‘কিসের দূরত্ব, কিসের চার্ট?’

ঢাকার মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি থেকে শ্যামলীর দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। বিআরটিএ’র ২০১৫ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এই পথের ভাড়া ২ টাকা ৫৫ পয়সা হলেও সর্বনিম্ন ভাড়া হিসাবে ৭ টাকা নেওয়ার কথা বাসগুলোর। কাগজ-কলমে তা থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে এই পথে বাসগুলো যাত্রীদের কাছ আদায় করছিল ১০ টাকা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2021, 06:14 PM
Updated : 8 Nov 2021, 06:14 PM

ডিজেলের দাম বাড়ায় সোমবার থেকে বাস ভাড়ার হারও বেড়েছে। নতুন হারে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা ঠিক করে দিয়েছে বিআরটিএ। নতুন হিসেবে জাপান গার্ডেন সিটি থেকে শ্যামলীর ভাড়া ১০ টাকা হয়েছে, কিন্তু এখন বাসে নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা।

হিসাব করলে দেখা যায়, যে ১৫ টাকা আদায় করা হচ্ছে, সেটা সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়ার চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। আর কিলোমিটারের হিসাবে (২.১৫*১.৫) ৩ টাকা ২২ পয়সা ভাড়া আসার কথা।

ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ সরকার বাড়ানোর পর তিন দিন ধর্মঘট করে সরকারের কাছ থেকে ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাস মালিকরা আদায় করে নেওয়ার পর ঢাকার বিভিন্ন সড়কে চলছে এমন বাড়তি ভাড়া আদায়।

ভাড়া এত বেশি কেন- প্রশ্ন করা হলে মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরাগামী প্রজাপতি পরিবহনের কনডাক্টর সেলিম মিয়ার কাছ থেকে উত্তর আসে- “কিসের দূরত্ব, কিসের চার্ট? এগুলো আমরা বুঝি? আমরা মালিকের কাজ করি। অফিস থেকে বলে দিছে, আগে যা ভাড়া ছিল তার চেয়ে অন্তত ৫ টাকা বেশি নিতে হবে।”

অথচ রোববার বিআরটিএতে ভাড়া বাড়ানোর বৈঠকের পর পরিবহন মালিকদের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ খান আশ্বস্ত করেছিলেন, বাসে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেওয়া হবে না।

আর সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, পুনর্নির্ধারিত হারের চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকার মহানগরে বাসগুলোতে এতদিন কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারিত ছিল, যা বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা (২৬.৪৭%) করেছে বিআরটিএ। আর মিনিবাসের ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫ পয়সা (২৮.১২%) করা হয়েছে। বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা এবং মিনিবাসের ভাড়া ৮ টাকা করা হয়েছে।

ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন ভাড়াও বাড়ানো হলে তিন দিন পর সোমবার ঢাকার সড়কে বাস চলাচল স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কিন্তু মহামারীর মধ্যে ভাড়া বাড়ার প্রথম দিনেই যাত্রীদের কাছ থেকে ভুরি ভুরি অভিযোগ আসছে।

জাপান গার্ডেন থেকে শ্যামলী হয়ে চলাচলকারী আলিফ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল দেড় কিলোমিটারের ভাড়া ১৫ টাকা কেন নেওয়া হচ্ছে?

উত্তরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা একটা সমস্যা। আমরা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ভাড়া আদায় করে থাকি। আমাদের কোনো সময় বেশি নিতে হয়, কোনো সময় ছাড় দিতে হয়।”

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “বনানী থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত নতুন নিয়মে ২৩ টাকার উপরে আসে। আমরা ২০ টাকা রাখি। একইভাবে বছিলা থেকে কল্যাণপুরের দূরত্ব ৬.০৫ কিলোমিটার। ভাড়া নেওয়া হত ১০ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। যদিও ২ টাকা ১৫ পয়সার হিসাবে ভাড়া আসছে ১৩ টাকা।”

প্রজাপতি পরিবহনের কর্মী সেলিম মিয়া একরকম বললেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন অন্যরকম।

তিনি স্টপেজের এক হিসাব দেখিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরর ডটকমকে বলেন, “আপনি স্টপেজের বাইরে উঠানামা করলেও এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজ অনুযায়ী ভাড়া দিতে হবে। স্টপেজ আমরা করি না, এটা বিআরটিএ করে দেয়।”

তবে স্টপেজের বাইরে উঠানামার ক্ষেত্রে তিনি চালক, চালকের সহকারী ও যাত্রীদের দোষারোপ করেন।

সোমবার মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনের সামনে ইতিহাস পরিবহনের একজন কর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, মিরপুর থেকে সাভারের ভাড়া আগে নেওয়া হত ৩০ টাকা। তার মালিক এখন ৪৫ টাকা করে নিতে বলেছেন। যারা ওই ভাড়ায় রাজি হচ্ছেন, কেবল তাদেরই বাসে তোলা হচ্ছে।

