলছে। মামলা চালাতে গিয়ে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে পাঁচ লাখ টাকার বেশি। তার দুই ছেলে কুলাউড়া সদরে পড়ত। মামলার খরচ টানতে গিয়ে তাদের পড়ালেখাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
“মামলার খরচ, পানের লোকসান- সব মিলায়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। দুই হাজার টাকা করে একেকজনের হোস্টেল খরচ। তেল, সাবান, খাতা-বই, পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়ার খরচ তো আছে। সব মিলিয়ে ছেলেমেয়েদের পিছেই মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছিল। এতো টাকা কোথা থেকে মিলাব? আমরা তো অসহায় হয়ে পড়েছি।”
এখন ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন? প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লবিং বললেন, “আশা তো কতই আছে, কিন্তু দুইজনের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এক ছেলে ব্যাংকার হতে চায়। দেখা যাক- ভবিষ্যতে কী থাকে কপালে!”
লবিংয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় ডলুছড়া পুঞ্জির অনেক বাসিন্দাই সেখানে সমবেত হলেন। তারা জানালেন, মামলার খরচ পুঞ্জিবাসীরা সমবায় পদ্ধতিতে চালান। প্রতিটি পরিবার মামলার খরচ চালাতে সাহায্য করে, তবে এক্ষেত্রে প্রত্যেকের আর্থিক অবস্থা এবং চাষযোগ্য জুমের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে চাঁদা ধরা হয়। যার জুমের পরিমাণ কম, তার কাছ থেকে কম টাকা রাখা হয়। বর্তমানে পুঞ্জির মোট পাঁচজনের নামে মামলা চলছে।
তাদের একজন চোখে আতঙ্ক নিয়ে বললেন, ‘বন বিভাগের কর্মকর্তারা’ সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের নামে আশপাশের প্রভাবশালী বাঙালিদের সহায়তায় খাসিদের পানজুম দখলের চেষ্টা করে। আবার উল্টো খাসিদের বিরুদ্ধে কিছু দিন পরপর মামলা দিয়ে সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। খাসিদের ‘ভোগদখলের জায়গায়’ বনায়ন হলেও তাদের উপকারভোগী করা হচ্ছে না, নাম লেখাচ্ছেন দখলে সহায়তাকারী প্রভাবশালীরাই।
চাঁদার জন্য নিয়মিত হুমকি আসে অভিযোগ করে কয়েকজন বললেন, চাঁদা না দিলেই ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলা দেওয়া হয়।
সেই জমায়েত থেকে ৫৭ বছর বয়সী ক্রুশওয়েল রাংসাই তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তার ঘরে ছয় ছেলে আর তিন মেয়ে। পড়ন্ত বিকেলে তার স্ত্রী ডিউটি সুঙো ও মেয়েরা বারান্দায় বসে পানের বিড়া তৈরি করছিলেন।
বাংলা ভালো বলতে পারেন না ক্রুশওয়েল, ভাঙা ভাঙা শব্দ সাজিয়ে নিজের দুর্দশার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, গত সাত বছরে চারটি মামলার কবলে পড়েছেন, যার মধ্যে এখনও দুটো চলমান। এক মেয়ে সিলেটে একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। আরেক ছেলে সুনামগঞ্জে থেকে দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। বাকিদের পড়াশোনা আপাতত বন্ধ। তারা সবাই মা-বাবাকে পান চাষে সাহায্য করছে।
চার একর জমিতে পান চাষ করেও জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ক্রুশওয়েলের পরিবারকে।
“এখন পানের বাজার খুব খারাপ। কেউ খাসিয়া পান খেতে চায় না, রাজশাহীর পান খায়। খুবই কষ্টে আছি। বাচ্চাগুলার লেখাপড়া করাতেও কষ্ট হয়ে যায়,” বললেন নয় সন্তানের এই বাবা।
জানালেন, একেক মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা গুনতে হয়, কোনো কোনো মাস তিন থেকে চারবারও হাজিরা দিতে যেতে হয়। একেকটা মামলা কম করে হলেও একবছর চলে হয়। এরপর ভালো উকিল ধরে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়।
যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে ক্রুশওয়েল বলেন, “ভাগ্যিস পুঞ্জির সবাই মিলে টাকা উঠিয়ে মামলার খরচ চালাতে পারি, নয়তো এতগুলা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোথায় যেতাম?”
