ই-টিকেটেও অতিরিক্ত ভাড়া, ইচ্ছেমত যাত্রী তোলার অভিযোগ

“আমরা এ বিষয়ে কী করা যায় ভাবছি,” অতিরিক্ত রাস্তার টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বেশি ভাড়া নেওয়া প্রসঙ্গে পরিবহন মালিক নেতা খন্দকার এনায়েতুল্লাহ।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2022, 03:45 PM
Updated : 1 Oct 2022, 03:45 PM

 প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসে মিরপুর ১ নম্বর থেকে আসাদ গেইট পর্যন্ত টিকেট কাটতে চেয়েছিলেন মেহেদি হাসান। তবে তাকে অনেকটা জোর করে ঘাটারচর পর্যন্ত টিকেট দিয়ে ২১ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়।

পরে তিনি মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে নামেন। শনিবার দুপুরে ওই বাস থেকে নামার পর ই-টিকেটিংয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, “আমাকে আসাদগেট পর্যন্ত টিকেট দিলে আমার ১৩ টাকা ভাড়া দিতে হত। অথচ ঘাটারচর পর্যন্ত টিকেট দিয়ে অতিরিক্ত ৮ টাকা আদায় করা হয়েছে।“

তার মতে, রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়াসহ যাত্রী সেবার নৈরাজ্যে নতুন এ পদ্ধতি অনেক ভালো হতে পারে যদি সরকার বা মালিকপক্ষ থেকে যথাযথ তদারকি করা হয়।

“এ ব্যবস্থায় গাড়ির মালিকরাও অনেক লাভবান হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

ঢাকার বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে পরীক্ষামূলকভাবে চালু ই-টিকেটিং পদ্ধতি কেমন চলছে সেই বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে এভাবে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ মেলে।

শুধু বাড়তি ভাড়া নয়, আগের মত স্টপেজ ছাড়া ইচ্ছেমত যাত্রী তোলা এবং টিকেট ছাড়া ভাড়া আদায় করতেও গেছে বাসকর্মীদের।

শনিবার দুপুরে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, গাদাগাদি করে অনেক দাঁড়ানো যাত্রী নিয়ে একেকটি বাস এসে থামছে। ভিড় ঠেলে একেকজন যাত্রী নামছেন আর নিচে দাঁড়িয়ে বাসের হেলপার টিকেট ছাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ ভাড়া আদায় করছেন।

যাত্রীদের অভিযোগ, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া যাত্রী না নেওয়ার কথা বলা হলেও বাসগুলো ই-টিকেট ছাড়াই যেখান সেখান থেকে যাত্রী তুলে একদিকে নিয়ম ভাঙছে আবার নানা কৌশলে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে।

এছাড়া কোনো কোনো রুটে বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলার গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেছেন কেউ কেউ।

শনিবার রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও আসাদগেটসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বাসস্ট্যান্ড ঘুরে ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

যাত্রীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাস মালিক ও মালিক সমিতির নেতারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে যাত্রীদের সচেতন থাকার পরামর্শ দেন। নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া অন্য জায়গা থেকে যাত্রী তোলার বিষয়ে সহযোগিতাও চান তারা।

যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাস্তার টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তারাও পেয়েছেন জানিয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, “আমরা এ বিষয়ে কী করা যায় ভাবছি।“

সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় ঠেকাতে ই-টিকেটিং একটি কার্যকর পদ্ধতি জানিয়ে তিনি এ বিষয়ে যাত্রীদের সতর্ক হয়ে নির্ধারিত গন্তব্যের টিকেট দেখে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পরীক্ষামূলকভাবে এখন পর্যন্ত সাতটি পরিবহনে ই-টিকেটিং চালু করেছি। পর্যায়ক্রমে রাজধানীর সকল বাসকে ই-টিকেটের আওতায় এনে গণপরিবহণের নৈরাজ্য থেকে মুক্তি দিতে বাস মালিকরা একমত।“

গত ২৩ সেপ্টেম্বর মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ঢাকেশ্বরীগামী মিরপুর সুপার লিংক; ঘাটারচর থেকে উত্তরাগামী প্রজাপতি ও পরিস্থান এবং গাবতলী থেকে গাজীপুরগামী বসুমতি পরিবহনসহ সাতটি পরিবহনের বাসে এ পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় শুরু হয়।

