বাসে ই-টিকেট: ভাড়া নিয়ে ‘ক্যাচাল’ নেই, হুড়োহুড়ি আগের মতই

যাত্রীদের অভিযোগ, নতুন পদ্ধতিতে ‘আয় কমায়’ মালিকরা বাস কমিয়ে দিয়েছেন।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Oct 2022, 06:48 AM
Updated : 16 Oct 2022, 06:48 AM

রাজধানীতে কিছু রুটের বাসে পরীক্ষামূলকভাবে ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পর ভাড়া নিয়ে বচসা দেখা না গেলেও টিকেট সংগ্রহ ও বাসে ওঠানামায় হুড়োহুড়ি রয়ে গেছে আগের মতই।

যাত্রীদের ভাষ্য, বাস না আসা পর্যন্ত টিকেট যেমন দেওয়া হচ্ছে না, তেমনই টিকেট বিক্রির নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় তা সংগ্রহ করতে হচ্ছে সড়কের ওপরই। তাতে বাসে উঠতে হুড়োহুড়ির ঘটনা ঘটছে।

যাত্রী তোলা হচ্ছে নির্দিষ্ট স্টপজের বাইরেও। কর্মীরা ভাড়া ওঠালেও তা যাচ্ছে না মালিকের পকেটে। এ সমস্যার কথা উঠে এল ট্রান্স সিলভা পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম খোকনের কথায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কেবল নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী ওঠানামার বিষয়ে সহযোগিতা করছে না শ্রমিকরা। আবার আমাদের যাত্রীদেরও যেখানে সেখানে ওঠানামার অভ্যাস আছে।

“এর ফলে নির্দিষ্ট স্টপজের বাইরে যেসব জায়গায় যাত্রী উঠছে, সেসব যাত্রীর টাকা শ্রমিকরা ওঠালেও আমরা পাচ্ছি না।”

তবে আগের মতো ভাড়া নিয়ে বচসা না হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যাত্রী ও শ্রমিক দুই পক্ষই।

শনিবার মিরপুর ২ ও ১০ নম্বর এলাকা ঘুরে দেখা গেল, সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়া অনুযায়ী ই-টিকেটে দেওয়া হচ্ছে যাত্রীদের। ভাড়া নিয়ে কোনো সমস্যাও চোখে পড়েনি।

মিরপুর ২ থেকে প্রজাপতি পরিবহনে উত্তরা যাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কামরুজ্জামান। ই-টিকেট পদ্ধতি চালু হওয়ার পর কী পরিবর্তন দেখছেন জানতে চাইলে বললেন, “যাত্রীদের সুবিধা হয়েছে। আগে ১৬ টাকার ভাড়া ২০ টাকা, ৩৫ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা দিতে হত।

“এখন যা ভাড়া তা দিয়েই টিকিট নিতে হচ্ছে। তবে টিকিট নিতে গিয়ে রাস্তার উপরই হই-হুল্লোড় করতে হচ্ছে।“

মিরপুর ১০ থেকে রাজধানী পরিবহনে বাড্ডা যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী শফিকুল্লাহ। তিনি বললেন, “এই ব্যবস্থা হওয়ার পর ভালো হয়েছে। আগে ভাড়া নিয়ে অনেক সমস্যা ছিল। একেক দিন একেক ভাড়া চাইত। এখন একটি নির্দিষ্ট ভাড়া নিচ্ছে। গাড়ির ভেতর ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ্বও কমেছে। রাস্তা থেকে লোক কম উঠছে।“

ভাড়া নিয়ে আর তেমন ঝগড়া-বিবাদ হচ্ছে না বলে জানালেন পরিবহনকর্মীরাও। রাজধানী পরিবহনের চালক নুরুজ্জামান বললেন, “ভাড়া নিয়া আগের ক্যাচাল এখন আর নাই। আরামে গাড়ি চালানো যায়।”

আর অছিম পরিবহনের টিকেট বিক্রেতা সাগর মিয়ার কথায়, “এখন জেনুইন ভাড়ায় আসছে, ওয়েবিলও নাই। যাত্রীরা নিজে মেশিনে দেখে ভাড়া দেয়, তাই ভেজাল হয় না।“