কেন মামলা?
খাসি জনগোষ্ঠীর ভূমি সংক্রান্ত মামলা নিয়ে লড়ছেন বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী সুরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী আবুল হাসান। তিনি জানান, মৌলভীবাজারে ৮০টির মতো খাসিপুঞ্জি আছে, সিলেটে আছে ১০ থেকে ১২টি; আরেকটি পুঞ্জি আছে হবিগঞ্জে। এ তিন জেলার মধ্যে তাদের ভূমির অধিকার নিয়ে সংকট কেবল মৌলভীবাজারেই।
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের নথি বলছে, ১৯২১ সালের ২৪ অক্টোবর তৎকালীন আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার ১২ হাজার ১৯ একর ভূমিকে ‘হারারগঞ্জ রিজার্ভ ফরেস্ট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ১৯২৮ ও ১৯৩৮ সালের দুই গেজেটে তাতে যোগ হয় যথাক্রমে ২৭০ ও ৪৭৯ দশমিক ৮০ একর ভূমি। তবে ত্রিশের দশকে মামলার রায়ে ১৯৮৭ দশমিক ৮৫ একর জমি ফেরে পৃথিমপাশা এস্টেটের অধীনে।
দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন হলে জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়। ওই আইন অনুসারে ১৯৫৬ সালে পৃথিমপাশা জমিদারের সব জমি অধিগ্রহণ করে জেলা প্রশাসন। পরে ১৯৬০ সালে সেসবসহ মোট ৫ হাজার ৩৩৭ একর ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বভার পায় বন বিভাগ।
আইনজীবী আবুল হাসান বলেন, খাসি জনগোষ্ঠী পৃথিমপাশা এস্টেটের কাছ থেকে জোত বন্দোবস্ত নিয়ে ওই জমিতে বসবাস করে আসছিলেন। ষাটের দশকে বৃহত্তর সিলেটে এসএ জরিপ শুরু হলে মাঠ জরিপের সময় বিভিন্ন খাসিপুঞ্জির অধিবাসীরা ভোগদখলকারী হিসেবে নথিভুক্ত হলেও চূড়ান্ত রেকর্ডে সকল ভূমি সরকারের ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত হয়।
“এসএ রেকর্ডকে চ্যালেঞ্জ করা কিংবা তদবির করে নিজেদের নাম রেকর্ড করানোর মতো সচেতনতা না থাকায় খাসিয়ারা সেসব ভূমি নিজেদের নামে রেকর্ড করাতে সক্ষম হননি।”
এসএ রেকর্ডের প্রায় চার দশক পর ১৯৯৯ সালে রোশনাবাদ মৌজার ২৬০ দশমিক ৫০ একর (১০৫ দাগে ১৪৬.৫ একর এবং ১৫২ দাগে ১১৪ একর) ভূমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করে ডলুছড়া পুঞ্জিবাসী। এ মামলায় ২০০৮ সালে নিম্ন আদালতে রায় তাদের বিপক্ষে যায়।
তবে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আপিল মামলার রায়ে ওই জায়গার মালিকানা খাসিদের পক্ষে যায়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের রায় চ্যালেঞ্জ করে রিভিউ আবেদন করে, যা এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
এ পরিস্থিতিতে খাসিরা নামজারি করতে পারেনি জানিয়ে আইনজীবী আবুল হাসান বলেন, “বন বিভাগ ওই জমি দখল করতে স্থানীয় বাঙালিদের উপকারভোগী বানিয়ে দফায় দফায় সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করে, যার কারণে কথিত উপকারভোগী, বন বিভাগসহ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২০১১ ও ২০১৮ সালে নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনা করে আরও দুটি দেওয়ানি মামলা করা হয়। সেসব এখনও বিচারাধীন।
“খাসিয়াদের ভোগদখলীয় জমি নিয়ে মামলা বিচারাধীন থাকার পরও বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন পুঞ্জির খাসিয়াদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা করে। তারা অহরহ মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন, চাঁদা না দিলে মামলা করেন।”
