বিবিসি বাজার গড়ে উঠল যেভাবে

৮১ বছর ধরে বিবিসি বাংলা রেডিওর সঙ্গে অগণিত শ্রোতার জীবন জড়িয়ে গেছে।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2022, 04:49 PM
Updated : 1 Oct 2022, 04:49 PM

খুব ছোটবেলায় বিবিসির সঙ্গে পরিচয় পাবনার ঈশ্বরদীর শিক্ষিকা নাজনীন সুলতানা লুনার। তবে আর দশজনের মত সেটা তার কাছে সংবাদমাধ্যম নয়, ছিল বাড়ির কাছের একটি বাজার। বড় হয়ে বাবার কাছে জেনেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর শোনা থেকেই জন্ম এ ঐতিহাসিক বাজারের।

সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এ শিক্ষিকার মুক্তিযোদ্ধা বাবা আব্দুল খালেকের কাছে বাজারটি নিয়ে জানতে চাইতেই বলে উঠলেন, একাত্তরে ঈশ্বরদীর স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে যুদ্ধের আর দেশের খবর পৌঁছে দেওয়ার আশ্রয় হয়ে ওঠেন কাশেম মোল্লা নামে স্থানীয় এক চা দোকানি। তার দোকানে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় লোকজন বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান শুনতে যেত। এয়ার ইন্ডিয়াও শোনা হত।

“কিন্তু সবাইকে বিবিসি বাংলাই বেশি টানত।সেই থেকে সবার মুখে ছড়িয়ে পড়ে কাশেমের দোকানের নাম। তবে কাশেমের দোকান কেউ বলত না। সবাই বলত বিবিসি শুনতে যাই। এভাবে কাশেমের দোকান আর আশপাশের দোকান নিয়ে ওই এলাকা বিবিসি বাজার হিসেবে রটে যায়।”

মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সেই সময় থেকেই পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরের এ বাজারের নামই হয়ে যায় বিবিসি বাজার; যা এখন রূপ নিয়েছে পৌনে কিলোমিটার আয়তনের এক বড় কেনাবেচার স্থানে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অদূরেই যার অবস্থান। 

৮১ বছর ধরে চলা বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের ঘোষণার পর অগণিত শ্রোতার জীবনের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমটির জড়িয়ে থাকার নানা কথা উঠে আসছে সোশাল মিডিয়ায়।

সেসব গল্পে সংবাদমাধ্যমটির ওপর মানুষের ভরসার কথা যেমন উঠে আসছে, তেমনই তাদের সংবাদের প্রভাবের কথাও বলেছেন কেউ কেউ; অনেকেই সংবাদ মাধ্যমটির নামে বাজার গড়ে ওঠাকে দৃষ্টান্ত বলছেন।

সেই বিবিসি বাংলা রেডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘোষণায় আবারও আলোচনায় এসেছে সংবাদ মাধ্যমটি।

শুধু যে বাংলা সার্ভিস বন্ধ হচ্ছে তা নয়; আরবি, ফার্সি, চীনা, কিরগিজ, উজবেক, হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান, তামিল ও উর্দু ভাষার রেডিও সম্প্রচারও আর শোনা যাবে না বিবিসিতে। 

কোনো ভাষা বিভাগই অবশ্য পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না। অনলাইন সংবাদমাধ্যম হিসেবে অনেকগুলো ভাষার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসি।   

১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরুর মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছিল বিবিসি বাংলার রেডিও কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে সংবাদ সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। 

পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আর গণআন্দোলনের খবর জানতে সেই সময় থেকেই বিবিসি বাংলার প্রতি নির্ভরতা গড়ে ওঠে সাধারণের, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও বেড়ে যায়। তারই এক প্রমাণ বিবিসি বাজার।

এ বাজারের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে ঈশ্বরদীর বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার আবু দাউদ জানালেন, একাত্তরে পাবনার পাকশী পেপার মিলস, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় পাকবাহিনী ক্যাম্প বসালে সাধারণের মানুষের বাজার করা কঠিন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়ে মানুষ সেখানে যেতে পারত না।

“ওই সময় সেখানে কাশেম মোল্লার মুদি দোকান ছিল। পাকবাহিনীর দেওয়া আগুনে সেই দোকান পুড়ে গেলে তিনি পাকশী ছেড়ে রূপপুর এলাকায় চলে আসেন। তুলনামূলক উঁচু একটি জায়গায় রাস্তার ধারে একটি চা দোকান দেন তিনি।

“কাশেম মোল্লার একটা থ্রি ব্যান্ডের রেডিও ছিল। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তখন ভারতে ট্রেনিং নিচ্ছি, সুযোগ বুঝে দেশে ঢুকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অপারেশন চালাচ্ছি। সারাদেশেই তখন এমন সফল অপারেশনগুলো হতে শুরু করেছে। কিন্তু রেডিও পাকিস্তানে এসব খবর পড়া হত না। ফলে আমাদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ মানুষের কাছে ভরসার নাম হয়ে ওঠে কাশেম মোল্লার ওই ফিলিপস ব্র্যান্ডের থ্রি ব্যান্ডের রেডিও।“

মুক্তিযোদ্ধা দাউদ বলতে থাকেন, “বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, এয়ার ইন্ডিয়া এসব শুনতে আমরা সন্ধ্যার পরই দলবেঁধে যেতাম। কখনও মিলিটারি আসার খবর পেলে নিজেরা সতর্ক থাকতাম, উনাকেও সতর্ক করে দিতাম।

