বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ছয় ঘণ্টায় ঢাকায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
Published : 19 Jan 2024, 03:00 PM
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়েছে ঢাকার নগর জীবন। সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বেশিরভাগ সড়কে পানি জমে। সড়কে জমে থাকা পানি এবং বিকল হয়ে পড়া অটোরিকশা, প্রাইভেটকার বাসের কারণে তৈরি হওয়া যানজট দুর্ভোগ আরও বাড়ায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ছয় ঘণ্টায় ঢাকায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ ও মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় এই ভারী বর্ষণ হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরের বৃষ্টিতে মধুবাগ থেকে মগবাজার, কাকরাইল মোড়, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, পল্টন, রাজারবাগ মোড়, কাকলী থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্ত সড়ক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়ক, মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় বেগম রোকেয়া সরণি, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, শুক্রবাদ, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়।
বৃষ্টি হলেই কেন ঢাকার রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে যায়, এ প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ শাখার একজন কর্মকর্তার কাছে। সাবেক অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওই কর্মকর্তা ড্রেনেজ বিভাগে কাজ করছেন গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় ঢাকার কয়েকটি অংশে জলাবদ্ধ হওয়ার কারণ চিহ্নিত করেছেন ওই কর্মকর্তা। তবে নিজের নাম, পদবি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, মগবাজার ও আশপাশের এলাকার পানি যায় হাতিরঝিলে। সেখান থেকে পাম্পের মাধ্যমে রামপুরা খালে। পাম্প যে পরিমাণ নিষ্কাশন করতে পারে হাতিরঝিলে বৃষ্টির পানি তার চেয়ে বেশি এসেছে। ফলে পাম্প পানি সরিয়ে কুলাতে পারে না।
“এতে যে পাইপলাইনগুলো দিয়ে পানি হাতিরঝিলে পড়ে সেগুলো হাতিরঝিলের পানির লেভেল থেকে কখনো দুইতিন ফুট নিচে চলে যায়। গুলশানের দিক থেকে যে পাইপগুলো নামে সেগুলো কিছুটা উঁচু আর মগবাজারের দিকের পাইপগুলো কিছুটা নিচু। ফলে উঁচু পাইপ দিয়ে পানি ঝিলে আসছে ঠিকই, কিন্তু যেটা নিচে আছে সেই পাইপ ব্যাক-ফ্লো হয়ে পানি কয়েকটি এলাকায় চলে যায়।”
তিনি বলেন, “ঢাকার বিভিন্ন সড়কের লেভেল ভিন্ন হওয়ায় পানি নিষ্কাশনের নালার লেভেলও ভিন্ন। ঢাকার অনেক জায়গায় এ ধরনের সমস্যা আছে। গত দশ বছরে ঢাকার বিলঝিল যা আছে সব ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি যাওয়ার জায়গা পায় না।”
এই কর্মকর্তা জানান, মিরপুর ১২ নম্বর ও আশপাশের এলাকার পানি মুসলিম খাল হয়ে নিষ্কাশন হয়। তবে এই খালের গভীরতা কমে যাওয়ায় খাল দিয়ে পানি নামে কম, পাইপগুলো দিয়েও পানি আসে কম। এতে কালশী ও আশপাশের এলাকায় পানি জমে যায়।
মিরপুর ১০ নম্বর থেকে তালতলা পর্যন্ত বেগম রোকেয়া সরণির পাইপলাইনের মাধ্যমে এসব এলাকার পানি কল্যাণপুর ‘চ’ খালে যায়। কিন্তু কাজীপাড়া এবং শেওড়াপাড়ায় ২৮০ মিটার অংশে এখনও নিষ্কাশন নালা বসানো হয়নি। মাঝখানের ওই অংশে ড্রেনেজ না থাকায় পানি জমে যায়। মিরপুর ১ নম্বর আনসার ক্যাম্পের কাছে দক্ষিণ বিশিল এলাকার রাস্তা নিচু, আউটলেট পর্যাপ্ত না থাকায় সেখানেও পানি জমে।
মানিক মিয়া এভিনিউ, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরসহ কয়েকটি এলাকায় পানি রাসেল স্কয়ার, পান্থপথ হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে হাতিরঝিলে পড়ে। সেখানে একটা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে, সেখানে গিয়ে পানির গতি কমে যায়।
“এখানে পানি ছাঁকতে হয়। ফলে পানি নামতে সময় লাগে বেশি। এতে ধানমণ্ডি ও আশপাশের এলাকার সড়কে পানি জমে যায়।”
বিমানবন্দর সড়কের কাকলী থেকে বনানী রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের পাশের জলাধার, কুড়িল বিশ্বরোডের পাশের জলাধার, খিলক্ষেত এলাকায় জলাধার ভরাট করা হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকার জলাধার, পুকুর, ঝিল নির্বিচারে ভরাট করা হয়েছে। খালগুলোতে কালভার্ট করে, ঢাকার পশ্চিমাংশে বাধ দিয়ে নদী থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
“ঢাকা মরুভূমির শহর না, চারপাশে খালের শহর। সেটা মাত্র ছয় ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেল। নগর কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে খণ্ডিতভাবে এখানে, ওখানে কিছু খাল পরিষ্কার করেন। কিন্তু নদীর সঙ্গে খালের যে সংযোগ তা করা হচ্ছে না। এছাড়া ঝিল, পুকুরগুলো হাত ছাড়া করা হচ্ছে, তারা মনে করছে এগুলো ব্যক্তির সম্পত্তি। ব্যক্তি কখনও দেড় কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে পারে না।”
ইকবাল হাবিব বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ঢাকার পানি নিষ্কাশন নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা করা হয় সেখানে রান অব ওয়াটার (গড়িয়ে যাওয়া পানি) ধরা হয়েছিল ৫৫ শতাংশ। বাকিটা মাটি শোষণ করে নেবে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরকে কংক্রিট দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। এতে রান অব ওয়াটারের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ শতাংশে।
“কারণ ঢাকাকে আমরা পুরো ঢেকে ফেলেছি। প্রতিটি সড়কের পাশে এক ইঞ্চি জায়গা নেই, যেখানে ঘাস বা মাটি আছে যাতে পানি ভূগর্ভে যেতে পারে। এতে যদি ঢাকায় শতভাগ ড্রেনেজ সিস্টেম থাকতও তাহলেও এই পানি নিষ্কাশন করা যেত না।”
(প্রতিবেদনটি প্রথম ফেইসবুকে প্রকাশিত হয়েছিল ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে: ফেইসবুক লিংক)