আবুল হাসান বলেন, “২০১১ থেকে এ বছর পর্যন্ত ডলুছড়া ও আশপাশের পুঞ্জির বাসিন্দাদের নামে ১৫টি ফৌজদারি মামলা করেছে বন বিভাগ। যার মধ্যে আটটি মামলা থেকে খাসিয়ারা খালাস পেয়েছেন, সাতটি মামলা এখনও চলমান আছে। এই মামলাগুলোর পেছনে কেবল নভেম্বরেই পুঞ্জিবাসীর এক লাখ টাকার উপরে খরচ হয়েছে।”
কেবল ডলুছড়াই নয়, জেলার বেশির ভাগ খাসিপুঞ্জিই ভূমির অধিকার নিয়ে জটিলতায় আছেন জানিয়ে এ আইনজীবী বলেন, “ষাটের দশকে দুয়েকটি পুঞ্জি এসএ রেকর্ড সংশোধন চেয়ে মামলা করলে সেসবে রায় পায় খাসিয়ারা, যার মধ্যে আছে মেঘাটিলা, রাঙ্গিছড়া পুঞ্জি। সর্বশেষ আরএস রেকর্ডেও এই দুই পুঞ্জিবাসীর নামে রেকর্ড হয়েছে। বাকি পুঞ্জিগুলোর বেশির ভাগ স্বত্ব মামলা দায়ের করার মাধ্যমে ভোগদখলীয় জমিতে টিকে আছে।”
ডলুছড়া ও আশপাশের পুঞ্জি ‘রক্ষিত বনাঞ্চল’ এলাকায় পড়ায় বন কর্মকর্তারা জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা ঠোকেন জানিয়ে হাসান বলেন, “ডলুছড়ার পাশের ইছাছড়া পুঞ্জির ২৮৮ একর জায়গার মালিকানা নিয়ে মামলা চলমান। কিন্তু গত মে মাসে এই পুঞ্জিরই এসএ ১৮১৫ দাগের পানজুমকে ঘটনাস্থল দেখিয়ে ডলুছড়া ও বেলকুমা পুঞ্জির মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়। যেখানে অভিযোগ করা হয়, উল্লিখিত স্থান থেকে খাসিয়ারা চুরির উদ্দেশ্যে ৪৭ ঘনফুট আকাশমনি (সামাজিক বনায়নের) গাছ কেটেছেন। অথচ বর্ণিত স্থান পানজুম, যেখানে পান চাষের জন্য প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া গাছ রয়েছে।”
বন বিভাগ যেসব মামলা করে, সেসবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বনকর্মী ও ‘প্রভাবশালী’ বাঙালিদের সাক্ষী করা হয় বলে এ আইনজীবীর ভাষ্য।
তিনি বলেন, “বন বিভাগ যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে খাসিয়াদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
খাসিদের উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে আদিবাসী অধিকার কর্মী আবুল হাসান বলেন, “বন বিভাগের সাথে ভূমি বিরোধের সূত্র ধরে পুঞ্জিগুলোতে অস্থির অবস্থা চলছে। এটা বাংলাদেশ সরকারের ভূমি বিষয়ক নীতির বিষয়, মৌলভীবাজারের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত খাসিয়াদের ভূমির অধিকার না দিলে তারা উচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে।
“তাতে করে একটা গোটা জাতিসত্তা এবং তাদের জীবন-জীবিকা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে এই বৈচিত্র্য আর থাকবে না। পাশাপাশি মানবাধিকারও লঙ্ঘিত হবে।”
খাসিদের ঐতিহ্যগত চাষাবাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “খাসিয়ারা বংশ পরম্পরায় কোনো রকম সার-কীটনাশক প্রয়োগ না করে ঐতিহ্যগতভাবে জ্ঞান প্রয়োগ করে পান চাষ করেন; যা বিশেষ কৃষি ঐতিহ্যের দাবিদার, যার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য।
“এমনকি এই সকল পুঞ্জিতে পান চাষ ও বিপণন প্রক্রিয়াতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা বিপন্ন হলে স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
বন বিভাগ কী বলে?