Also Read: বিবিসি বাংলা রেডিও: একটি অধ্যায়ের বিদায় ঘণ্টা

“এভাবে ধীরে ধীরে কাশেম মোল্লার দোকানের পাশে আরও দোকান বাড়তে থাকে। মানুষ আসার সময় বলত, বিবিসি শুনতে যাই, বিবিসির বাজারে যাই। এভাবে বলতে বলতে একটা সময় এই বাজারের নামই হয়ে যায় বিবিসি বাজার।”

বছর ছয়েক আগে বিবিসির এক প্রতিবেদনে সেই চা দোকানি কাশেম মোল্লার ভাই আবুল কালাম আজাদ স্মৃতিচারণে বলেন, “পাক আর্মিরা যখন নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, জ্বালাও-পোড়াও করছে এরকম একটা সময় শোনা গেল যে আমাদের মুক্তিফৌজ ইতিমধ্যেই তারা প্রতিরোধ অবস্থা সৃষ্টি করেছে।… বিবিসি অনুষ্ঠান সকাল এবং সন্ধ্যা- এই সংবাদগুলো দিত। তখন এই খবর শুনতে অনেকেই কিন্তু তার (কাশেম মোল্লা) বাড়ি যেত। তার বাড়িতে টুল দেওয়ার মত অবস্থা ছিল না, শত শত মানুষ তার বাড়ি যেত।”

এরকম একটা পরিস্থিতিতে কাশেম মোল্লা একটা দোচালা ঘর নিয়ে কড়ই গাছের পাশে চা দোকান দেন বলে জানান তিনি।

ওই প্রতিবেদনে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম বলেন, “কাশেম আলীর রেডিওটা শুনতে তখন বহু লোক এখানে আসত- মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে, মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতে। এবং সেই থেকে মানুষজনের প্রচারণা ছিল- চল যাই বিবিসি যাই। অর্থ্যাৎ কাশেম আলীর দোকানে এক কাপ চা খাব এবং বিবিসিতে মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনব।”

তথ্য প্রচারে ভাইয়ের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, “একদিন বিকেলবেলা পাক হানাদার বাহিনী যখন আসে, আসার পর দোকানে ঢুকছে…তার আগেই বড় ভাই দেখছে যে এই রেডিও যদি পাক আর্মিদের হাতে চলে যায়, তাহলে আমরা এই খবরগুলো এই অঞ্চলের মানুষকে শোনাতে পারব না।

“এই রেডিওটাকে রক্ষা করার জন্য গোপনে সেই বাজারের পূর্ব পাশে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দেয়।…আমরা একাত্তর সনে কষ্ট নিয়ে যুদ্ধ করেছি, এটা ঠিক। কিন্তু কাশেম মোল্লা বিবিসির সংবাদের মাধ্যমে নানা রকম তথ্য দিয়ে উনি যুদ্ধ করেছেন।”

বিবিসি বাজার এখন যেমন

সেদিনের সামান্য কিছু দোকান থেকে এখনকার বিবিসি বাজার প্রায় পৌনে কিলোমিটার বিস্তৃত। দোকানপাট বেড়েছে, বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যও। পুরো বিবিসি বাজারের এখন প্রায় দেড়শ দোকানে ব্যবসা হয়।

বাজারের বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা রেজাউল করিম রাজা বললেন, “আমাদের বাজার এখন বেশ বড়। এখানে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যেই সব চলছে। পাশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, ফলে বাজারের গুরুত্বও বেড়েছে।“

কাশেম মোল্লার রেডিওটি মুক্তিযুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল জানিয়ে তিনি বললেন, “মুরুব্বিরা সংবাদ শুনতে গেলে বলতেন, চলো বিবিসি শুনে আসি। ফলে এই বাজারের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। কিন্তু আমাদের বারবার দাবির পরও এখানে কোনো স্মৃতিফলক বা কিছু নির্মিত হয়নি।”

কাশেম মোল্লার খোঁজ রাখেনি কেউ

স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর পেতে যার রেডিওতে রূপপুরের মানুষ কান পেতেছিলেন, সেই কাশেম মোল্লা নানা জটিল রোগে ভুগে ৭৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালে মারা যান। তার দোকানটিও এখন আর নেই।

ছেলে জাহিদুল ইসলাম বিবিসি বাজারেই একটি দোকান শুরু করলেও পরে সেটি বন্ধ করে দেন।

তিনি বলেন, “বাবার পায়ে সমস্যা থাকায় তেমন কর্ম করতে পারতেন না। বোনেদের বিয়ের সময় এলে আমাদের দোকানটি বিক্রি করে দিতে হয়। এখন আমি একটি কলেজে অফিস সহকারীর কাজ করে কোনোরকমে চালিয়ে নিচ্ছি।”

বাবার সেই রেডিও সংরক্ষণের প্রশ্নে তিনি বললেন, “রেডিওটি নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন শুধু বিবিসি ওয়ার্ল্ড চাইলেই আমি দেব, অন্য কোথাও দেব না।”

সাপ্তাহিক ঈশ্বরদীর সম্পাদক ও সমকালের ঈশ্বরদী প্রতিনিধি সেলিম সর্দার জানালেন, কাশেম মোল্লার রেডিওতেই মানুষ যুদ্ধের খবর শুনত। সে কারণে তাকে বিভিন্ন সময় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নিগৃহের মুখে পড়তে হয়েছে।

“১৯৯২ সালে বিবিসির ৫০ বছর পূর্তিতে বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন প্রধান ভ্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা বিভাগের তৎকালীন উপ প্রধান সিরাজুর রহমান, ভাষ্যকার দীপঙ্কর ঘোষ ও বিবিসির সাবেক বাংলাদেশ সংবাদদাতা আতাউস সামাদ বাংলাদেশে এসেছিলেন কাশেম মোল্লার সাথে দেখা করতে। সেবার তাকে একটি সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছিল।”

তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি বলে জানান তিনি।