এ ব্যবস্থা চালুর প্রথম কয়েকদিন বাড়তি ভাড়া দিতে না হওয়ায় যাত্রীরা এর প্রশংসা করলেও এখন পরিবহনকর্মীদের নানা কৌশলের কারণে ভালো এ উদ্যোগে ‘ভেজাল’ দেখতে শুরু করেছেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উত্তরা থেকে ছেড়ে আসা পরিস্থান পরিবহনের যাত্রী রায়হান সিদ্দিক নামেন মিরপুরের পূরবী সিনেমা হল স্ট্যান্ডে। তিনি প্রথমবারের মতো ই-টিকেট কেটে এ বাসে চড়ে ভ্রমণ করেন।

নতুন এ পদ্ধতি তার ভালো লেগেছে জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “উত্তরা থেকে পূরবী পর্যন্ত মাত্র ১৯ টাকার টিকেট কেটে এসেছি। অথচ এর আগে একই ভ্রমণের জন্য ৩০ টাকা দিতে হত।

“তবে বাসের স্টাফরা নির্ধারিত স্টেশনের পরে অনেক জায়গায় ডাকাডাকি করে টিকেট ছাড়া যাত্রী তুলেছে এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছেন। এজন্য বাসটি আসতে দেরিও হয়েছে।”

মিরপুর চিড়িয়াখানার সামনে থেকে বাসাবো পর্যন্ত চলাচলকারী ‘নূর এ মক্কা’ পরিবহনের বেশ কয়েকটি বাসকে জটলা করে পার্কিং করে রাখতে দেখা যায়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এসব বাস সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।

একটি বাসের চালক রুহুল আমিন জানান, গত বুধবার এ পরিবহনে ই-টিকেটিং চালু হয়। কিন্তু যে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে সেটি দিয়ে খরচ তোলা সম্ভব হচ্ছে না।

“এ কারণে আগের চার ট্রিপের জায়গায় এখন দুই ট্রিপ দেওয়া হচ্ছে, যাতে লোকসান কমানো যায়,” বলেন তিনি।

রাস্তার অপর পারে বাস থেকে নামা বাসাবো থেকে আসা যাত্রী আব্দুল মজিদ জানান, তাকে বাসের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। তার মনে হয়েছে, এ রুটের স্টাফরা বাসের ট্রিপ কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে চাচ্ছে।

এর কারণ হিসেবে নিয়মিত চলাচলের অভিজ্ঞতা থেকে তার ধারণা, ই-টিকেটিংয়ের মাধ্যমে টিকেট নিলে পুরো টাকাটা স্বচ্ছভাবে মালিকের কাছে চলে যাচ্ছে। এখন বাস কর্মীরা আগের মত যাত্রীর কাছ থেকে ইচ্ছামত ভাড়া নিয়ে নিজেদের পকেটে রাখতে পারছে না। যে কারণে তারা নানা কৌশল করা শুরু করেছেন।

এসব বিষয়ে ই-টিকিটিং এ নাম লেখানো প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, “ই-টিকেট চালু করেছি মাত্র পাঁচ দিন। তাই নতুন এই পদ্ধতির বিচার করার সময় এখনও হয়নি। তবে আগের মত এখন লাভবান হচ্ছি না। তবে এটি একটি স্বচ্ছ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সেবা দিতে পারলে সবারই লাভবান হওয়া সম্ভব।“

তার পরামর্শ, “যাত্রীকে সতর্ক থাকতে হবে তার কাছ থেকে যেন অতিরিক্ত আদায় করতে না পারে। অতিরিক্ত বা নির্ধারিত যাত্রাপথের বেশি রাস্তার টিকেট তাকে না দিতে পারে তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।“

তিনি নতুন এ পদ্ধতিকে স্থায়ী রূপ দিতে নির্ধারিত কাউন্টারে বাস থামানো এবং যাত্রীর বসার জায়গার ব্যবস্থা করতে সিটি করপোরেশনের সহাযোগিতা চান।

Also Read: রাজধানীতে বাস ভাড়ায় পরীক্ষামূলক ই-টিকেট চালু

Also Read: ঢাকার গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া ১৮২ কোটি টাকা: যাত্রী কল্যাণ সমিতি

Also Read: ‘কিসের দূরত্ব, কিসের চার্ট?’

Also Read: রাজধানীর বাসে ‘ওয়ে বিল’, ‘চেকার’ থাকবে না

Also Read: ট্রেনের ই-টিকেটিং কাজ না করার অভিযোগ