অথচ ১৭ দশমিক ৩ কিলোমিটার দূরত্বের এই রুটে পুরোনো নিয়মে ৩০ টাকা এবং নতুন নিয়মে ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে ৩৭ টাকা ২০ পয়সা ভাড়া হওয়ার কথা।

অর্থাৎ, এখানেও আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যদিও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ২৭ শতাংশ।

মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে গাবতলী যেতে ক্যান্টনমেন্ট পরিবহন আগে ১০ টাকা করে নিলেও সোমবার যাত্রীদের কাছে ২০ টাকা করে আদায় করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ, তারা ভাড়া দ্বিগুণ করেছেন।

বিআরটিএর পুরোনো চার্ট হিসাব করে দেখা যায়, ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার দূরত্বে পুরোনো নিয়মে সাড়ে ৬ টাকা বা সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা এবং নতুন নিয়মে কিলোমিটার প্রতি ২ দশমিক ১৫ টাকা ধরে ৮ টাকা ১৭ পয়সা হওয়ার কথা। নতুন নিয়মে সর্বনিম্ন ভাড়ার হিসাবে হয় ১০ টাকা।

মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত দূরত্বে আলিফ পরিবহন এখন ৬৫ টাকা করে নিচ্ছে। এ পরিবহনের কয়েকজন কর্মী জানালেন, এতদিন তারা ৫০ টাকা করে নিতেন। অবশ্য সেটাও ছিল নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি। ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে এই রুটের সর্বোচ্চ ভাড়া হয় ৬২ টাকা।

তিন দিন ধর্মঘটের পর ভাড়া বাড়িয়ে বাস চলাচল শুরু হয়েছে। সোমবার ঢাকার মুগদা এলাকায় যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে উঠছেন বাসে। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

সিটিং সার্ভিসে আরও বেশি

সিটিং সার্ভিস এবং ওয়ে-বিলের নামে (ও-বিল) ঢাকায় চলাচল করা অধিকাংশ বাস বিআরটিএ এর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে আগেই অতিরিক্ত টাকা আদায় করে আসছে। বাস মালিকরা বিআরটিএর হার উপেক্ষা করে তাদের নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে এভাবে বাস ভাড়া আদায় করছিল।

নগরীর এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে কয়েক কিলোমিটার পর পর বাসগুলো একটি করে ‘চেক পয়েন্ট’ বসিয়েছে। এসব ‘চেক পয়েন্টে’ একজন করে লোক রাখা হয়েছে। বাস ওইসব চেক পয়েন্ট অতিক্রম করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যাত্রীর সংখ্যা উল্লেখ করে নির্ধারিত একটি শিটে স্বাক্ষর করে থাকেন। প্রতিটি চেক পয়েন্ট অতিক্রম করলে ১০ টাকা কিংবা কোথাও ১৫ টাকা পর্যন্ত মোট ভাড়ার সাথে যুক্ত হয়।

২০১৫ সালে বিআরটিএ ঢাকা মহানগরীতে চলাচল করা বাসের যে ভাড়া নির্ধারিত করেছিল তাতে দেখা যায়, ফার্মগেইট থেকে মধ্য বাড্ডার দূরত্ব ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এই দূরত্বে জন্য বিআরটিএর ভাড়া তালিকায় নির্ধারিত ভাড়া ছিল ১২ টাকা, কিন্তু সিটিং সার্ভিস এবং ওয়ে-বিলের নামে আগেই আদায় করা হত ২০ টাকা।

প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে নতুন করে ২ টাকা ১৫ টাকা হওয়ায় ওই পথের ভাড়া বেড়ে ১৪ টাকা হয়েছে। অথচ সোমবার অধিকাংশ বাসকে ৩০ টাকা করে আদায় করতে দেখা গেছে।

এই রুটে চলাচলকারী দেওয়ান পরিবহনে ফার্মগেইট থেকে মধ্য বাড্ডায় যেতে স্টেশনারী দোকানী ফজলে আজিমকে ৩০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। এই বাসটি অনেক সময় দাঁড়িয়েও যাত্রী বহন করে।

আজিম বিডিনিউজ টোয়েন্টেোর ডটকমকে বলেন, “বাসগুলো যাত্রীদের থেকে যে ভাড়া নিচ্ছে, তা তো সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি। নতুন করে যে ভাড়া হয়েছে তাতে তো ৩০ টাকার হওয়ার কথা না। এটা নিয়ে প্রতিবাদ করলে ড্রাইভার-হেলপারের সাথে মারামারি করা ছাড়া উপায় নেই। এরা পথে পথে মাস্তান রাখছে, বাড়াবাড়ি করলে যাত্রীর সমস্যা হবে! এজন্য যাত্রীরা প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।”