তবে টিকেট বেচার কোনো নির্দিষ্ট স্থান কোথাও চোখে পড়েনি। টিকেট বিক্রি হচ্ছিল সড়কের ওপর, যা নিয়ে অসন্তোষ জানালেন যাত্রী ও টিকেট বিক্রেতা উভয়ই। আবার লাইন ধরে টিকেট বিক্রি না করে কেবল বাস এলে টিকেট দেওয়া হচ্ছিল। ফলে যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি হচ্ছিল বেশ।

মিরপুর-২ স্টপেজ থেকে রাজধানী পরিবহনের বাসের টিকেট পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার। তিনি বললেন, “কাউন্টার নির্দিষ্ট করতে হবে। এভাবে এলোমেলো করে টিকেট দিলে হবে না। কোন বাসের টিকেট কে দিচ্ছে, কোন জায়গা থেকে দিচ্ছে তা বাসের গায়ে বা জানালায় লিখে দিতে হবে।

“হুট করে গাড়ি আসে, তখন টিকিট দেয়। সবাই হুড়োহুড়ি করে, কখন কার গায়ে গাড়ি ওঠে, বলা যায় না।“

মিরপুর-১০ স্টপেজে উত্তরা যেতে পরিস্থান পরিবহনের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষক মো. সাইদুল ইসলাম অভিযোগ করে বললেন, “অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম টিকেট দিচ্ছিল না। বললো, বাস এলে দেবে। এখন বাস আসার পর দিচ্ছে, কিন্তু অনেক ভিড় আর ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে।“

টিকেট বিক্রেতাদের কেউ কেউ যাত্রী ডাকছিলেন হ্যান্ড মাইকে। যাত্রী বেড়ে গেলে বা অনেক বাস একসঙ্গে এলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছিল।

মিরপুর-২ স্টপেজে অছিম পরিবহনের বাসের টিকেট বিক্রেতা এস কে দিপু বললেন, “বাস কোনটা কখন আসবে, আমরা আগে বলতে পারি না। তাই বাস না আসার আগে টিকেট দিই না। কোম্পানিগুলোকে টিকেট বিক্রির জন্য আলাদা আলাদা জায়গা করে দিলে যাত্রী ও আমাদের সুবিধা হত।”

পরিস্থান বাসের টিকেট চেকার আব্দুল কাইয়ূম বলেন, “আমাদের তো নির্দিষ্ট জায়গা নাই দাঁড়ানোর। রাস্তার উপর দাঁড়ানো লাগে। এখান থেকেই যাত্রীদের টিকেট দিতে হয়। কখন কোন বাস উপরে উঠে যায়, ঠিক নাই। নির্দিষ্ট জায়গা বা লাইন করে দিলে সবার সুবিধা হবে।“

এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনে দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের হেঁটে হেঁটে টিকেট দিতে হচ্ছে। কোনো বসার জায়গা নেই।“

বাসমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি পরীক্ষামূলকভাবে ই-টিকেটিং চালু করে। প্রথমে এ পদ্ধতি চালু হয় মিরপুর ১২ থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চলাচলকারী ট্রান্স সিলভা পরিবহনে।

এরপর মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ঢাকেশ্বরীগামী ‘মিরপুর সুপার লিংক’, ঘাটারচর থেকে উত্তরাগামী ‘প্রজাপতি’ ও ‘পরিস্থান’; গাবতলী থেকে গাজীপুরগামী ‘বসুমতি’ পরিবহনের বাসে এ পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় শুরু করে। পরে যুক্ত হয় গাবতলী থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচল করা ‘অছিম’ ও ‘রাজধানী’ পরিবহন।

কিন্তু ২০ দিন চালানোর পর ই-টিকেটিং থেকে সরে আসে ট্রান্স সিলভা পরিবহন। কারণ হিসেবে কোম্পানির চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেশকিছু অবকাঠামোগত অব্যবস্থাপনা ও অসঙ্গতির জন্য আমরা সরে এসেছি।