বন বিভাগের তরফে চলমান মামলাগুলোর বাদী হিসেবে আছেন মুরাইছড়া বিট অফিসার অর্জুন কান্তি দস্তিদার।
খাসিপুঞ্জি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই জায়গাগুলো সরকারের গেজেট ও খতিয়ানভুক্ত জায়গা। ওরা এখানে জবরদখল করে থাকে এবং বিভিন্ন সময় স্বত্ব মামলা দায়ের করে।
“কিন্তু মামলা করলেই তো আর হয়ে গেল না। তারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কাগজ তৈরি করে নানা বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো সরকারের জমি, ডিসি খতিয়ানের জায়গা; যেটা বন বিভাগ তত্ত্বাবধান করে। এই জায়গা এবং এখানকার গাছপালার দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমাদের।”
‘হয়রানিমূলক’ মামলার যে অভিযোগ করছে খাসিরা, সে বিষয়ে বন কর্মকর্তা অর্জুন বলেন, “তারা পাবলিক ল্যান্ড থেকে আকাশমনি গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছিল। তাই মামলা করেছি। এগুলো জুমের আওতাধীন না।
“তারা তাদের জায়গা রেকর্ডভুক্ত করার জন্য মামলা করবে, আমরা কোর্টে আপিল করব। তারা বংশ পরম্পরায় এই জায়গায় আছে ঠিকই, কিন্তু সরকার এই জায়গা তো বন বিভাগের দায়িত্বে রেখেছে, এইগুলো সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তো আমরা নেবই।”
২০১০ সালে ডলুছড়ার পাশের বেলকুমা পুঞ্জির ভোগ দখলে থাকা ভূমিতে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বন বিভাগ, যেখানে উপকারভোগীর তালিকায় আছেন ৪/৫ কিলোমিটার থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের বাঙালিরা।
অথচ সামাজিক বনায়ন বিধিমালায় বলা আছে, প্রকল্পের এক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী স্থানীয় অধিবাসীরা উপকারভোগী নির্বাচিত হবেন; এক কিলোমিটারের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক উপকারভোগী পাওয়া না গেলে নিকট এলাকার অধিবাসীদের নির্বাচন করা যাবে।
উপকারভোগীর তালিকায় প্রকল্পের আশপাশের খাসি জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব কেন দেওয়া হয়নি, এ প্রশ্নের উত্তরে বিট অফিসার অর্জুন কান্তি দস্তিদার বলেন, “খাসিয়াদের আমরা সবসময়ই বলে এসেছি- তারা যেন সামাজিক বনায়নের আওতায় এসে বনাঞ্চলের কোনোরূপ ক্ষতি না করে পানের চাষ করে। আমরা বলেছি, তোমরাও সামাজিক বনায়নের অন্তর্ভুক্ত হও, এখানে ফসল ফলিয়ে খাও, কিন্তু গাছ কাটতে পারবা না।
“কিন্তু তারা সামাজিক বনায়নের ভেতর আসতে রাজি না। কে বা কারা তাদের বোঝায় যে, ব্ন বিভাগের সাথে মিলে সামাজিক বনায়ন করলে তাদের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা বিভিন্নভাবে খাসিয়াদের মাথায় ঢোকানো হয়েছে। আমরা তাদেরকে নিয়েই সামাজিক বনায়নের কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
কর্মধা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ অবশ্য বললেন, খাসিদের অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সামাজিক বনায়নের নিয়ম অনেকাংশেই ভাঙা হয়েছে, বিশেষ করে উপকারভোগীর যে তালিকা রয়েছে- সেখানে আসলেই নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের নাম রয়েছে- এটি অসত্য নয়।
“আমি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া পর বাঙালি আর খাসিয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ঘটনা খুব কমই হয়েছে। আমি সবসময় এ অঞ্চলের পানজুমের সাথে জড়িত খাসিরা যেন অন্যায়ভাবে কোনো হয়রানির শিকার না হতে হয়, সেটাই চেয়েছি।”
এসব বিষয়ে জানতে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান খন্দকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, খাসিদের মামলা ও উপকারভোগীর তালিকার বিষয়ে তার কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়নি।
“খাসি জনগোষ্ঠীর যদি এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকে, তাহলে আমার কাছে লিখিতভাবে দিলে সেটা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে দেখা হবে। তারপরেই পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। সেখানকার রেঞ্জ কর্মকর্তার সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাবে।
