ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থাটিকে সম্মানস্বরূপ প্রতিবছর বিনা লটারিতে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
Published : 09 Feb 2023, 10:37 PM
বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যেতেই বাঁ পাশে চোখে পড়ে সেই মুক্তধারার স্টল, যে প্রকাশনা সংস্থার হাত ধরে ১৯৭২ সালে সূচনা হয়েছিল এই মেলার।
স্টলে গিয়ে কথা হচ্ছিল বিপণন কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ সেন চৌধুরীর সঙ্গে। জানালেন, মুক্তধারা এবার বই প্রকাশ করেছে মোটেই একটি; প্রয়াত আলী ইমামের লেখা সায়েন্স ফিকশন 'কল্পবিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর ভুবনে’। তবে আরও কয়েকটি বই প্রকাশের কাজ চলছে।
মুক্তধারা আর আগের মতো সরব না থাকলেও ঐতিহ্যবাহী স্টলটিকে প্রতিবছর বিশেষ সম্মানে বিনা লটারিতে মেলায় বরাদ্দ দেওয়া হয়।
মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহার কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। স্ত্রী বিজলী প্রভা সাহা বেঁচে আছেন, কিন্তু তারও বয়স হয়েছে। সেই কারণে বেশ কয়েক বছর ধরেই চিত্তরঞ্জনের শ্যালক জহর লাল সাহা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব সামলিয়ে আসছেন।
তবে জহর লালও এখন যুক্তরাষ্ট্রে ছেলের কাছে থাকেন। সেখান থেকেই তিনি মুক্তধারার এমডির দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকায় মুক্তধারার ঠিকানা ২২ প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার।
মুক্তধারার বিপণন কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ সেন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুরাতন বইগুলো এখনও আমাদের এখান থেকে ভালো বিক্রি হয়। অনলাইনে আমাদের বইয়ের অনেক অর্ডার আসে।
“মেলায় নতুন বই খুব বেশি প্রকাশ করা হয় না। তবে পুরাতন বই নিয়েই পাঠকের কাছে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে মুক্তধারা।”
কাপড় ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হয়েও চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৫১ সালে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন উল্লেখ করে বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, পরে তিনি পুঁথিঘর প্রকাশনী নাম দিয়ে মাট্রিক পরীক্ষার নোট বই ও টেস্টপেপার প্রকাশ করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুঁথিঘর প্রকাশনীর ব্যবসা সাফল্যের তুঙ্গে উঠলে চৌমুহনীতে তিনি একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন।
১৯৫৬ সালে চিত্তরঞ্জন তার বইয়ের ব্যবসা চৌমুহনী থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি নতুন আঙ্গিকে পুঁথিঘর প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে নানা ধরনের বই প্রকাশ করে অভূতপূর্ব সাফল্য পান।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার ফরাশগঞ্জে পুঁথিঘরের অফিস, দোকান ও গুদাম পুড়িয়ে দেয়। নিরাপত্তার জন্য কলকাতা চলে যান চিত্তরঞ্জন। তিনি তখন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য কলকাতায় শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদের মতামতের ভিত্তিতে তখন কলকাতায় জন্ম হয় ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির। দীর্ঘ ৯ মাস কলকাতায় অবস্থানকালে দেশের বরেণ্য সাহিত্যিকদের রচিত ৩৩টি বই প্রকাশ করে মুক্তধারা, স্বাধীনতার পর সেসব বই নিয়ে দেশে ফেরেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের অনুষ্ঠান চলাকাকালে একাডেমি চত্বরে চট বিছিয়ে ৩৩টি বই প্রদর্শনী ও বিক্রি করে মুক্তধারা। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালার সাথে সঙ্গতি রেখে একাডেমির ভেতরে ছোট একটি স্টল স্থাপন করে বই বেচে মুক্তধারা। ১৯৭৭ সালে মুক্তধারার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেয়, সেই থেকে একুশে বইমেলার সূচনা।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী একাডেমিকে এই বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এর পরের বছরই বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।
মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৮৩ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তার ও প্রকাশনা শিল্পে অগ্রণী ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৫ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা একুশে পদকে ভূষিত হন। মুক্তধারা থেকে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১১ শতাধিক।
