বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ: গ্রেপ্তারদের ছয়জনের বয়স ১৮ থেকে ২১ এর মধ্যে

র‌্যাব বলছে, এই ডাকাতির ‘পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে’ ছিলেন ২১ বছর বয়সী রতন হোসেন, যিনি বাসের হেল্পার হিসেবে কাজ করেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2022, 09:37 AM
Updated : 8 August 2022, 09:37 AM

টাঙ্গাইলের মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতি এবং এক নারীকে ‘দলবেঁধে ধর্ষণের’ ঘটনায় যে ১০ জনকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে, তাদের বেশিরভাগই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ।

তাদের মধ্যে ছয়জনের বয়স ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে, তিনজনের বয়স ২২ থেকে ২৪ বছর। এছাড়া ৩২ বছর বয়সী একজনও এর মধ্যে রয়েছেন। তারা সবাই বিভিন্ন পরিবহন এবং পোশাক কারখানায় কাজ করেন র‌্যাবের ভাষ্য।

গত ২ অগাস্ট রাতে যাত্রী বেশে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী ঈগল এক্সপ্রেসে উঠে কীভাবে তারা যাত্রীদের মারধর এবং সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র লুট করে, বাসে থাকা এক নারীকে ধর্ষণ করে, সেই বিবরণ সোমবার ঢাকায় র‌্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “সেখানে একাধিক ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটেছে। সেটা হয়ত আরও তদন্তে বের হবে এখানে কী হয়েছে।”

গ্রেপ্তাররা হলেন: রতন হোসেন (২১), মো. আলাউদ্দিন (২৪), সোহাগ মণ্ডল (২০), খন্দকার মো. হাসমত আলী দীপু (২৩), বাবু হোসেন জুলহাস (২১), মো. জীবন (২১), আব্দুল মান্নান (২২), নাঈম সরকার (১৯), রাসেল তালুকদার (৩২), এবং আসলাম তালুকদার রায়হান (১৮)।

রোববার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের কাছ থেকে ২০টি মোবাইল ফোন, দুটি রুপার চুড়ি, ১৪টি সিমকার্ড এবং ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি ক্ষুর উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

এক সপ্তাহ আগের ওই ঘটনায় টাঙ্গাইল জেলা পুলিশও তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন- রাজা মিয়া, আব্দুল আউয়াল এবং নূর নবী।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার আল মঈন বলেন, এই ডাকাতির ‘পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে’ ছিলেন ২১ বছর বয়সী রতন হোসেন, যিনি বাসের হেল্পার হিসেবে কাজ করেন।

“ডাকাতির তিন দিন আগে রতন তার সহযোগী রাজা মিয়াকে এই পরিকল্পনা জানিয়ে ডাকাতির প্রস্তাব দেয়। এরপর মান্নান, জীবন, দীপু, আউয়াল ও নুরনবীকে পরিকল্পনার কথা জানায় রতন। তাদের মধ্যে মান্নান ঢাকার জিরানীবাজার এলাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তিনি পরে সোহাগ, আসলাম, রাসেল, নাঈম ও আলাউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ডাকাতিতে যুক্ত হন।”

রতনের নেতৃত্বে মোট ১৩ জন ডাকাতিতে অংশ নেয় জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, “ডাকাতির প্রাথমিক খরচ মেটানোর জন্য রতন পাঁচ হাজার টাকা লগ্নি করেন। চক্রের সদস্যদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে প্রত্যেকের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রতন ২ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড়ের একটি দোকান থেকে চারটি চাকু, দুটি ধারালো কাঁচি এবং একটি ক্ষুর সংগ্রহ করে।”

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই রাতে সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে থাকে ডাকাত দলের সদস্যরা। রাত আনুমানিক ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসটি সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় পৌঁছালে ডাকাত রাজা বাসটিকে থামার সংকেত দেন। যাত্রীবেশে প্রথমে রতন, রাজা, মান্নান ও নুরনবী বাসে ওঠেন। পরে আরো দুই দফায় ডাকাতচক্রের অন্য সদস্যরা বাসে ওঠেন।

ঢাকার বাইপাইলে যাওয়ার কথা বলে ওঠার আগে তারা দামদরও করে নেন। বাসে তখন ২৪ জন যাত্রী ছিলেন। বাসটি বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতু পার হওয়ার পর ধূমপানের কথা বলে আউয়াল বাসের দরজার সামনে যান। তার ইশারায় রাজা, রতন, মান্নান ও নুরনবীও সামনের দিকে যান বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন।

“তারা সামনে এসে চালক ও হেলপারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। সুপারভাইজারকেও ভয় দেখিয়ে তারা নিয়ন্ত্রণে নেয়। রতন চালকের কাছ থেকে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা বাসের পর্দা দিয়ে বাসের কর্মী ও যাত্রীদের হাত-পা বেঁধে, বাসের সিট কভার দিয়ে মুখে মুখোশ পরিয়ে দেয়। যাত্রীদের সাথে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে এবং শ্লীলতাহানী ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়।”

আল মঈন বলেন, এক পর্যায়ে রতন বাসের স্টিয়ারিংয়ের দায়িত্ব রাজা মিয়াকে দিয়ে নিজে লুটের নেতৃত্ব দেন। কিছুক্ষণ পর রতন আবার চালকের আসনে বসেন।

“মধুপুরের রক্তিপড়া এলাকায় লুটের মাল নিয়ে ডাকাতদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা তৈরি হয়। এসময় রতন পেছনে তাকালে বাসটি রাস্তার পাশের বালুতে উঠে পড়ে।”

দুর্ঘটনার পর ডাকাত দলের সদস্যরা অন্য বাসে করে প্রথমে মধুপুর এলাকায় যায়। পরে সেখান থেকে অটোরিকশায় মধুপুরের কুড়ালিয়া এলাকায় রতনের এক আত্মীয়র ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে লুটের মাল ভাগবাটোয়ারা করে।

র‌্যাব বলছে, লুটের মাল নিয়ে রতন গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় চলে যান। মান্নান, আলাউদ্দিন ও বাবু আলাদাভাবে আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকায় আত্মগোপন করেন। আসলাম, নাঈম ও রাসেল প্রথমে নিজেদের এলাকায় এবং পরে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ এলাকায় আত্মগোপন করেন।

জীবন আত্মগোপন করেন কোনাবাড়ীতে। দীপু প্রথমে টাঙ্গাইলের পিরোজপুর গ্রামে এবং পরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় যান। সোহাগ প্রথমে জিরানী বাজার ও পরে জামালপুর জেলায় এবং পরে আবার জিরানী বাজারে গিয়ে আত্মগোপন করেন। ওইসব এলাকা থেকেই তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় বাসের যাত্রী হেকমত আলী বাদী হয়ে গত বুধবার রাতে টাঙ্গাইলের মধুপুর থানায় মামলা করেন।

ডাকাত দলের ১০ থেকে ১২ সদস্য টানা তিন ঘণ্টা বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এমন ঘটনা ঘটায় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।

এর পর বৃহস্পতিবার অভিযান চালিয়ে টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে রাজা মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয় আব্দুল আউয়াল ও নুর নবীকে।

এদিকে ওই বাসে ধর্ষণের শিকার নারী বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালতে জবানবন্দি দেন। ওইদিনই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।