“কেউ যদি অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, কিংবা আইন বহির্ভূতভাবে কোনো হয়রানিমূলক মামলা হয়, তবে সেটা আদালত দেখবে। যেসব বিষয় আমরা উপজেলা পর্যায় থেকে সমাধান করতে পারি, সেই বিষয়গুলো আমাদের কাছে অভিযোগ করার জন্য অনুরোধ থাকবে। তদন্ত এবং যাচাই-বাছাই করেই আমরা ব্যবস্থা নেব।”
খাসি পুঞ্জি পর্যবেক্ষণে ঢাকা থেকে যাওয়া নাগরিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন কাপেং ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক হিরামন হেলেনা তালাং, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, কবি ও মানবাধিকারকর্মী শাহেদ কায়েস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ভূমি ও আইনবিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ এবং সাংবাদিক বহ্নি ফারহানা।
এই দলে মৌলভীবাজার থেকে যোগ দেন বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান, বৃহত্তর সিলেট ত্রিপুরা উন্নয়ন পরিষদ সভাপতি জনক দেববর্মা, বাপার কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক ও কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং, দৈনিক ভোরের কাগজের কুলাউড়া প্রতিনিধি আব্দুল কুদ্দুস ও খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি জনি লাংবাং।
কাপেং ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক হিরামন হেলেনা তালাং বলেন, “২০১০-১১ অর্থবছরে ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস শহীদ বাবুলের হাত ধরে প্রথমবার ২৫ হেক্টর জায়গায় সামাজিক বনায়ন শুরু হয়। তখন কিছু গাছ লাগানো হয়েছিল। পরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সামাজিক বনায়নের নামে খাসিদের ১২টি পানজুম দখল করে তথাকথিত ওই উপকারভোগীরা।
“দুস্থদের উপকারের জন্য নেওয়া এই প্রকল্পের উপকারভোগীদের মধ্যে বহুতল ভবনের মালিক ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও আছেন। নতুন বন সৃজনের চেয়ে পানজুম করা লাভজনক বলে তারা বনায়নের বদলে পানচাষ শুরু করে। গত বছরের অগাস্টে নতুন করে বাঙালি উপকারভোগীরা আরও জায়গা দখল করতে গেলে প্রতিরোধ করে খাসিরা। তখন থেকে এসব পানজুমে যেতে পারছে না উপকারভোগীরা। এসব কারণে তারা আদিবাসীদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা, রাতের অন্ধকারে জুমের পানগাছ কেটে দেওয়াসহ বিভিন্ন সময়ে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে।”
ডলুছড়া খাসিপুঞ্জি ঘুরে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দলটি সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পরদিন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যায়। জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান তাদের বলেন, “জেলা প্রশাসক কোনো নির্দিষ্ট পক্ষের জন্য কাজ করে না, তাকে সবদিকই দেখতে হয়। যতটুকু মূল্যায়ন করতে হয় বন বিভাগকে, ততটুকু মূল্যায়ন করতে হয় খাসি জনগোষ্ঠীকে, আবার ততটুকুই মূল্যায়ন করতে হয় চা বাগানকে।”
খাসিপুঞ্জি প্রশ্নে শিগগিরই বন বিভাগের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেবেন জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, “বিভিন্ন সময়ে এসব জায়গাকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, বিষয়গুলো আমাদের আমলে আছে। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা আছেন, তাদেরকে দুর্বল হিসেবে বিবেচনা করে আঘাত করার এক ধরনের প্রবণতা থাকেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা সর্বোচ্চভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি।
“আমরা বেশ কয়েকবার ওই পুঞ্জিগুলোতে গিয়েছি, তাদের সাথে কথা বলেছি। তাদের জমির ভেতর বাঙালিরাও পান চাষ করে- এমন অভিযোগও আমরা পেয়েছি। এ রকম অনেকগুলো বিষয়ই এটার সাথে যুক্ত আছে। আমরা শিগগিরই বন বিভাগের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসব।”
[প্রতিবেদনটি সম্পাদনা ও পুনর্লিখন করেছেন রোকন রাকিব]