মুক্তধারার হাত ধরে বইমেলার সূচনার কথা বলতে গিয়ে শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এটি তো ঐতিহাসিক ঘটনা। চট বিছিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা যে বইমেলার সূচনা করেছিলেন, সেই বইমেলা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলার একটি।
“পৃথিবীর আর কোথাও মাসব্যাপী বইমেলা হয় বলে আমার জানা নেই। এটি কেবলমাত্র বাংলাদেশে হয়। এই বইমেলার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছেন চিত্তরঞ্জন সাহা এবং তার প্রতিষ্ঠান মুক্তধারা।"
নানা অনুষ্ঠান
এবারের বইমেলার নবম দিন বৃহস্পতিবার নতুন বই এসেছে ১২৩টি।
এ দিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: কবীর চৌধুরী এবং জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: সাংবাদিক-সাহিত্যিক জহুর হোসেন চৌধুরী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
কবির চৌধুরীকে নিয়ে প্রাবন্ধিক আব্দুস সেলিম বলেন, "এক জীবনে কত যে বিপুল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা যায় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ কবীর চৌধুরী। তিনি বাংলা-ইংরেজিতে যেমন মৌলিক লেখা লিখেছেন, তেমনই অনুবাদও করেছেন এবং তার জীবদ্দশায় কমপক্ষে দশটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কবীর চৌধুরী যথার্থ অর্থেই জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন সবারই শিক্ষক হবার গুণসম্পন্ন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।"
জাহিদ রেজা নূর তার প্রবন্ধে বলেন, "সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনের লড়াইয়ের কালটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যৌবনে বামধারার প্রতি আকৃষ্ট জহুর হোসেন চৌধুরীর সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য হলো বস্তুনিষ্ঠতাকে হেয় না করে সত্যকে তুলে ধরা।"
সভাপতির বক্তব্যে শফি আহমেদ বলেন, "কবীর চৌধুরী এবং জহুর হোসেন চৌধুরীকে স্মরণ আমাদের জাতিগত কর্তব্য। তারা যে প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের সবার জন্য ইতিবাচক সমাজ গড়ার সংগ্রাম করেছেন; তা আজকের প্রজন্মকে স্মরণে রাখতে হবে।
"কবির চৌধুরী এবং জহুর হোসেন চৌধুরী উভয়েই প্রগতির পথিক। তারা একটি শতাব্দীজুড়ে স্বাধীনতা, সাম্য এবং অসাম্প্রদায়িকতার জন্য লড়াই করে গেছেন। শিক্ষা বিস্তার, সাংবাদিকতা এবং সমাজ-রাষ্ট্রের সামূহিক ইতিবাচক বিকাশের জন্য তাদের সংগ্রামী অভিযাত্রা কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়।"
আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, খায়রুল আলম সবুজ, মনজুরুল আহসান বুলবুল ও মুস্তাফিজ শফি।
এ দিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মালেক মাহমুদ, সুপা সাদিয়া, খান মুহাম্মদ রুমেল, গিরীশ গৈরিক।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন বিমল গুহ, স্নিগ্ধা বাউল ও রমজান মাহমুদ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন রাজিয়া রহমান, জাহান বশির ও সামিউল ইসলাম। সংগীত পরিবেশন করেন কাঙ্গালিনি সুফিয়া, আব্দুর রহমান, বশির উদ্দিন সরকার, সুভাষ বিশ্বাস, কোহিনুর আক্তার গোলাপী, মো. নূরুল ইসলাম, বিমল বাউল, সুধীর মন্ডল, অমিয় বাউল।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন পুলিন চক্রবর্তী (তবলা), মো. রিফাত হোসেন (কী-বোর্ড), রনজিৎ কুমার বৈরাগী (দোতারা), গাজী আব্দুল হাকিম (বাঁশি) এবং মো. হাসান মিয়া (বাংলা ঢোল)।
শুক্রবার যা থাকছে
বইমেলার দশম দিন শুক্রবার মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। এর মধ্যে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহর।
এ দিন সকাল সাড়ে ৮টায় অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করবেন শিল্পী হাশেম খান।
আর সকাল সাড়ে ৯ টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তেন অনুষ্ঠিত শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব।
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ এবং জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: এস এম সুলতান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মলয় বালা ও সৈয়দ নিজার। আলোচনায় অংশ নেবেন সুশান্তকুমার অধিকারী, ইমাম হোসেন সুমন, নাসির আলী মামুন ও নীরু শামসুন্নাহার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মুনতাসীর মামুন।