“আমাদের পরিবহন নেতাদের সাথে আলাপ হয়েছে। একই রুটের সব কোম্পানি ই-টিকেটে এলে আমরাও চালাব।“

বাস সংখ্যা কমানোর অভিযোগ

ছুটির দিন শনিবার ভরদুপুরেও মিরপুরের বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীদের বাসের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর যে বাসগুলো আসছিল, সেখানেও যাত্রীদের ভিড় চোখে পড়ে।

কামরুজ্জামান নামের এক যাত্রী বললেন, “ই-টিকেট হওয়ার পর ভাড়া কমায় বাসওয়ালাদের লাভ কমে গেছে। ফলে গাড়ি পাওয়া যায় না। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় গাড়ি নেই।

“অফিস টাইমে আরও সমস্যা হয়। গাড়ি কমে গেছে। ১০-১৫ মিনিট পর যাও গাড়ি আসে, সেগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থাকে।“

মোস্তফা কামাল নামে উত্তরাগামী আরেক বেসরকারি চাকরিজীবীর ভাষ্য, ভাড়া কমার সাথে গাড়িও কমেছে। এতে অসুবিধা বেড়েছে।

নতুন এই ব্যবস্থায় আগের চেয়ে ‘আয় কমার’ কথা বললেন রাজধানী পরিবহনের চালক নুরুজ্জামান। 

তার দাবি, “এখন ইনকাম কমে গেছে। আগে মালিকের সব খরচ দিয়া দিনে ৩ হাজার থাকত। এখন ৮০০-১০০০ থাকে।“

সে কারণে বাস কম নামছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এইটা বলতে পারব না।“

বাস মালিকেরা নতুন এই ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দাবি করে প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রফিকুল ইসলাম বললেন, “আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে যথাযথ সাড়া পাচ্ছি না। তারা এক জায়গার টিকেট কেটে বেশি দূরত্বে যাচ্ছেন।

“আবার আমাদের চালক-স্টাফরাও মালিকদের কো-অপারেট করছে না। ফলে কিছু বাস কমছে। তবে এই সংখ্যা খুবই অল্প।“

আর পরিস্থান পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াজউদ্দিন বললেন, “ই-টিকেটে ভাড়া কমেছে, সিটিং সিস্টেম আর নেই। ফলে এক বাসে এখন ৮০-৮৫ জন যাত্রী উঠছে।

“প্রায় প্রতিদিন গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। বাস মালিকেরা তো খুব ধনী না। ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাস নামানো কঠিন তাদের জন্য।“

হাল ছাড়ছে না মালিক সমিতি

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে কোনো কিছুই অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে আসাটা ইতিবাচক। ই-টিকেটকেও আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি।

“যে কোনো ব্যবস্থাতেই মালিকপক্ষ তাদের লাভের দিকটি বেশি চিন্তা করেন। এই চিন্তা কমিয়ে সেবাকেন্দ্রিক চিন্তা করলে এ ব্যবস্থাও কার্যকর করা সম্ভব হবে।”

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘সেভ দ্য রোডের’ প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদী বলেন, “বাংলাদেশের ই-টিকেটিং পদ্ধতি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। এ কারণে এটি যাত্রীবিরোধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

“নানা অসঙ্গতির কারণে রাজধানীর ৬০% যাত্রী ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সরকারিভাবে বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।“

তবে এ ব্যবস্থা নিয়ে আশাবাদী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তার ভাষায়, সমস্যা কিছু থাকলেও তার সমাধান সম্ভব। সেজন্য বাস মালিকদের সঙ্গে বসবেন তারা।

“কোন কোন জায়গায় সমস্যা থেকে যাচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে এই ব্যবস্থা সব জায়গায় চালু করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।“

Also Read: ই-টিকেটেও অতিরিক্ত ভাড়া, ইচ্ছেমত যাত্রী তোলার অভিযোগ

Also Read: রাজধানীতে বাস ভাড়ায় পরীক্ষামূলক ই-টিকেট চালু

Also Read: ঢাকার গণপরিবহনে আসছে ই-টিকেটিং: এনায়েতুল্লাহ